চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

চিনুয়া আচেবে

আত্মশুদ্ধির আলোকিত পৈঠায়

রুখসানা কাজল

৩ মে, ২০১৯ | ১:২৩ পূর্বাহ্ণ

নাইজেরিয়ার ইগবো সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি উপকথা বেশ প্রচলিত ছিল এরকম ভাবে, মানুষ একবার ভেবেছিল যে তারা ঈশ্বরের কাছে অমরত্ম চাইবে। কিন্তু তাদের হয়ে কে যাবে ঈশ্বরের কাছে এই অমরত্ম চাইবার ইচ্ছার কথা নিয়ে? তখন তারা একটি কুকুরকে শিখিয়ে পড়িয়ে ঈশ্বরের কাছে রওয়ানা করিয়ে দিল। কুকুরের মত বন্ধু তো আর কেউ নয় মানুষের! একটি কুচুটে ব্যাঙ মানুষের এই গোপন ইচ্ছার কথা কি করে যেন জেনে যায়। কুকুরের আগেই সে ঈশ্বরের কাছে পৌঁছে যায়। গদগদ চিত্তে সে ঈশ্বরের কাছে জানায়, প্রভু মানুষ তাকে বিশেষ বার্তা দিয়ে আপনার কাছে নিবেদন পাঠিয়েছে। ঈশ্বর সদাশয়, মহাদয়ালু। জানতে চান, কি বার্তা বলে ফেল! তখন ব্যাঙ কূটনামি করে মিথ্যে বলে যে, বার্তাটি হচ্ছে, মৃত্যুর পরে মানুষ আর এই পৃথিবীতে ফিরে আসতে চায় না। ঈশ্বর বললেন তথাস্তু, মানুষের ইচ্ছাই পূর্ণ হবে।
এইরকম সময়ে কুকুর সেখানে পৌঁছে যায় এবং যথাযথ নম্রতায় মানুষের অমরত্মের ইচ্ছাকথা ঈশ্বরের কাছে নিবেদন করে। ঈশ্বর তথাগত কি করবেন তখন? তিনি ত কিছুতেই একটু আগে ব্যাঙকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ফিরিয়ে নিতে পারেন না। আবার কুকুরের নিবেদনের সত্যতাকে অস্বীকার করে ফেলেও দিতে পারেন না। তাই তিনি রহস্য রেখে কুকুরের নিবেদনকে গ্রহণ করে জানালেন, তথাস্তু। মানুষ পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারবে বটে তবে কিনা মনুষ্য রূপে নয়, অন্যান্য বিভিন্ন রূপ ধারণ করেই মানুষ এই পৃথিবীতে চিরকাল বেঁচে থাকবে।
আফ্রিকান সাহিত্যের দিকপাল লেখক আচেবে তার সাহিত্যে ইগবো সমাজের হাজারো প্রচলিত উপকথা থেকে এই উপকথাটিকে ব্যবহার করেছেন রূপক অর্থে। তিনি স্পষ্ট করে দেন ঈশ্বর এবং মানুষের মধ্যে ছদ্মবেশি সেই সব সহযোগী শক্তির লীলাময়তার কথা যারা কখনই মানুষের পক্ষ হয়ে থাকেনি এবং ঈশ্বরকেও মানুষের পক্ষে থাকতে দিতে চায়নি। যদিও ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যেকার সম্পর্ক অতুলনীয়। তবু মানুষের সতর্ক সাবধান থাকা প্রয়োজন। অনেক সময় ভুল নিবেদনের ফলে ঈশ্বরের দয়া থেকে মানুষ চিরতরে বঞ্চিত হয়। আসলে লেখক আচেবে এই উপকথাটি ব্যবহার করে বলতে চেয়েছেন শত বাঁধা অতিক্রম করে পুরুষ পুরুষানুক্রমে অর্জিত মানুষের ভাষা সংস্কৃতির মধ্যে যেন কোন বাঁধা সৃষ্টি না হয় । ভাষাকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করে মানুষ তার আত্মার বাণী উচ্চারণ করতে পারে। কিন্তু যখন ভাষার উপর খবরদারি করা হয় তখন সত্য ও সততা থেকে সরে এসে মানুষের কথা ভুলভাবে ভুল অর্থে উপস্থাপন করা হয়। ভাষার প্রতি এটি একটি একপেশে অবমান। এই উপকথাটির মাধ্যমে লেখক আচেবের মানসিক বুনিয়াদির এক অন্যমাত্রা দেখা যায় যা কিনা তাকে আফ্রিকান সাহিত্যের দিকপাল সন্মানে ভূষিত করেছে। উপকথাটির আড়ালে তিনি এটাই বুঝাতে চেয়েছেন যে একমাত্র তখনই সঠিক সত্য উপলব্ধি করা সম্ভব যখন মানুষ তার নিজের ভাষায় নিজের কথা বলে। অন্য কাউকে বা অন্যের উপর ভরসা করে নিজস্ব আত্মবাণী বা কথা বলা যতটা বিপদ সংকুলতারও বেশি ভয়ানক অবিশ্বাস আর ভুলে ভরা হতে পারে।
আচেবে তার যুগান্ত সৃষ্টিকারি বই, থিংস ফল এপার্ট এ আফ্রিকান সনাতন জীবনের অনবদ্য এক বাস্তব চিত্র এঁকেছেন। তিনি ঔপনিবেশিক যাঁতাকলে চুর্ণবিচুর্ণ অবাস্তব অসত্য আফ্রিকান সাহিত্য থেকে নিজের ভাষা, কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের গুণে সমাদৃত সত্যিকার আফ্রিকান সাহিত্যকে বিশ্ববাসীর কাছে মূর্ত করে তোলেন। পঞ্চাশ বছর আগের আবেগ দ্বারা রচিত বইটিতে তিনি এক সমৃদ্ধ আফ্রিকার উজ্জ্বল উদ্ধার করেছেন। পৃথিবীর পঞ্চাশটি ভাষায় এই বইটি অনুবাদ করা হয়েছে এবং দশ মিলিয়নেরও বেশি কপি বিক্রি হয়ে গেছে। পাঁচটি উপন্যাস, বেশ কিছু ছোট গল্প, কবিতা এবং প্রবন্ধ, বক্তৃতায় আচেবে অনবরত আফ্রিকার নিজস্ব সংস্কৃতির পক্ষে লাগাতার যুক্তি নির্ভর লেখা লিখে গেছেন। ইউরোপিয়ান লেখকদের ভাব, যুক্তি, দর্শনকে একেবারে অস্বীকার না করে এমনকি তিনি তার নিজস্ব ইগবো ভাষায় না লিখে ইংরেজি ভাষাকে অস্ত্র করে লিখেছেন আফ্রিকার সত্য ইতিহাস। আফ্রিকান মানুষের যাপিত জীবনযাত্রা এবং প্রাত্যহিক আফ্রিকান ঘটনাবলীর সত্য সঠিক চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন।
কথা প্রসঙ্গে এক সময় তিনি উচ্চারণ করেন যে, ইতিহাস জোর করে আমাদের কণ্ঠরোধ করে রেখেছে। তার দেশে বাস্তব রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং পরিবেশের জন্য অনেকগুলি মৌলিক ভাষা এবং পাঁচশতাধিক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাষা মিলেমিশে একটি আন্তর্জাতিক আবহ প্রতিষ্ঠা করেছিল। শৈল্পিক প্রয়োজনে আচেবের জন্য এটি ছিল একটি সহজ উপায় যার মাধ্যমে তিনি সংঘাতময় সভ্যতার একটি স্থায়ী ভাব প্রকাশ করতে পেরেছিলেন। ১৯৩০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার নাইজেরিয়া অঞ্চলের ইগবল্যান্ড দ্বীপে জন্ম হয় আচেবের। তার পুরো নাম ছিল আলবার্ট চিনুয়ালুমেগো আচেবে। । ইংল্যান্ডের ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়াকালীন সময়ে তিনি তার প্রথম নামটি বাদ দিয়ে দেন। আচেবের প্রথম জীবনী লেখক ঊুবহধিঙযধবঃড় জানান, তরুণ আচেবের উত্থান হয়েছিল একটি মিশ্র সাংস্কৃতিক পরিবেশের পারাপার থেকে। এই পারাপারের এক পারে ছিল তার খৃষ্ট ধর্ম গ্রহণকারী পিতামাতা আর অন্য পারে ছিল সনাতন ইগবো ধর্মে দীক্ষিত তার রক্তজ এবং ভালবাসার সম্পর্কযুক্ত বিশাল আত্মীয় স্বজন। তারা তাদের ধর্ম বিশ্বাসকে অবিকৃত রেখে ইগবো দেবতার “চি” র উদ্দেশ্যে পূজা ও প্রার্থনা করত। আচেবে এই অখ্রিস্ট্রীয় উদ্দাম সনাতন ধর্ম দ্বারা মুগ্ধ ও উজ্জীবিত ছিলেন । পরবর্তি বহতা জীবনে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, দূরত্ব মানে বিচ্ছেদ নয়। বরং সবার সাথে নতুন করে আবার সংযুক্ত হওয়ার এক মিলন সেতু। যেখানে দাঁড়িয়ে এক বিশাল স্থির ক্যানভাসে ধীরে ধীরে কৌতূহলী আবেগে অনায়াসে খুঁজে নেওয়া যায় স্বভূমি, স্বজন আর নিজের অতীতকে।
আচেবের পরিবারে সকলে যদিও ইগবো ভাষায় কথা বলত কিন্তু শিশু আচেবে আট বছর বয়েস থেকেই ইংরেজি ভাষায় পড়াশুনা শুরু করে। তাকে এমন একটি ইশকুলে ভর্তি করা হয় যেখানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের শিশুরা তাদের মাতৃভাষার বদলে উপনিবেশবাদী ঘরানায় ইংরেজিতে লিখতে পড়তে এমনকি ভাবতে শিখত। পরবর্তিতে আচেবে লিখেছেন, সেখানে তিনি প্রথম বুঝতে পারেন ঔপনিবেশিক শিল্প সাহিত্যে আফ্রিকান জনগোষ্ঠীকে কিভাবে কোন দৃষ্টিতে তুলে ধরা হয়েছে। বিভিন্নন খ্রিস্টান যাজক এবং বিখ্যাত ব্রিটিশ অভিযাত্রী জন বুচারের উপন্যাসে সাদা ও কালোর পার্থক্য সম্পর্কে স্পষ্ট করে ইংগিত করা হয়েছে। সুস্পষ্ট সুরেখায় বলা হয়েছে, সাদাদের উপর ঈশ্বরের অলৌকিক সুন্দর চমৎকার অনুগ্রহ রয়েছে। সুতরাং সাদারাই সুপার শক্তিতে সাহসী, জ্ঞানী, বুদ্ধিমান এবং যুক্তিশীল।
আচেবে সুস্পষ্ট উচ্চারণে মন খুলেই বলেছেন এই ধরণের লেখকদের বিনির্মিত আফ্রিকান সাহিত্য রচনার এই অসভ্যতাকে, ধূর্ততাকে, নির্বুদ্ধিতাকে তিনি ঘৃণা করেন। তিনি আরো লিখেছেন ইশকুলে পড়াকালীন সময়ে নিজেকে তিনি কখনো আফ্রিকান হিসেবে গড়ে নিতে পারেন নাই। কেননা সর্বদা সাদা এবং কালোর মধ্যেকার পার্থক্য তীক্ষèভাবে বুঝিয়ে দিয়ে তাদের সাদাদের অনুগামী হতে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। ভার্সিটিতে পড়াকালীন তিনি অ্যাংলো আইরিশ লেখক জেমস ক্যারি যিনি কিনা ঔপনিবেশিক অফিসার হিসাবে আফ্রিকায় কর্মরত ছিলেন তার লেখা একটি বই “মিস্টার জনসন ” দেখতে পান। যা কিনা টাইম পত্রিকার মতে আফ্রিকা সম্পর্কে বেস্ট উপন্যাস হিসেবে প্রচার পায়। সেখানে আফ্রিকানদের সম্পর্কে বলা হয়েছে তারা বাজে, কুচুটে, অলস, ইঁদুরের মত, অসভ্য,অচেতন অমানবিক স্বভাবের। আফ্রিকানরা এতোটাই অমানবিক যে তারা সভ্য সমাজের জন্য খুব বিপদজনক। লেখকের কল্পনার দৌড়ে পড়ুয়াদের কাছে কল্প কাহিনী হিসেবে প্রচুর আদৃত হলেও আচেবে বলেন আফ্রিকানদের উপর লেখকের এই আরোপিত নীচতা ছিল উদ্দেশ্যমূলক, সততাহীন সত্য মিথ্যার উপাদেয় খিচুড়ি।
এই অনুদার দৃষ্টিভঙ্গীর কারণে তিনি আফ্রিকান সাহিত্যের নৈতিকতা, সাহসিকতা ও বিশ্বাসকে তার সাহিত্যকর্মের সাথে সূচিবদ্ধ করে নেন। ১৯৫৮ সালে যখন তিনি নাইজেরিয়ান ব্রডকাস্টিং সার্ভিসে কাজ করতে শুরু করেন তখন তিনি থিংস ফল অ্যাপার্ট বইটি লিখতে শুরু করেন। বইটির পা-ুলিপি জমা দেওয়ার সময় প্রকাশক উইলিয়াম হেইনম্যান এবং প্রকাশনীর পরিচালক অ্যালান হিলের তাৎক্ষণিক প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল বিস্ময়করভাবে নেতিবাচক। তারা বিস্মিত কেননা কে চাইবে আফ্রিকান লেখকের বই কিনতে? বহতা সময় এই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিয়েছে। বিশ্বের ৫০ টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে বইটি। এক কোটির বেশি বই বিক্রি হয়েছে এবং ২০০৭ সালে এই বইয়ের জন্যে তিনি বুকার পুরস্কার লাভ করেন।
কিন্তু এই প্রতিক্রিয়া আফ্রিকান লেখকদের সম্পর্কে সম্পূর্র্ণ চিত্র ছিল না । আগের দশকেই থমাস টুটুলা এবং সাইপ্রাসের অধিবাসী ইকুয়েন্সির বই প্রকাশিত হয়েছিল। অনেকেই আগ্রহী ছিল এই লেখার বিষয়ে । তাছাড়া নাইজেরিয়ান আরো অনেকেই লেখালেখির সাথে যুক্ত ছিল। কিন্তু তাদের লেখায় চিন্তা চেতনায় ছিল ওইপনিবেশিক চিন্তা চেতনার বহিঃপ্রকাশ। আফ্রিকান স্বকীয়তার অভাব। তরুণ আচেবের লেখায় ভেসে উঠেছে এক নতুন আফ্রিকার পটভুমি। পুরনো ফ্রেমকাটা আরোপিত লেখাকে সম্যক সংঘর্ষের চ্যালেঞ্জ নিয়ে রচিত হয়েছিল ‘থিংস ফল অ্যাপার্ট’। ঔপনিবেশিক পালিত ভাবনার লেখকদের বিরুদ্ধে আফ্রিকা এবং আফ্রিকার মানুষদের সত্যিকারের জীবন, বেঁচে থাকা, তাদের নিজস্ব লালিত শিল্প সংস্কৃতি, জীবনবোধ নিয়ে এক বিধ্বংসী আঙুল তুলে ধরেছিল তরুণ লেখক চিনুয়া আচেবে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট