চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

বঙ্গবন্ধু এবং রহমত আলীর মস্তিষ্কাঘাত

মহীবুল আজিজ

২৬ জুলাই, ২০১৯ | ১:২৩ পূর্বাহ্ণ

শনিবার সকাল থেকে রহমত আলীর খোঁজ নেই। তার বউ ছেলে দিনারকে পাঠায় গোপালের চায়ের দোকানে। না, রহমত সেখানে আড্ডায় নেই। অল্পবয়স্ক ছেলেটাকে গোপাল একটা জিলিপি দিয়েছে খেতে। খেতে-খেতে বলে, কেউ দেখেনি তাকে। চুল কাটায় রাখালের সেলুনে- নেই সেখানেও। মাঝে-মাঝে বলুয়ার দীঘির পাড়ে কাজরির বাবার মুদির দোকানের সামনে কোরবান আলী সওদাগরের খেলার মাঠে গিয়ে পাড়ার ছেলেদের অলিম্পিক টুর্নামেন্ট দেখে। উঁহু- সেখানে কোন খেলা হয় না, খা-খা করে গোটা মাঠ। আর বাকি থাকে লামাবাজার স্কুলের লাগোয়া এম এ গফুরদের বাড়ি। ওখানে ইউসুফ বলে একটা তাগড়া ছেলে থাকে। বডি বিল্ডিং করে সারা দেশে স্বর্ণপদক জিতেছিল আগের বছর। রহমত আলীর ভাল লাগে ইউসুফ আর তার সাগরেদদের শারীরিক কসরত দেখতে। এম এ গফুর কোরবানিগঞ্জ মাড়োয়ারি বিল্ডিংয়ের সামনে ডাক্তার রায়মোহন সরকারের চেম্বারে বসে-বসে জ¦রে কাঁপে আর আমলকি চিবায়। মুখের সব রুচি উধাও। আমলকি চিবালে রুচি আসে জানায় সে সকাল থেকে আমলকি চিবিয়ে যাচ্ছে। পাড়ার ডাক্তার রায়মোহনের ধরাবাঁধা সময় নেই। ঐটাই বাসা ঐটাই চেম্বার। রোগি এলেই স্টেথিসকোপ নিয়ে দেখতে শুরু করবেন। রহমত সেখানেও নেই। তার বউ তখন দুর্ভাবনায় পড়ে। জ¦লজ্যান্ত লোকটা গেল কই!
এই এক স্বভাব রহমত আলীর। বলা নেই কওয়া নেই, দুম করে কই চলে যাবে। দুঃশ্চিন্তা করতে-করতে যখন বাড়ির লোকেদের ঘুম হারাম তখন কোত্থেকে এসে হাজির হবে সে। কি রে রহমত, কোথায় গেলি তুই? সে গিয়েছিল বলি খেলা দেখতে। কুমিল্লার রমজান বলির সঙ্গে চকরিয়ার হাশেম বলির কুস্তি-লড়াই। সে যে কী উত্তেজনা আর আন্দোলন। তারপর ধরো এক বিকেলে রহমত চলে গেল রঙ্গমে অশ্রু দিয়ে লেখা দেখতে। চিন্তায়-চিন্তায় মিনুর শরীর খারাপ হয়ে যাওয়ার যোগাড়। ঘণ্টাতিনেক পরে তার উদয় হয়। এদিকে চিন্তায় বউটার বদহজম হতে শূরু করেছে। আর রহমত তখন বউকে বলে, শোনো তোমারে ইস্টোরিটা বলি। বলে সে সিনেমার গল্প সবিস্তারে বর্ণনা করতে থাকে দিনারের মা’কে। এরকমই রহমত আলী। বিয়ের সময় তার এই উড়নচ-ী স্বভাব সম্পর্কে তার বাপ সাবধান করে দিয়েছিল মিনুকে- এককানা চোখে চোখে রাখিবা হিতারে। কেননা, রহমতের সঙ্গে নাকি একটা জিন থাকে। হঠাৎ-হঠাৎ সেই জিন আছর করলে রহমতের আর কোন ঠিক থাকে না। সে তখন সম্পূর্ণ অন্য মানুষ হয়ে যায়। তখন পৃথিবীর কোন শক্তি নয়, জিনটাই নাকি রহমতের চালক হয়ে যায়। তবে, একটাই আশার কথা জিন আছর করলেও রহমতকে দিয়ে সে কোন খারাপ কাজ করায় না। অন্তত পাড়ার লোকেদের সে-ধারণা বদ্ধমূল। তার প্রমাণ একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধ।
একাত্তরে রহমত চট্টগ্রাম কলেজে ডিগ্রি পরীক্ষা দেবে। মার্চের সাত তারিখ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর থেকে এক প্রকারের যুদ্ধাবস্থাই শুরু হয়ে গেল বলা চলে। মিসকিন শাহ’র মাজারটা পেরিয়ে গনি বেকারি বামে রেখে কোণের পেট্রোল পাম্পের লাগোয়া পাহাড়টার দিকে দৃষ্টি দিতেই কেমন যেন একটা শিরশিরে ভয় তার শরীর বেয়ে সাঁই নেমে যায়। টিলার মত রাস্তাটাতেই তার ওঠার কথা সেখান থেকে সোজা নেমে যেতে-যেতে ডানে রহমতগঞ্জ বাংলা কলেজ বামে কুসুমকুমারী বালিকা বিদ্যালয় এবং তারপর জে এম সেন হল। রাস্তার মুখে পা দিতেই গম্ভীর ঘষটানো একটা শব্দে একটা সবুজ জিপ নেমে যায়- হুইল নামের জিপ। পাহাড়টা মানে গুড্স্ হিল। দেখে মুহূর্তকাল থমকায় রহমত। বলে কী- দেশ স্বাধীন হবে বলে যুদ্ধ লাগবে আর এদিকে পাকিস্তানি পতাকা উড়িয়ে এমন ফোর্সেকে চলে যায় জিপ গাড়ি নিয়ে। হতে পারে কোন ডিসি এসপি। কিন্তু তার তো থাকার কথা এনায়েতবাজার বৌদ্ধ মন্দিরের ডিসি হিলের দিকে। তখন রহমত আলী মনে-মনে একটা যুক্তির সূত্র খাড়া করায়। গুড্স্ হিল এবং ডিসি হিল দু’টোই যেহেতু হিল নিশ্চয়ই দু’য়ের মধ্যে একটা কোন গভীর সম্পর্ক আছে যেটা তার মত গোবেচারা লোকের পক্ষে আবিষ্কার করা সহজ নয়। ঘরে ফিরলে রহমতের দুঃশ্চিন্তা বাড়ে। তাদের পাড়ার একটা দিকে বিহারিদের বসতি। দূর থেকে বাড়িগুলো দেখলেই বোঝা যায়। আসাদগঞ্জে আমির মার্কেটে তাদের কাপড়চোপড় আর ইন্ডেটিং ব্যবসা। কেউ-কেউ নাকি হুন্ডির কারবারিও। ওদের বাড়িগুলোর অনেককটার নাম দেখে-দেখে মুখস্থ হয়ে গেছে রহমতের- গুলশান, বাহার, নওবাহার এরকম। লোহার গেটের বাইরে উর্দু হরফে নানা বক্তব্য লেখা। একবার মনে হয় আরবি আবার মনে হয় উর্দু। বেশির ভাগ উর্দুই, তবে কোথাওবা উর্দু-আরবির মিশ্রণ কিন্ত বাংলা নেই। তো সেই বিহারিপাড়ার এক ছোকরা মজিদ নাকি গোপালের চায়ের দোকানের সামনে একটা বাঙালি ছেলেকে শাসিয়ে গেছে- বেশি বাড় বাড়লে ডিসি সাহেবের লোক আনিয়ে দোকান ভেঙে দেবে। বিষয়টা ছিল মামুলি। গোলমরিচের দাম নাকি দোকানি তার কাছ থেকে বেশি নিয়েছিল। ওদিকে গোপালের চায়ের দোকানে তখন একদিকে গরম-গরম সামুচা ভাজা হয় বড় কড়াইয়ে আরেকদিকে বাঙালি ছোকরারা গোটা দোকানটাই গরম করে দেয় রাজনীতির নতুন হাওয়া বইয়ে দিয়ে- বঙ্গবন্ধু এবার দেশ স্বাধীন কইর‌্যাই ছাড়বে। গোপাল যত বোঝায়, ও দাদারা, ও ভাইয়েরা, এ্যাডে ইন কথাবাত্তা ন কইয়োন, দিনকাল খারাপ। তখন তাকে পাল্টা ধমক খেতে হয় যুবকদের। দিনকাল এর চাইতে আর খারাপ হওয়ার উপায় নেই। রাতে খেতে বসলে রহমতের বাবা ইসহাক সওদাগর তাকে গম্ভীর ঠা-া স্বরে বলল, অ পুত্ য্যাডে-হ্যাডে ন যাইস, যুদ্ধ আইয়ের দ্যাশোত্, বাঁচন-মরনর ঠিক নাই। রহমত নিরবে শোনে জনকের কথা।
সপ্তাহখানেক পরে একদিন পাড়ায় রহমতকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। ওর বাবা-মা দু’জনেরই অশ্রু যখন শুকিয়ে আসে তখন একদিন খবর আসে। আষাঢ় মাসের এক বৃষ্টিসিক্ত দিনে প্রতিবেশি জালাল জানায়, রহমতকে দেখা গেছে রামগড়ের দিকে। তার আগে ছিল বোয়ালখালি করুলডেঙ্গা পাহাড়ের দিকটাতে। ততদিনে সে মুক্তিযোদ্ধা। তিন রকমের অস্ত্র চালাতে পারে। তারপর একদিন রহমত নিজেই একটা চিরকুট পাঠায়- বাবা, কিছু মনে করিবেন না। তোমাদের জানাইয়া আসিবার উপায় ছিলো না। জানাইলে তোমরা আমাকে যুদ্ধে আসিতে দিতে না। মন শক্ত করো। এই যুদ্ধ বাঁচা-মরার। বাঁচিয়া থাকিলে আবার দেখা হইবে আর মরিয়া গেলে পরকালে দেখা হইবে। আমাদের জন্য দোয়া করিবা যেন তাড়াতাড়ি দেশ স্বাধীন করিয়া ফিরিয়া আসিতে পারি। বিজয়ীর বেশে ফিরেছিল রহমত। এখন আর তার বাপ-মা কেউ নেই যে দুঃশ্চিন্তা করবে। বউ মিনু আর ছেলে দিনার অনেকক্ষণ ধরে এদিক-ওদিক খোঁজাখুঁজি করে শেষে ধরেই নেয়, নিশ্চয়ই রহমত এমন কোথাও গেছে যেখানে তার যাওয়াটার খুবই প্রয়োজন ছিল। সূর্য তখন ঠিক মাথার ওপর থেকে কেবলই নামি-নামি করছে।
দু’টো মানুষ যে তার জন্যে চিন্তা করতে করতে কাহিল সেদিকে কী খেয়াল আছে লোকটার। দুপুরের প্রখর রোদ মাথায় করে ঘরে ঢুকেই বউকে বলল, ভাত দও। খেতে-খেতে এবং খাওয়া শেষ করেও রহমত তার গল্পের ফোয়ারা ঘরময় ছড়িয়ে দিতে থাকে। গল্প কী তাকে বলা যাবে। সেটা গল্পের চেয়েও আকর্ষণীয়। আগের দিন দৈনিক আজাদী পত্রিকায় সংবাদটা ছেপেছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পরদিন মানে শনিবার রাঙামাটির কাউখালি যাবেন বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র উদ্বোধন করবার জন্যে। পথে তিনি যাত্রাবিরতি করবেন লালদীঘির মাঠে এবং কিছুক্ষণ বক্তব্য রাখবেন জনতার উদ্দেশ্যে। ব্যস, আর পায় কে তাকে। রহমত আলী তখনই মনে-মনে স্থির করে নেয়, বঙ্গবন্ধু যদি দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে লালদীঘি পার হন তাহলে তাকে অবশ্যই সকাল সাতটা থেকে আটটার মধ্যে অকুস্থলে পৌঁছাতে হবে। নইলে মঞ্চের কাছাকাছি জায়গা মিলবে না। কাজেই কাউকে কিছু না বলে চলে গিয়েছিল রহমত। এই যে সে কষ্টটা করলো তার পুরস্কারটাও সে পেল হাতে-হাতেই। মঞ্চের একেবারে সামনেই জায়গা মিলে যায় তার। বলতে গেলে জীবনের যে-স্বপ্নটা তার পূর্ণ হওয়া বাকি ছিল সেটা কাল পূর্ণ হয়ে গেল। ছবিটা একদম স্পষ্ট আর পরিষ্কার। দশটার মধ্যেই মাঠ লোকে-লোকারণ্য। ধরো জব্বরের বলিখেলার মেলা হলে ভিড়টা যেমন চরিত্রের হয় ঠিক তেমনটাই। বাংলাদেশ ব্যাংকের দিকের রাস্তা থেকে একটা স্রােত। ওদিকে সিনেমাপ্যালেসের দিক থেকে এসে খুরশিদমহলের সামনেকার প্রশস্ত জায়গায় আরও সমান্তরাল দু’টো স্রােত। তারপর আন্দরকিল্লা থেকে লালদীঘি হয়ে বামে জেলা কারাগারের দিকে একটা আর কোতোয়ালি থানার দিকে আরেকটা মোট দু’টো স্রােত। সবই চলিষ্ণুতায় ঠাসা আর ঘননিবদ্ধ। সকলের একটাই লক্ষ্য বঙ্গবন্ধুকে এক নজর দেখা আর তাঁর কথা শোনা। মিনু আর দিনার অবাক হয়ে শুনতে থাকে স্বামী আর পিতার মনোমুগ্ধকর বিবরণ। যেন তারাও তখন লালদীঘির মাঠের দর্শক এবং তাদের সামনে দাঁড়ানো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
ঠিক সাড়ে দশটার দিকে এসে থামে বঙ্গবন্ধুর গাড়ি। কোতোয়ালির টিলা থেকে যে-রাস্তাটা নেমে এসে সদর রাস্তায় মিলেছে ঠিক সেখানটায়। একটা হাল্কা নীল রংয়ের মার্সিডিজ গাড়ি থেকে নেমে দৃঢ়-ঋজু মানুষটা তাঁকে ঘিরে ধরা ভিড় ধীরে পেরিয়ে মঞ্চে গিয়ে ওঠেন। পরনে সাদা পাজামা সাদা পাঞ্জাবি। তার ওপরে চাপানো মুজিব কোট। হাতে ধরা একটা পাইপ। রহমত পত্রিকায় দেখেছে বহুবার পাইপ-ধরা বঙ্গবন্ধুর ছবি। দেখে মনে হতে পারে এক্ষুণি তিনি অগ্নিসংযোগ করবেন সেই পাইপে। মঞ্চ তখন অনেক লোকের সুশৃঙ্খল ভিড়ে পরিপূর্ণ। নিরাপত্তার লোকেদেরও দেখা যাবে- ইউনিফর্মপরা এবং সাদা পোশাকে দুই রকমেরই। আওয়ামী লীগের অনেক পরিচিত মুখকে দেখে চিনতে পারে রহমত। মহিউদ্দিন চৌধুরী, আখতারুজ্জামান বাবু, জহুর আহমদ চৌধুরী, মোসলেমউদ্দিন আহমেদ এরকম আরও অনেককে দেখা যায়। হয়তো এদিকে-ওদিকে ছিল আরও অনেক পরিচিত মুখ কিন্তু রহমত ঠায় একদৃষ্টে সমস্ত মুগ্ধতা দিয়ে দেখছিল কেবল তারই নায়ককে। এই সেই বঙ্গবন্ধু যাঁর একটি ডাকে সমস্ত বাঙালি লড়াই করে ছিনিয়ে এনেছিল দেশ। যাঁর বজ্রকণ্ঠ শুনে তারা অস্ত্র হাতে আগুয়ান হয়েছিল যুদ্ধের ময়দানে শত্রুনিধনের স্থির লক্ষ্যে। মঞ্চে অল্পবয়সী কিছু ছাত্রকেও দেখা যায়। তারা নিকটের সরকারি মুসলিম হাই স্কুল থেকে এসেছে। সঙ্গে সম্ভবত তাদের হেড মাস্টারও রয়েছেন। তারা ফুল ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নেয় তাদের প্রিয় নেতাকে। বঙ্গবন্ধু আসলে বেতবুনিয়া যাচ্ছেন। কাজেই হাতে সময় কম। অন্যদের বক্তৃতা করবার সুযোগ নেই। জহুর আহমদ চৌধুরী এবং মহিউদ্দিন চৌধুরী কিছু কথা বলেন বাংলদেশের যুদ্ধ এবং জাতির করণীয় সম্পর্কে। বঙ্গবন্ধু দেশকে একদিন সোনার বাংলায় রূপ দেবেন এমন কথা বলেন তাঁরা। রহমতের একবার মনে হচ্ছিল যাত্রাপথের ক্লান্তি এবং ধকল সামলে নেবার জন্যে বঙ্গবন্ধু তাঁর হাতে ধরা পাইপটা ধরিয়ে নেবেন। কিন্তু না বঙ্গবন্ধু তাঁর আশপাশটা বেশ মনোযোগের সঙ্গে পরখ করতে থাকেন খানিকটা। সাদা শার্ট সাদা প্যান্ট পরা মুসলিম হাই স্কুলের কোমলমতি ছেলেরা তাঁর গা ঘেঁষে দাঁড়ানো। রহমতের মনে হতে থাকে, আহা সে যদি আজ মুসলিম হাই স্কুলের ছাত্র হতো তাহলে নিশ্চয়ই তারও এমন সুযোগ ঘটতো মঞ্চের ওপরটায় গিয়ে বঙ্গবন্ধুর পাশে দাঁড়ােেনার। না, বঙ্গবন্ধু পাইপ ধরান না। পাইপটা যেমন ছিল তেমনই তাঁর হাতে ধরা থাকে। হয়তো অল্পবয়স্ক ছাত্রগুলোর কথা ভেবে তিনি নিজেকে সংযত করেন। তারপর এলো সেই আকাক্সিক্ষত মুহূর্ত। একদিন যাঁর আহ্বানে নিজের ঘরদোর ছেড়ে সকলের ঘরদোর রক্ষার প্রতিজ্ঞায় বেরিয়ে পড়েছিল জীবন-মৃত্যুর সমান-সমান বাজি নিয়ে আজ সেই মানুষটি তার ধরাছোঁয়ার সীমানায়। যে-ব্যক্তিটিকে শত্রু পাকিস্তানিরা পর্যন্ত মারতে সাহস করে নি সেই শেখ মুজিব সেই বাঘের বাচ্চা এখন রহমত এবং জনতার সামনে মাইকে ভরাট গলায় বলতে শুরু করেছেন। প্রতিটি শব্দ মন দিয়ে শোনে রহমত। বঙ্গবন্ধু সবাইকে শুভেচ্ছা জানান। বলেন যে বহু কাজ এখনও বাকি রয়ে গেছে। যেহেতু গোলামির হাত থেকে সবাই এখন মুক্ত, নিশ্চয়ই দেশ একদিন সমৃদ্ধ হবেই। তিনি বলেন রাঙামাটির কাউখালিতে বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ শুরু হলে দেশ জ্ঞানে-বিজ্ঞানে-তথ্যে-যোগাযোগে সমগ্র বিশে^র সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পথ পাড়ি দেবে। সবাইকে তিনি ধন্যবাদ জানান কষ্ট স্বীকার করে আসবার জন্যে। তাঁর সর্বশেষ কথাগুলো তখনও রহমত আলীর কানের কাছে বাজতে থাকে, আপনারা আমার জন্যে দোয়া করবেন, দেশটাকে যেন আপনাদের আকাক্সক্ষা মোতাবেক গড়ে তুলতে পারি। এটুকুই। আবার, তিনি বিদায় নিয়ে চলে যান। হাতে পাইপ। হয়তো পথে কোথাও পাইপে অগ্নিসংযোগ করবেন। রহমতের চোখে স্বপ্নের সেই বিভোরতা তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে দীর্ঘকাল। বউ-ছেলেকে বলতে থাকে সে, বুঝিলা না দিনারের মা, বুঝিলি নি ব্যাডা, আঁর এই জীবন্নান আজিয়া সাত্থক অই গেইয়ে। যদি আঁই আজিয়া মরিও যাই গই ত-ও আঁর মনত্ কনো দুক্খো থাইক্তনো। আঁই আঁর এই দুই চোখ দি বাংলাদেশরজাতির পিতা বঙ্গবন্ধুরে চাই আস্যি! তারপর রহমত আলীর একই কাহিনি গোপালের চায়ের দোকান রাখালের সেলুন কাজরির বাবার মুদির দোকান কোরবানিগঞ্জ মাড়োয়ারি বিল্ডিং লামাবাজার স্কুল টেরিবাজার আফিমের গলি বকশির হাঁট পুলিশ বিট আন্দরকিল্লা হয়ে আবর্তিত হতেই থাকে। পৃথিবীর সবচাইতে ভাগ্যবান মানুষদের একজন বলে গণ্য হতে থাকে রহমত আলী। রহমত আলীর নিজের কাছেও নিজেকে খুব সুখি মনে হয়।
লোকে বলে মানুষের নাকি সুখ বেশিদিন কপালে থাকে না। রহমতের ক্ষেত্রেও হলো তাই। এ এমনই এক ঝড়ের মত এলো রহমতের গোটা জীবনটা একেবারে তছনছ করে দিয়ে গেল। শুক্রবার ছিল সেদিন। আগের দিন ধোয়া সাদা পাঞ্জাবিটা সুন্দর করে ভাঁজ করে বালিশের নিচটায় চেপে রেখেছিল যাতে দেখলে মনে হয় নির্ভাজ ইস্ত্রি করা পাঞ্জাবি। ক’দিন আগে স্টিম লন্ড্রিতে ইস্ত্রি করতে দিয়েছিল তার আদ্দির পাঞ্জাবিটা। বুকের মাঝখান থেকে এক চিলতে কামড়ে নিয়ে গেছে গরম ইস্ত্রির থাবা। তারপর থেকে ভয় লাগে স্টিম লন্ড্রিতে কাপড় দিতে। বিশেষ করে যেগুলো মোটা কাপড় না, পাতলা সেগুলো ক’টা দিন এভাবেই প্রাকৃতিক ইস্ত্রি করে নেয় রহমত। সেদিনও নিয়েছিল। সেটা পরে জুমার নামাজ পড়তে যাবে আন্দরকিল্লা জামে মসজিদে। সকালবেলা সে তার মার্ফি ব্র্যান্ডের রেডিওটা কেবল অন্ করেছিল খবর শুনবে বলে। আর তখনপৃথিবীর সবচাইতে ভয়ানক সবচাইতে শোচনীয় সবচাইতে দুঃখের সবচাইতে ভয়ের সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে ইথারে- আমি মেজর ডালিম বলছি- শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে…। আধশোয়া থেকে এক লাফে বিছানায় উঠে বসে রহমত। রেডিওর ভল্যুম বাড়িয়ে দিয়ে আরেকবার শোনে। শুনতেই মাথার ভেতরটা তার চক্কর দিয়ে ওঠে। একটা তীব্র স্রােতের ধাক্কায় হঠাৎ দাঁড়ানো থেকে সে বসে পড়ে বিছানায়। রহমত চিৎকার করে ওঠে- ওয়া তোঁয়ারা কন কন্ডে আছো বঙ্গবন্ধুরে মারি ফেইল্যে। অবুক অবুক অবুক রে অবুক, আঁর নেতারে মারি ফেইল্যে। ওয়া তোঁয়ারা ব্যাক্কুন হুনি যও, আর্মিঅক্কল বাংলাদেশর জাতির পিতারে হত্যা গইয্যে। অ দিনারর মা তুঁই কন্ডে গেইও দে, আঁর নেতা তো আর বাঁচি নাই, আঁর বঙ্গবন্ধুরে দৈইত্তোঅক্কল জানে মারি ফেইল্যে…এ …এ…এ… দিনারের মা মানে রহমতের বউ মিনু তখনসকালের নাস্তা বানাচ্ছে। ছেলে দিনারের জন্যে তেলেভাজা পরোটা আর তাদের দু’জনের জন্যে আটারুটি। রহমতের কথা সে শুনতে পায় কি পায় না। কিন্তু একটা জড়ানো এএএ-ধ্বনি তার কানে সহসা ধাক্কা লাগালে দ্রুত সে ছুটে আসে পেতলের খুন্তিহাতে। মিনু খানিকটা বিরক্তই। তাওয়ায় রাখা ছেলের পরোটা না উল্টিয়েই সে ছুট লাগায়, ওয়া দিনারর বাপ, উর্জ কিল্লাই গইত্তা লাই¹ দে? কিন্তু কথার রেশ তার দ্রুতই মিলিয়ে যেতে থাকে রহমতের মুখ থেকে বেরনো অদ্ভুত এক গোঁগোঁ ধ্বনির তোড়ে। রহমত তখন পড়ে আছে বিছানায়। মুখের দুই পাশে ঠোঁটের দুই দিকে গাঁজলার মত বেরোচ্ছে। স্বামীর সংবিৎ হারানোর ব্যাপারটা মিনু ঠিকই বুঝতে পারে কিন্তু সে জীবন-মৃত্যুর মধ্যকার ঠিক কোন্ অবস্থানে সেটা তার কণ্ঠনিঃসৃত গোঁগোঁ-ধ্বনি থেকে স্পষ্ট বুঝতে পারা যায় না। ছেলেটাও ততক্ষণে ছুটে এসেছে। ও আল্লা-রে, তোর বাপ মরি যার গই দে, ও আল্লা-রে বলতে বলতে বিলাপি কণ্ঠে একটানা আর্তনাদ করতে থাকে মিনু। বিছানার ওপর মার্ফি রেডিওটা তখনও বাজে… প্রত্যেককে আইন-শৃঙ্খলা মেনে চলবার জন্যে স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে… কোথাও কোন সন্দেহজনক… দুম্ করে সেটা বন্ধ করে দেয় মিনু। দিয়ে স্বামীর মাথাটা নিজের কোলে তুলে নেয়- অ দিনারর বাপ, তুঁই চোক মেলি চও, কী অইয়ে দে তোঁয়ার, অ দিনারর বাপ। রহমতের গোঁগোঁ-ধ্বনিটা কমতির দিকে। সে যে বেঁচে রয়েছে সেটা বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয় কিন্তু মিনু ঠিক বুঝতে পারে না রহমত আসলে কোন্ দিকে চলেছে কিংবা আসলেই তার কী ঘটেছে। ছেলে দিনার ততক্ষণেচার/পাঁচজন প্রতিবেশিকে ডেকে নিয়ে এসেছে ঘরে।
সবাই মিলে ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে গেল রহমতকে। রাস্তাঘাট থমথমে। কোথাও কোন জটলা চোখে পড়ে না। যান-চলাচল অস্বাভাবিক রকমের কম। একটু পরপর পুলিশ-ভ্যান কিংবা সামরিক বাহিনির গাড়ি ছুটে যায়। কোথায় কে জানে। যেতে হলো ঠেলাগাড়ি করে। সংজ্ঞাহীন রহমত আয়ুর অতীত না হওয়ার কারণে লোকেরা তাকে দ্রুতই হাসপাতালের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চায়। ডাক্তারের চিকিৎসা পেলে হয়তো তার জ্ঞান ফিরে আসবে।
আগামী সংখ্যায় সমাপ্য

শেয়ার করুন