চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

‘প্রবন্ধ সমুচয়ে’ (২০১৮) শফিউল আলম

নিবেদিত এক শিক্ষাবিদ

ড. মনিরুজ্জামান

৩ মে, ২০১৯ | ১:২৩ পূর্বাহ্ণ

সংস্কৃত প্রবাদে আছে সকালের মেঘ যতই গুড়গুড় করে ডম্বরু বাজাক, ওতে কাজের কাজ কিছুই হয় না। প্রায়সই ‘বহ্বার¤েভ লঘু ক্রিয়া’য় তার সমাপ্তি ঘটে। সংসারেও তেমনি অনেক কাজই সাড়ম্বরে শুরু হয়, কিন্তু তার ফলদায়ক পরিণতি ঘটে কতটুকু ? তেমনি শিক্ষা সংস্কৃতি এবং সাহিত্যের বিবিধ অনুষঙ্গ নিয়ে বর্তমানে বিস্তর লেখালেখির খবর আমরা পাই। বিষয়গুলির সাম্প্রতিক পাঠ-প্রিয়তার বিষয়েও কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তুকোনও নির্দিষ্ট প্রস্তাব ও তার বাস্তবায়নের লক্ষ্যেরচিত মৌলিক লেখার চাহিদা খুব একটা পূরণ হয় কি? বর্তমান আলোচনায় তাই একজন বর্ষীয়ান শিক্ষাবিদের রচনাকে সামনে রেখে আমরা এগুতে চাই। এটি বর্তমান কালে প্রকাশিত প্রায় অনপরিচিত অথচ নিাবষ্ট একজন গদ্যকারের সুলিখিত একটি গ্রন্থ। শিক্ষা ও সাহিত্যই এখানে মুখ্য বিষয়। লেখকের নাম শফিউল আলম। আমাদের দেশের দক্ষিণ প্রান্তের (চকরিয়া-হারবাং) একজন সিনিয়র সাহিত্য-কর্মী। সরকারের শিক্ষাবিভাগের অবসরপ্রাপ্ত একজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষা-চিন্তক। আমাদের বহু লেখকের মতো তাঁর গ্রন্থকেও পাঠক-প্রিয় যদি নাও বলি, কিন্তু তাতেই তার গ্রন্থমূল্য নিঃশেষ হয়েেেছ তা ভাবার কারণ নেই। আলোচ্য গ্রন্থটিতে কিছু ব্যতিক্রমিতা লক্ষ্য করা যায়। তাই অন্তত বিষয়-গৌরবে এবং আলোচনার গুরুত্বে ও মুন্সিয়ানায় ্ গ্রন্থটি যে আমাদের প্রবন্ধ সাহিত্যের ঔজ্জ্বল্য বর্দ্ধন করে বিশেষ আসন লাভ করবে সেই ধারণা থেকে আমার এই আলোচনা।
গ্রন্থটির নাম ‘প্রবন্ধ সমুচয়’, এটি ফেব্রুয়ারি ২০১৮-তে প্রকাশিত অনিন্দ্যপ্রকাশের অনিন্দ্য একটি প্রকাশনা।গ্রন্থটিতে অধ্যাপক শফিউল আলম (= শ.আ.) প্রায় অর্ধশত– প্রবন্ধ সন্নিবদ্ধ করেছেন। গ্রন্থটি নানা বিষয়ক এবং মিশ্র বিষয়কও; তবে শিক্ষা-চিন্তাই এখানে প্রাধান্য পেয়েছে অধিক। সেটি এই আলোচনারও একটি প্রধান দিক। তবে প্রথমে লেখকের একটি সাধারণ পরিচিতি দিয়ে এর সূচনা করা যাক।
১৯৬৫তে যুদ্ধের সময় এম.এ. পাশ করার পর পরই লেখক (= শ.আ.) প্রথমে ‘পূর্বপত্র’ নামে একটি সাহিত্যপত্রের একটিমাত্র সংখ্যা সম্পাদনা করে সাহিত্যজগতে প্রবেশ করেন। কিন্তু আশ্চর্য যে পত্রিকাটির আর কোনও সংখ্যা প্রকাশিত হয় নি। দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গের সাহিত্য আন্দোলনে সঙ্গে সঙ্গে এটি একটি মাইলফলক বলে চিহ্নিত হয়ে ওঠে। এর পর অনেক দিনই প্রায় নীরব থেকে লেখকের প্রথম গ্রন্থ প্রকাশিত হয় (বাংলা একাডেমির জীবনী সিরিজের বই বাদ দিয়ে ) নতুন সহস্রাব্দে এসে; তখন থেকেই তাঁর প্রকৃত লেখালেখি।
শফিউল আলমের বহু লেখার মধ্যে শিক্ষা বিষয়ক বইগুলি বিশেষ উল্লেখ্য। যদিও ভিন্ন বিষয়ক বইগুলিও কম গুরুত্বের নয়। শিক্ষা বিষয়ক গ্রন্থগুলির মধ্যে পাই- প্রসঙ্গ ভাষা বানান শিক্ষা, শিক্ষাভাবনা ও ভাষাচিন্তা, মুসলমান ছাত্রদের বাংলা শিক্ষার প্রাইমার ও অন্যান্য প্রবন্ধ ইত্যাদি। আর আছে তাঁর শিক্ষাঙ্গনের ও শিক্ষাজীবনের নানা জনের স্মৃতি ও মূল্যায়ন-চিন্তাও। বিদেশে অধ্যয়নের ফলে ‘শিক্ষা’ বিষয়েই তাঁর বিশেষজ্ঞতা ঘটে। শিক্ষার সাথে সমান্তরাল ভাবে তাঁর রচনায় ভাষাও সমান গুরুত্ব লাভ করেছে। এতে তাঁর ভাষাগঠন (ঈড়ৎঢ়ড়ৎধ ধপয়ঁরংরঃরড়হ ্ ফবংরমহধঃরড়হ ) এবং ভাষাশৈলী (ড়ৎমধহরংধঃরড়হং নড়ঃয রহ খরঃবৎধৎু ঈৎরঃরপরংস ্ চবফধমড়মরপ ফড়সধরহং) বিষয়ে যে ধারণা পাই, সেটাই আসলে আমাদের উপরি পাওয়া, অতিরিক্ত লাভ। অন্য বইএর মধ্যে সাহিত্যের কুশীলবদের নিয়ে লেখা তাঁর বইগুলিতে আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে লেখকেরচিন্তার বিস্তৃতিকে বুঝতে সাহায্য করে।
২.
পাঠক নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন শিরোনামে প্রবন্ধসমুচ্চয় না দিয়ে ‘সমুচ্চয়’ স্থলে ‘সমুচয়’ ব্যবহার করেছেন লেখক। ‘সমুচ্চয়’ই সর্বব্যবহৃত রূপ। বৌদ্ধ সাহিত্যে এটি একটি প্রচলিত একত্র শব্দ। নেপালে প্রাপ্ত একাদশ-দ্বাদশ শতকে সংকলিত ১১১ জন কবির কবিতাসংকলন সেই ‘কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়’ যেমন। ‘সমুচয়’ বাংলা অভিধানে অলভ্য নয়। ‘সমাহার’ অর্থে বিকল্প বা অমুখ্য শব্দ হিসাবে দেখানো হয়েছে বাংলা একাডেমির ‘ব্যবহারিক’ অভিধানে। লেখক শফিউল আলম এটিকে আধুনিক ব্যবহারে নিয়ে এসেছেন সাহসের সাথে। প্রবাদ যদি সত্য হয়, শুরুতেই এই পরিচয় ‘প্রভাতই দিনের সূচক’ বোঝাবে, আশা করি তা ‘মেঘডম্বরু’তে গড়াবে না । লেখকের আরও অনেক সাহস ও সত্যভাষণের সাক্ষ্য পাওয়া যাবে এই গ্রন্থে। গ্রন্থটি উৎসর্গও করা হয়েছে তাঁর সহপাঠী ইতিহাসবিদ ও গবেষক ড.মুনতাসির মামুনকে, ‘যার লেখায় স্হসিকতা ও অনমনীয়তা সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করে’।
গ্রন্থের ভূমিকা পাঠে বোঝা যায়, লেখক বাংলা বিভাগের ছাত্র। প্রথম জীবনে গল্প ও পরে কবিতায় হাত পাকিয়ে চাকুরি জীবনে প্রবেশ করেন। পেশাগত কারণে (জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড পাঠ্যপুস্তক বোর্ড-এ শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ হিসাবে ) গবেষণায় তাঁকে অধিক মনোযোগী হতে হয় স্বাভাবিক কারণেই। তিনি লেখেন,‘এ ভাবেই গল্প লেখা,কবিতা রচনার পথ থেকে সরে এসে বিভিন্ন সময়ের ব্যবধানে প্রবন্ধ লিখি শিক্ষা, ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে।’ কবিতা যায় হারিয়ে।
সৃজনশীলতা থেকে মননশীলতার এই রথারোহনের কথা ভেতরের প্রচ্ছদে প্রকাশকের বকলমেও উল্লিখিত আছে কিছ মূল্যায়নধর্মী কথার সাথে । ‘প্রবন্ধসমুচয় গ্রন্থে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক শফিউল আলম-এর উনচাল্লশটি [?] প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে।… ষাটের দশকের একজন সৃজনশীল লেখক তিনি। পরবর্তি সময়ে তিনি গল্প কবিতা থেকে ক্রমেক্রমে গদ্যের ও গবেষণামূলক প্রবন্ধের জগতে স্থিত হয়েছেন। … প্রবন্ধসমুচয় শুধু একটি প্রবন্ধ-সংকলন নয়, এতে রয়েছে অধ্যাপক শফিউল আলমের গবেষণামূলক লেখার প্রতিকৃতি ও ব্যক্তিগত অনুষঙ্গের লেখা। … প্রথাবদ্ধ প্রবন্ধের বাইরে (শফিউল)আলমের লেখায় রয়েছে গদ্যভাষার এক নিটোল সৌকর্য।’
ধ্রুব এষের আঁকা প্রচ্ছদে ৩৫০ পৃষ্ঠার বই। পেছনের প্রচ্ছদে লেখকের জন্ম,শিক্ষা, গ্রন্থতালিকা এবং প্রাপ্ত পুরস্কার ও পদকের তালিকা এবং দুই পাশে মোটা লাল পুস্তানিতে ও মোটা বোর্ডে বাঁধাই করা বইটি বেশ দৃষ্টিনন্দিত। চার বা ততোধিক ধরনের আলোচনায় রচনাগুলি (কথিত ৩৯টি না ৪৯টি?) ঋদ্ধ। ভেতরের মূল শিরোনামী পৃষ্ঠায় উপশিরোনামে বলা আছে- ‘প্রসঙ্গ: ভাষা শিক্ষা সাহিত্য সংস্কৃতি গবেষণা ও ব্যক্তিগত অনুষঙ্গ’। আসলে মুক্তিযুদ্ধ, সাংবাদিকতা ও অন্য আরও কিছু প্রসঙ্গও এসে গেছে এর মধ্যে। তবে তাঁর ‘শিক্ষা’ বাদে অন্যান্যভাগের রচনার সংখ্যাগত গুরুত্ব থাকলেও বইটির প্রকৃত মূল্য শিক্ষা বিষয়ক রচনাগুলিতে, যার সংখ্যাাও কম নয়,- বিশোর্দ্ধ; যদিও মোট প্রবন্ধের ন্যূনার্দ্ধেক। কিন্তু লেখকের বিশেষজ্ঞতা এই শিক্ষা বিষয়েই। প্রধানত এই বিষয়টাকে প্রধান্য দিয়েই এখানে বিশেষভাবে বলতে চাই।
৩.
গ্রন্থমধ্যে মূল বা মৌলিকভাবে ও নানা অনুষঙ্গ মিলিয়ে মোট একুশটি রচনা আছে শিক্ষা বিষয়ে। শিক্ষার নানা দিক ও সমস্যা নিয়ে নানা উপবিভাগে নানা শিরোনামে বিভক্ত করে লেখক সেগুলি আলোচনা করেছেন। যেমন,- শিক্ষা পরিস্থিতি, সাক্ষরতা, প্রাথমিক শিক্ষা, শিক্ষা কমিটি, শিক্ষা-নীতি, শিক্ষাবিদ-সাহিত্যিক, বিশেষভাবে আবুল ফজল, জীবনানন্দ দাশ, রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাভাবনা, নারীর শিক্ষা, শিক্ষাক্রম প্রভৃতি- অর্থাৎ শিক্ষার নানা ক্ষেত্রে আলোচনাগুলি বিস্তৃত কিংবা খননিত। পাকিস্তান সৃষ্টির পর মৌলানা আকরাম খাঁর নেতুত্বে গঠিত কমিটি ঠিকই উপলব্ধি করেছিলো.পূর্ববঙ্গের শিক্ষাব্যবন্থা ছিল ‘উদ্দেশ্যহীন’, দওসনধষধহপবফ’ এবং ‘নতুন রাষ্ট্রের পক্ষে প্রয়োজন রহিত’। নতুন ব্যবস্থায় ১১+ এবং ১৪+বয়সী ছাত্রদের দুই পর্যায়ে এবং ৪র্থ শ্রেণীর পরিবর্তে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাইমারি, ৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকে জুনিয়র সেকে-ারি ও ৯ম থেকে স্কুলের ওপরের ক্লাশগুলোকে সিনিয়র সেকে-াারিতে বিভক্ত করার পরিকল্পনা করা হয়। সেই সাথে আকরাম খাঁর রিপোর্টে একটা অতিরিক্ত ‘স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ’ পড়াবার অর্থাৎ ‘থ্রি ল্যাঙ্গুয়েজ ফর্মুলা’ অনুসরণেরও সুপারিশ ছিল, কার্যত যা ছিল দ৪ খধহমঁধমব ঋড়ৎসঁষধ’। খধহমঁধমব খড়ধফ ও চবফধমড়মরপ দিকগুলির সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনায় রাখা হয় নি তাতে। [স্বাধীনতার পরও (১৯৭৪) তৎকালীন মাধ্যমিক শিক্ষাকে বলা হয়েছিলো ‘ধরসষবংং’।] কিন্তু পূর্বে ‘স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ’-এ যে শুভঙ্করীর ফাঁক ছিল, অর্থাৎ পূর্ববাংলায় যখন (’৬২-র আন্দোলন পর্যন্ত) ছাত্ররা ‘তোম হামার ভৈঁস কো কিউ ডান্ডা মারা?’ / ‘তোমারা ভৈঁস হামারা সবজি খা লেয়া?’ পড়তো, তখন করাচি-লাহোরে রবীন্দ্র-নজরুল আবশ্যিক পাঠের অন্তর্ভুক্ত ছিল কিনা জানা যায় নি। আকরাম খাঁর রিপোর্ট প্রকাশ পায় ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের পর। পাকিস্তানের উভয় প্রদেশের জন্য ছিল তা ‘ইনটেন্ডেট’। কিন্তু কেন্দ্রিয়ভাবে সেই সদিচ্ছার পূরণ ঘটেছিল কি? শিক্ষাক্ষেত্রে সেদিনের সেই সব সমস্যার এবং উদ্ভুত পরিস্থিাতর কারণেই আজকের শিক্ষ-বিশেষজ্ঞগণকে এত বিচিত্র বিষয় নিয়ে ভাবতে হচ্ছে।
কুদরত-এ খুদা (বা ‘কুদরাত-এ-খুদা’)-রিপোর্টের পূর্বে পুরণো ঐতিহ্যধারার পাঠক্রম এবং অনুশীলনহীন পাঠ ও সনাতন প্রশ্নকরণ রীতি (‘স্ট্রাকচার্ড কোশ্চেন’) এবং শাসকগোষ্ঠির উদ্দেশ্যসাধনের (বাংলাকে মাধ্যম করে জ্ঞানরাজ্যে প্রবেশের ও সর্বস্তরে বাংলা ব্যবহারের নিশ্চয়তা দান নয়, বরং ঔপনিবেশিক শাসনের আনুকূল্য মাতৃভাষার অপ্রিয়তা ও অহিতি সাধন) ষড়যন্ত্রই আজকের ‘শিক্ষা’র আপতন রূপ সৃষ্টি করেছে। শিক্ষার প্রতিটি স্তরে ও ক্ষেত্র বা ‘ডোমেন’-এ তার ফলাফল আমরা কি পেয়েছি এবং আজ আমাদের করণীয় কী, এসব নিয়ে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণে লেখকের মুক্ত আলোচনা লক্ষ্য করি আমরা এ গ্রন্থে।
শিক্ষা জাতির মেরুদ-। শিক্ষা ছাড়া জাতি গড়া যায় না । জাতির উন্নতি অসম্ভব যদি না সে শিক্ষিত হয়। ভাষা ছাড়া শেখার পথই বা কই? শিক্ষা-মূলে চাই ভাষানীতি। (স্তরভিত্তিতে ভাষা-নির্ধারণ-নীতি যেমন, শিক্ষার স্তরে বয়স ও শ্রেণী ভিত্তিতে ভাষা-মান নির্ধারণ অর্থাৎ, শেখার কোন স্তরের জন্য কোন ভাষা উপযোগী, ইত্যাদি স্থির করা এবং শিক্ষাদান ও পরীক্ষণের ক্ষেত্রে কোন লক্ষ্যে পৌঁছুবার জন্যে কোন পদ্ধতি ও নীতি অনুসরণ করা হবে সে সব নির্দিষ্ট করা।) ভাষানীতি আর শিক্ষানীতি পরষ্পর সংলগ্ন। ভাষা দিয়ে শিক্ষা, আর শিক্ষা দিয়ে জাতি। পৃথিবীতে অনেক উন্নত ভাষা আছে। কিন্তু নিজের ভাষা নিজেকেই উন্নত ও উপযোগী করে নিতে হয়। ধার করা ভাষায় শিক্ষা লাভ হয় না। চাই অন্তরের ভাষা, মাতৃভাষা তার নাম। মা বোবা হলেও শিশু মায়ের অক্ষমতাকে অনুসরণ করে না, মায়ের চারি পাশে ছড়িয়ে থাকা শক্তিকে অর্জন করে। সেটা করে সামাজিক সূত্রে। ঢ়ববৎ মৎড়ঁঢ় ষধহমঁধমব যেমন এর বিকল্প, যা সড়ঃযবৎরহম তথা থেরাপির কাজ করে। সুস্থ ও অনুকূল পরিবেশ শিশুর সম্ভাবনাকে অপার করে দেয়। লেখক তাই বলেন, ‘বাংলা ভাষার একাধারে মাতৃভাষা, রাষ্ট্রভাষা, জাতীয় ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যমের ভাষা- এই বহু মাত্রিক রূপ রয়েছে তার, তবু তার জন্য কোনো ভাষানীতি বা ষধহমঁধমব ঢ়ড়ষরপু তৈরি হয় নি বা তার প্রয়োজনও সে ভাবে উঠে আসে নি।’ মাতৃভাষা শেখার জন্য আবার ওসবের কী দরকার! এটা সাধারণের ধারণা হতে পারে, কিন্তু এর এক জায়গায় তার পরিণতিটার ইঙ্গিত করেছেন তিনি রবীন্দ্রনাথের ‘তোতা কাহিনী’র উল্লেখ করে,- বলেছেন, শেষে তোতা শুধু নিজেই মরে না, তাতে শিক্ষকেরও ভবলীলা সাঙ্গ হয়। এজন্য এ গ্রন্থে শফিউল আলম তাঁর নিজস্ব কোনও মত নয়, বরং রবীন্দ্রনাথসহ অন্যান্য সৃষ্টিশীল কবি সাহিত্যিদের মতবাদ বা ধারণাগুলি তিনি সামনে নিয়ে এসেছেন। যেমন রবীন্দ্রপূর্ব কালের (উদাহরণত মধুসূদনের ‘শিক্ষিত মা’ তথা ‘এডুকেটেড নার্স’ কর্ত্তৃক প্রদত্ত শিক্ষা পদ্ধতির কথা) বা উত্তর কালের বুদ্ধিজীবীদের মতামতগুলি (যার অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদাহরণ কাজীনজরুলের এবং জীবনানন্দ দাশ প্রমুখের শিক্ষাবিষয়ক ধারণা বা চিন্তা) সংগ্রহ ও তার বিশ্লেষণ করেছেন। এইভাবে শিক্ষাকমিশনকৃত দশকভিত্তিকভাবে ‘পুরনো শিক্ষার পরিবর্তে আপাতত নতুন শিক্ষা’ নয়, বরং ‘ঠিকভাবে হয়ে ওঠার শিক্ষা’-লাভের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি এবং ছাত্র-প্রীতিবোধের শিক্ষার প্রসঙ্গগুলি সবিস্তারে উল্লেখ করেছেন লেখক তাঁর নানা প্রবন্ধে।
নজরুলের শিক্ষা-চিন্তা (‘সত্য শিক্ষা’, ‘জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়’ প্রভৃতি প্রবন্ধে,এবং ‘ছাত্রদলের গান’ প্রভৃতি রচনায়) নিয়ে নানা কথা থাকলেও তাঁর শিক্ষা-ভাবনা নিয়ে কারও কোনও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা দেখা যায় না অন্য কোথাও। এর কারণ তাঁর সৃষ্টির অবিশ^াস্য বাস্তবতা। বস্তুতকবি নজরুলের সৃষ্টিরহস্য বাংলা সাহিত্যের এক চিরবিস্ময়! সাধারণ্যে তাঁর শব্দব্যবহারের মাঝে যে পৌরুষ, দৃপ্ততা ও একই সাথে লালিত্য এবং ভাবসম্পদের ব্যাপারেও যে রোমান্টিক আহরণ ও পাশাপাশি ক্ষোভময় ইন্দ্রিয়তা এবং সৃষ্টির অজ¯্রতা নিয়ে কিংবদন্তির মতো যে অপার জাগরণের মহা কল্লোলী এক ফল্গুধারা উৎসারিত হয়, তার অনন্যতার দিকে তাকিয়ে, রবীন্দ্রনাথের প্রতি শরৎচন্দ্রের সেই ভাষায়ই বলতে হয়,-‘আজও বিস্ময়ের সীমা নাই’! কিন্তু তা যে কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি নয়, কোনও শিক্ষাগুরুর শিক্ষাবোধ থেকেও গড়ে ওঠে নি, তা বলাই বাহুল্য। দুই সংস্কৃতির মেল বন্ধন ছাড়াও ‘হিন্দু-মুসলিম ঐতিহ্যকে, কুরআন-পুরাণের বাণীকে ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ করে “বাঙালির জয় হোক” বলে প্রার্থনা করেছিলেন নজরুল।’ (শ.আ. ঐ, ১৯৩) তাঁর শিক্ষাচিন্তার ফসলস্বরূপ উল্লিখিত রচনাগুলিতে স্বকীয় (‘কাব্যিকতা মেশানো’) ভাষার মধ্যেও আশ্চর্য বলিষ্ঠতা ও জাতীয়তাবোধের প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। তাঁর মূল কথা তাই পারষ্পরিক সম্প্রীতির ভিত্তিতে গড়ে ওঠা শিক্ষাই মূল শিক্ষা। তিনি তার সাথে যোগ করে বলেন,‘আমরা চাই, আমাদের শিক্ষাপদ্ধতি এমন হউক, যাহা আমাদের জীবনী শক্তিকে ক্রমেই সজাগ, জীবন্ত করিয়া তুলিবে। যে-শিক্ষা ছেলেদের দেহ-মন দুইকেই পুষ্ট করে, তাহাই হইবে আমাদের শিক্ষা।’ ‘মেদা-মারা’ আর ‘ডানপিটে’ ছেলের তুলনা করে তিনি বলেন, ‘প্রাণশক্তি আর বর্ণশক্তিকে একীভূত করাই যেন আমাদের শিক্ষার বা জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হয়।’ (শ.আ. ঐ, ২০৩) , ২০৩) ‘জাতীয় শিক্ষা’ প্রবন্ধে তাঁর দার্ঢ্য উচ্চারণ ছিল, ‘শুধু চরকা দিয়া সূতা কাটানো ছাড়া এ ন্যাশনাল বিদ্যালয়ে তেমন কিছ নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করা হয় নাই, যাহা সম্পূর্ণরূপে আমাদের দেশের ছেলেদের মনের বা এ দেশের আবহাওয়ার উপযোগী।’
শিক্ষা সম্পর্কে এর থেকে তীব্র কথা বা বাস্তব কথা সমকালে বা এর পরেও এত শক্তভাবে আর কেউ বলেছেন বলে আমাদের জানা নেই।
শিক্ষা এক সময় ছিল রাজবাটিতে প-িতের সদয় পদস্থাপনের এবং বা ‘ঋষি আশ্রমে’ শিক্ষার্থীদের সবিনয় অবস্থানের বিষয় । প্লেটো-এরিস্টটলদের চেষ্টায় তা হলো শিক্ষালয়ের বিষয় (‘একাডেমি’, ‘লাইসিয়াম’ প্রভৃতি) এবং ভারতে বৌদ্ধ আমলে বিহার, হিন্দু আমলে (গোড়ায় ব্রিটিশ আমলেও) গ্রামপ-িত-দাঁড়াপ-িত এবং টোল-চতুষ্পাঠি-পাঠশালার ব্যবস্থা, মুসলমানদের মাদ্রাসা (মেয়েদের ভিন্ন ব্যবস্থাসহ), খ্রিস্টানদের গীর্জা প্রভৃতি। এই ছিল শিক্ষার ইতিহাস। কোনও পর্যায়ে বেত্রদ- এসে তার আবশ্যকীয় সাথী হয় । ব্রাহ্মসমাজে এ বিষয়ে প্রথম কথা ওঠে।
শিক্ষা তথা জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা সাধারণ বিষয় নয়, যথেষ্ট কঠিন ব্যাপার। ভাষা তো একটা বিষয় আছেই, এর বাইরেও আছে আরও নানা সর্বেশ^রতা বা ‘ যবমবসড়হু’ । আমাদের ‘শিক্ষাব্যবস্থা’টা বৃটিশ লিগেসির জের। জীবনানন্দ দাশ দুটো কথা স্প্ষ্ট করেই বলে গেছেন, ‘ইংরেজরা দেশ শাসন এবং ভাগ করতেই এসেছিল, দেশী লোকদের সংষ্কার ও শিক্ষা সম্বন্ধে চিন্তা করার জন্য নয় ।’ (এবং) ‘দেশের শিক্ষার প্রতিও আমাদের স্বাধীন দেশের কর্তৃপক্ষের ভাবগতি বিশেষ স্পষ্ট নয় ।’ (শ.আ.,ঐ-পৃ. ২৭৬) অবশ্য শফিউল আলম ঠিকই ধরেছেন যে, কবি ‘ইংরেজ বিদ্বেষ’ আর ‘ইংরেজি ভাষাবিদ্বেষ’কে এক করে দেখতেন না বা ভাবতেনও না। ‘ইংরেজি ভাষাশিক্ষা’র সুফল নিয়ে তাঁর মনে কোনও দ্বিধা ছিল না। (তবে এটা বলতেন, ‘লিটারেচার ভিত্তিক বা ওরিয়েন্টেড’ শিক্ষাটা ‘নির্বাচিত ছাত্রদের জন্য হলেই ভালো’। তিনি দষধহমঁধমব নধংবফ’ শিক্ষার পক্ষাপাতী ছিলেন এত আগেই. এটা ভাবতে অবাক লাগে। কবি শিক্ষার বিদ্যমান পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে এও বলেছিলেন যে, ‘চারিদিকের অবস্থা যখন এ রকম, …তখন দেশ ও রাজ্যের চালক ও শিক্ষানায়কদের দেশের স্কুল-কলেজ-ইঊনিভার্সিটির আগাগোড়া শিক্ষাব্যবস্থা ও ছাত্র-শিক্ষকদের অবস্থা ও পরিণাম সম্বন্ধে ভাল করে ভেবে দেখে তাড়াতাড়ি কাজে অগ্রসর হওয়া দরকার বলে বোধ হচ্ছে।’(ঐ)
উল্লেখ রাখা যায়, প্লেটো থেকে কুইন্টিলিয়ন কিংবা ইবনে খালদুন থেকে একালের জাঁ জ্যাক রুশো কিংবা বার্ট্রান্ড রাসেল সকলেই জ্ঞানার্জনে শিশুর সৃজনীশক্তির বিকাশের দিকেই লক্ষ্য রাখতে বলেছেন । শিক্ষাদাতার চেয়ে শিশুর নিজস্ব সামর্থ্য ও সম্ভাবনার দিকে অধিক মনোযোগী হওয়াতেই যে শিক্ষার উপযোগিতা, তাঁদের শিক্ষাচিন্তার মূল প্রতিপাদ্য ছিল সেটাই। রুশো তো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষারই বিরোধী। এঁদের শিক্ষাদান-প্রণালীর সাথে রবীন্দ্র চিন্তার একটা গভীর মিল দেখা যায়। রবীন্দ্র-প্রসঙ্গী আলোচনাতে শফিউল আলমও দেখিয়েছেন যে, রবীন্দ্রনাথের বাল্যকালের দু:খই তাঁকে ‘শান্তিনিকেতন’ পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেছে। তাঁর শিক্ষাচিন্তায় তাই তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার কথাই অধিক স্ফুট। আমাদের শিক্ষার মুখস্ত ব্যবস্থায় ও বেত্রদ–শিক্ষানীতিতে যেমন শিশুদের আগ্রহান্বিত করে তোলার এবং শিক্ষায় আনন্দ লাভের কোনও ব্যবস্থা থাকতো না, তা তোতা পাখির দানা গিলে বাঁচার মতো হতো, তেমনি আর এক ট্রাজেডির দিক ছিলো তার ‘হেরফের’ অর্থাৎ নুন আনতে পান্তা ফুরাবার অবস্থা। গ্রীষ্মের ব্যবস্থার যোগান দিতে দিতেই শীতের কাতরতায় ভোগার অবস্থায় উপনীত হওয়া। এবং ভাইসভার্সা, মানে উল্টোটাও। উচ্চশিক্ষা সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, দোতালায় তুলে সিঁড়ি নামিয়ে নেওয়ার মতো। কবির এ সব কথা নিছক তত্ত্বই ছিল না। তিনি যে ১৯০১-০৬ সালের মধ্যে তৎকালীন শুষ্ক ‘গ্রামার-ট্রান্সলেশন’ পদ্ধতি থেকে অগ্রসরশীল ও বিদেশে প্রচলিত ‘ডিরেক্ট মেথডে’ না হলেও প্রায় একই পদ্ধতিতে ও ‘ড্রিলে’র ধারণা নিয়ে ‘গ্রুপ ওয়ার্ক’-এর নীতিতে নিজস্ব উদ্ভাবিত ধারায় ‘ইংরেজি সোপান’ বা ‘ইংরেজি সহজ শিক্ষা’-র একাধিক খ- ও ভাগ রচনা করেন এবং এই পদ্ধতির সাফল্য বাংলায় পরীক্ষা করার জন্য যে উনসত্তর বছর বয়সে (১৯৩০-এ) ‘সহজ পাঠ’ ও তার একাধিক ভাগ রচনা করেছিলেন, সে শুধু পাঠ্য বই রচনার জন্যই নয়, তাঁর নিজস্ব শিক্ষা-তত্ত্বটি বোঝাবার জন্য এবং শিশুদের সেই ধারায় গড়ে তোলার জন্যও বটে। সেটা কি? রবীন্দ্র-পাঠদানের একটা প্রধান বিষয় ছিল ছুটি এবং প্রকৃতিকে উপভোগ। রবীন্দ্রনাথ চাইতেন শিক্ষাকে দৈহিক শাস্তিপ্রদানের বিষয় থেকে মুক্ত করে ‘আনন্দের বিষয়’ করে তুলতে হবে এবং শিক্ষকের দায়িত্ব হতে হবে শিক্ষার্থীকে শিক্ষায় আগ্রহী করে তোলা। এখানে তাঁর শান্তিনিকেতনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠার পটভূমিটাও লক্ষ্য করা দরকার। সরকার (বৃটিশ) স্বদেশী আন্দেলনের কালে শিক্ষাসচিব মি.কার্লাইলের মাধ্যমে ছাত্রদমনের সার্কুলার দিয়ে (অক্টোবর ১৯০৫) ছাত্রদেরকে এই আন্দোলন থেকে দূরে সরাবার চেষ্টায় লিপ্ত হলে ব্যরিস্টার আবদুল রসুল ‘স্বাধীন জাতীয় শিক্ষা’র আন্দোলনে ডাক দেন। এই সময় রবীন্দ্রনাথ ‘শিক্ষা সমস্যা’, ‘শিক্ষা সংস্কার’, ‘জাতীয় বিদ্যালয়’ প্রভৃতি প্রবন্ধ রচনা করেন। এই আন্দোলন স্তি¥মিত হয়ে পুনরায় খিলাফত আন্দোলনে রূপ নিলে বাংল সহ সারা ভারতে বহু জাতীয় শিক্ষালয় স্থাপিত হওয়া শুরু হয়। নজরুলের দাপটি ভূমিকা ছিল এই সময়ে (১৯২১-২২)। জীবনের স্বাধীনতা ও সংগীতের সাধনার মত একাগ্রতা ও তপঃসুখানুভবতা শিক্ষায় একীভূত হলে তবেই শিক্ষার পূর্ণতা; এই উপলব্ধি তাঁর সৃষ্টিমূলেও প্রেরণা জুগিয়েছে।তখন জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া যেমন প্রতিষ্ঠিত হয়, তেমনি শান্তিনিকেতনের ্িবশ^ভারতী হওয়ার কালও এটাই। সরকারী বনাম জাতীয় শিক্ষার ধারণা থেকে শিক্ষার নানা রূপ নিয়ে বাঙালিদের এই ভাবনার বিকাশ ক্ষেত্রে ২২বছরের তরুণ নজরুলের এই চিন্তাকে সাধারণ ভাবা যায় না। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা সংস্কার চিন্তারও এটাই প্রাইম কাল। কলিকাতা বিশ^বিদ্যালয় এবং ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় প্রভৃতি স্থানে তাঁর ভাষণের বিষয়গুলি (‘আকাক্সক্ষা’ প্রভৃতি রচনা) লক্ষ্য করলেই তা বোঝা যায়। রবীন্দ্রনাথ যে একাধারে শিক্ষক, শিক্ষা-সংগঠক, শিক্ষা-দার্শনিক বা শিক্ষাচিন্তাবিদ তা এখানে স্পষ্টতই অনুভূত হয়। বোঝা যায়, যে শিক্ষায় তাঁর মনোযোগ তা আপনার বিদ্রোহজাত, তেমনি একইসাথে তা এক শিক্ষাদর্শ প্রদর্শনের এবং নিজস্ব কর্মযজ্ঞের কারণেও। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ শুধু ভাবের পথিকই ছিলেন না, ছিলেন প্রয়োগবাদীও ।
৪.
শিক্ষা-নীতির বিষয়ে কর্ত্তৃপক্ষ যে একেবারে অজ্ঞ বা উদাসীন, তা নয়, তবে ঐচ্ছিক বা বিকল্প ধারণাগুলিকে অপসৃত করে নয়। দরকার যেখানে শিক্ষার একমুখিনতা, দেখা যায় ‘দ্বিমুখী’ শিক্ষা (কিন্ডারগার্ডেন বা ইংরেজির মাধ্যমে বিদেশী শিক্ষার ভাব সংরক্ষণসহ) ও ভাষা-মাধ্যম রূপে ‘দ্বিমুখী’ ভাষারীতিরই সেখানে প্রাধান্য (সাধু/চলিত : ভাষা ব্যবহারে ভাষা রীতির দ্বৈধতা!)। এসব ক্ষেত্রে শফিউল আলমের সমালোচনা যথার্থ। তিনি উল্লেখ করেন,
ভাষা সৃষ্টি হয় শিল্পীর হাতে, প্রয়োজনের বাস্তবতা ও চিত্তের স্ফূর্তি তথা অনন্দ মিলিয়ে তার সম্পূর্ণতা; তবে ভাষা প্রয়োগে সমাজ ভেদে পার্থক্য ঘটে। এর পেছনে থাকে শ্রেণীস্বার্থের সম্পৃক্ততা (পৃ.১৫)। ঈশ^গুপ্ত এই জন্যই বলতে বাধ্য হন, ‘দেশের ভাষার প্রতি সকলের দ্বেষ’। কিন্তু ভাষায় জনসম্পৃক্ততা দুর্বল হয়ে উঠলে ‘প্রতিরোধ’ (১৪-১৫) ওতো আপনিই গড়ে ওঠে! লেখক উদ্ধৃতি দিয়ে ধরিয়ে দিয়েছেন যে, আঠারো শতকের আবদুল হাকিম, উনিশ শতকের ঈশ^রগুপ্ত বা বিশ শতকের ’৫২-র আন্দোলন তারই প্রমাণ। আজ সেটাই ‘নানা মাত্রায় পল্লবিত’। ‘স্বাধিকার ও স্বধীনতাচিন্তায়, নিজস্ব সংস্কৃতির বিকাশ ও ভাষাকেন্দ্রিক বাঙালি জাতিয়তাবাদের প্রখরতর উন্মোচনের দিকে ’ এর সেই গতি আজ আর অস্পষ্ট নয়। এই ‘প্রতিরোধ তত্ত্বের’কথাউল্লেখের পেছনে লেখকের বার্তা একটাই যে, তার অন্তর্বাহী শক্তিটির কথা ভাষা ও শিক্ষা-পরিকল্পকেরা ভুলে যান। সাধারণ মানুষ কোথায় ভাষার কোন ব্যবহার চায়, কোন ব্যবহারে তার পরিতৃপ্তি, কল্যাণ এবং উন্নতি, তাবুঝে বা না বুঝে আপনার ছখেয়াল চাপিয়ে দেয় ভোক্তাদের ওপর। ভাষা যেমন জীবনের চিত্র, যে জন্য তা জীবনের প্রয়োজন সাধন করে, তেমনি তা মন ও চিন্তারও ঐক্যরূপ বা সমীকরণ স্বরূপ। ভাষার সার্থক ¯্রষ্টা ও ব্যবহারকারীরা ভাষাকে প্রয়োজনেই শুধু নয়, জীবনের উপলব্ধি ও তাকে সহনীয় করার আনন্দেও গ্রহণ করে এবং প্রয়োগে উৎসাহিত করে। শফিউল আলম অতি চমৎকার ভাবে কথাটা বলেছেন যে, ‘চ-ীদাস তাঁর ভাষায় যে আবেশ ও রূপজগৎ সৃষ্টি করেন, সেখানে আমরা সমর্পিতা প্রেমিকার ন্যায়।’(১৯) এ দেশে এক সময় চাপাতে চেষ্টা করা হয়েছিল উর্দু, রোমান হরফ, সওজা বাংলা- এই সব; এখন প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে ‘বেংলিশে’র ব্যবহারে এবং এসেমেস (এসএমএস)-বাংলার লিখন প্রণালীতে। লেখক দেখিয়েছেন, এক সময় এ দেশের ভাষা ব্যবহারটি ছিল ‘এক বিশেষ (পাকি) আদর্শে প্রণোদিত’, এখনও আদর্শটা বদলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। তা হয়েছেও অন্য রকম, হয়তো বহু রকম। নির্দিষ্ট ভাষা-নীতি এবং শিক্ষা-নীতির অভাবেই তা অনুকরণ করছে কৃত্তিম, মিশ্র, উর্দু-স্থানীয় ও বিকল্পী হিন্দি-মিশ্র এবং তদুপরি ‘বেংলিশ’ তো আছেই। লেখকের (শ.আ.) বিভিন্ন প্রবন্ধে এই বক্তব্যগুলি ছড়ানোথাকলেও পাঠকের তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। তিনি শিক্ষা-প্রেমি ছিলেন বলেই শিক্ষার এই বিচিত্র অবস্খা [তথা দূরবস্থা)র চিত্র তাঁর আলোচনায় আন্তরিকতার সাথে উঠে এসেছে, সে আলোচনায় ঘটেছে, জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের ভাষায়, ‘মননশীলতা ও রসবোধের স্বাক্ষর’। অবসর জীবনেওশিক্ষা-নীতির অভাব-চিন্তা তাঁকে সক্রিয়তা থেকে দূরে রাখতে পারে নি। তিনি শিক্ষক ও শিক্ষাবিদ দুই ছিলেন । সাহিত্যিক শওকত আলী তাঁর প্রকৃতি নিয়ে বলতে গিয়ে যে মন্তব্যটি করেন সেটিই বোধ হয় তাঁর যথার্থ মূল্যায়ন। তিনি বলেন, ‘ জগন্নাথ কলেজে শিক্ষকদের মধ্যে তখন দুটি ধারা বহমান ছিল । এক দল যাঁরা পদোন্নতি বা ঢাকায় থাকার জন্য এ কলেজে আসতেন, অন্যদল যাঁরা এ কলেজের ঐতিহ্য অক্ষুণœ রেখে একাত্ম হয়ে পাঠদান ও কলেজের অন্যান্য কাজে সম্পৃক্ত করতেন। শফিউল আলম ছিলেন শেষোক্ত দলের। এ কারণে তিনি কলেজের অনেক প্রবীণ শিক্ষকের ¯েœহানুকূল্য পেয়েছিলেন।’ মানুষ হিসাবেও তাঁর গুণাবলী কেমন ছিল আনিসুজ্জামানের এক শুভেচ্ছা বাণীতে তার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়।
শিক্ষা মানুষকে পূর্ণ করে । শিক্ষানুরাগী অধ্যাপক ও গবেষক শফিউল আলম আজ যাকে বলে ‘অন দা রং সাইড অফ সেভেন্টি ফাইভ’; জীবনের প্রান্ত ছুঁয়ে আয়ুর শেষ কড়ি গুণছেন (জন্ম ১৯৪৩)। কিন্তু উচ্ছলতা, আনিসুজ্জামানের ভাষায় জীবনের সক্রিয়তা হারান নি। তাঁর শেষ জীবনের গ্রন্থ ‘প্রবন্ধ সমু”য়’ প্রকাশের মধ্যে একটা সুসম্পূর্ণ জীবনের আকুতির প্রয়াস লক্ষ্য করে আমরা তাই বিস্মিত হই। তিনি যা দিয়ে গেলেন, তা শুধু শিক্ষাচিন্তার ফসল নয়, কালের এক অনুধ্যেয় স্বপ্ন। তার বাস্তবায়নের মধ্যে আগামীতেও তিনি বেঁচে থাকবেন।
রচনা : রবিবার, এপ্রিল ২১, ২০১৯

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট