চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

সকল স্মৃতির ভার

সনজীব বড়–য়া

১৯ জুলাই, ২০১৯ | ১:১৯ পূর্বাহ্ণ

গান শান্তনুর নিত্য সঙ্গী। কবিতার গীতিরূপ দেয়ার যে ধারা বাংলা গানে বহমান, সেই স্রােতধারারই মাঝি শান্তনু। ওর গানগুলো শুনলে বুঝা যায়, কবি হিসেবেও শান্তনু সার্থক।
ওর শিল্পী জীবনকে ছাড়িয়ে ব্যক্তি জীবনের দিকে তাকালে সেখানেও দেখতে পাই এক সফল মানুষকে। কর্ম ও পারিবারিক উভয় জীবনেই সার্থক ও পরিপূর্ণ। সহধর্মিণী শুভ্রার শিল্পী সত্তার বিকাশে ওর সার্বিক সহযোগিতা অনুকরণীয়।

তখন দেশের নিদারুণ সংকটকাল। পঁচাত্তরের পনেরই আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে সপরিবারে। রাজনীতি প্রায় স্থবির। সংস্কৃতিকর্মীরা কিছু একটা করবার প্রেরণায় অস্থির। এরকমই একটা সময়ে কোতোয়ালি মোড়ের সাধুর দোকানের আড্ডায় মিলন দা’র মাধ্যমে শান্তনু বিশ^াসের সঙ্গে পরিচয়। এই আড্ডার উদ্যোগেই অজয়, খালিদ, শান্তনু, হেলাল ও আমাকে নিয়ে হলো সিডিএ ভবনের সামনের আইল্যান্ডে ছড়া পাঠের আসর। কবি স্বপন দত্ত নাম দিয়েছিলেন ‘পঞ্চ পা-বের ছড়া পাঠ’।
তারপর মিলন চৌধুরীর হাত ধরে আমি আর শান্তনু দু’জনেই গণায়নে। আমি তখন কলেজে পড়ি, শান্তনু উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে ঢাকায় টেক্সটাইল টেকনোলজি ইন্স্টিটিউটে পড়ছে। শান্তনু আমার চেয়ে প্রায় বছর আড়াই-তিনের বড়। জানি না কেন যেন ওকে দাদা ডাকিনি। একবার এ নিয়ে ও মিলনদাকে অভিযোগ করেছিলো। আমিও চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু হয়নি। বরং শান্তনু ‘শামু’ হয়েই রয়ে গেলো আমার কাছে।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় বড় ভাই অতনু বিশ^াসকে হারিয়েছিলো। কোলকাতায় গিয়ে মিলনদার সাথে যুক্ত হলো। কৈশোর উত্তীর্ণ সদ্য তরুণ শান্তনুকে বুকে জড়িয়ে নিলেন মিলনদা। গড়ে উঠলো বাংলাদেশ শিল্পী সংসদ। আশ্রয় মিললো নেতাজী সুভাষ বসুর সহোদর সুরেশ বসুর বাড়িতে। তাঁদের পরিবারের কৃতী কন্যা ললিতা বসু হলেন শিল্পী সংসদের প্রধান উৎসাহদাত্রী। দেশ মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত এই গানের দল বিভিন্ন জায়গায় গণসঙ্গীত গেয়ে বেড়ালো। সেই দলের কনিষ্ঠ সদস্য শান্তনু। এসব কথা মিলন দা আর শান্তনু’র মুখেই শোনা।
গণায়নে শান্তনুর অভিনয় সত্তার পাশাপাশি গায়ক সত্তারও বিকাশ ঘটলো। চর্যাপদের হরিণী, গফুর-আমিনা সংবাদ, যার দিন ফাগুনো দিন, একটি অবাস্তব গল্পে আমরা একসঙ্গে অভিনয় করলাম। সময়কাল ১৯৭৬। এই ছিয়াত্তর সালের শেষ দিকে চট্টগ্রামের লোকগাথা ‘আমিনা সোন্দরী’তে অভিনয়। সাতাত্তরে জাতীয় নাট্যোৎসবে অভিনয়, তারপর ‘অঙ্গন’ পর্ব।
অঙ্গন থিয়েটার ইউনিট ১৯৭৮ এর জানুয়ারিতে প্রতিষ্ঠিত হয়। মূল উদ্যোক্তা মিলন দা, শান্তনু ও আমি। কিছুদিনের মধ্যেই আমরা পেলাম ঢালী আল মামুন ও শিমুল বড়–য়াকে। এখানেই শুভ্রার অভিনয়ে হাতেখড়ি। অঙ্গনে আমরা পেলাম অভিনেতা শান্তনু’র পাশাপাশি নাট্যকার ও নির্দেশক শান্তনুকে। অঙ্গন প্রযোজনা করলো শান্তনুর লেখা কালো গোলাপের দেশ, দপ্তরী রাজদপ্তরে ও নবজন্ম। নবজন্ম শান্তনুর প্রথম নির্দেশিত নাটক। এরপর নতুন দলগঠন। ‘কালপুরুষ’ গঠন করে ১৯৮৩-তে ‘ইনফরমার’ নাটকটি রচনা করলো ও নির্দেশনা দিলো শান্তনু। তারপর জুলিয়াস সিজারের শেষ সাত দিন, মানুষ ও নিয়তি, মৃণালের চিঠি, নাট্যত্রয়ী ও সবশেষে নির্ভার নির্মাণ।
অভিনেতা হিসেবে শান্তনু বিশ^াসের অমিত সম্ভাবনার কথা কে না জানতো! আমরা যারা ওর সহঅভিনেতা ছিলাম, তারা বোধহয় সেটা আরও বেশি করে উপলব্ধি করতাম। নির্দেশক হিসেবেও ছিলো সুশৃঙ্খল আর নিখুঁত পূর্ণতার প্রত্যাশী। নাট্যকার হিসেবে ওর সুখ্যাতি চট্টগ্রামের গ-ী ছাড়িয়ে সারা দেশে। তরুণ বয়সের উন্মাদনা পেরিয়ে যখন পরিণত বয়সে পরিণত ভাবনার বয়ান পাবার কথা, তখনই শান্তনু চলে গেলো।
নাটকের ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ নাট্য পত্রিকা ‘প্রসেনিয়াম’ প্রকাশ। নাট্য বিষয়ক চিন্তা-ভাবনাকে গ্রন্থিত করে রাখার এ প্রয়াস শান্তনুর অন্যতম সৃজনশীল কর্ম। এ জন্যে নাটকের একজন কর্মী হিসেবে ওকে সাধুবাদ দিই।
গান শান্তনুর নিত্য সঙ্গী। কবিতার গীতিরূপ দেয়ার যে ধারা বাংলা গানে বহমান, সেই স্রােতধারারই মাঝি শান্তনু। ওর গানগুলো শুনলে বুঝা যায়, কবি হিসেবেও শান্তনু সার্থক।
ওর শিল্পী জীবনকে ছাড়িয়ে ব্যক্তি জীবনের দিকে তাকালে সেখানেও দেখতে পাই এক সফল মানুষকে। কর্ম ও পারিবারিক উভয় জীবনেই সার্থক ও পরিপূর্ণ। সহধর্মিণী শুভ্রার শিল্পী সত্তার বিকাশে ওর সার্বিক সহযোগিতা অনুকরণীয়।
এই ক্ষুদ্র পরিসরে শান্তনু’র সৃষ্টিশীলতাকে তুলে ধরা অসম্ভব, অসম্ভব ওর সঙ্গে আমার, আমাদের ব্যক্তি সম্পর্কের বিস্তারিত বয়ান। কতো আনন্দ-বেদনার, অভিমান-ভালোবাসার, কতো সুখ-দুঃখের স্বর্ণময় স্মৃতি আজ মনে পড়ছে। মনে পড়ছে প্রাত্যহিক আড্ডার কথা, রাত জেগে ওর নাটক কপি করার কথা। মেসো-মাসিমার (শান্তনুর বাবা-মা) ¯েœহের কথা। জুবিলী রোডের দোতলার বাসায় কতোদিন কেটেছে আমাদের। সেইসব উজ্জ্বল দিনের কথা, দল বেঁধে নাটক বা সিনেমা দেখা। বেড়াতে যাওয়া, সহ¯্রধারায় তাঁবুতে রাত্রিযাপন, প্রদীপদের বাড়িতে, জ্যোতির্ময়ের বাড়িতে, শাকপুরা রাস পূর্ণিমায় বেড়াতে গিয়ে কতো কা-। সহ¯্রধারায় বনভোজনে শান্তনু হাঁস আর মিলন দা মুরগী রান্না করেছিলো। না সত্যি, রান্নার হাত মন্দ ছিলো না ওর।
দীর্ঘ বিরতির পর আবারও ফিরে এসেছিলো নাটকে। এইতো মৃত্যুর এগারো দিন আগে শিল্পকলা মঞ্চে ‘যদি আরেক বার’ নাটকের লাইট করছিলো। আমি মাঝখানের স্পটে দাঁড়িয়েছি, ও বললো-তুমি এক পা সামনে পিছে, ডানে-বামে যেতে পারবে। আমি মঞ্চের মাঝখানে শামু ব্যালকনিতে অন্ধকারে। আমি এক পা এদিক ওদিক সরছি। কই, তোমায় দেখছি নাতো! এতো আলো আমাদের দিয়ে তুমি কোথায় গেলে অন্ধকারে! সকল স্মৃতির ভার আমাদের দিয়ে তুমি নির্ভার হয়ে কোথায় চলে গেলে শামু!

শেয়ার করুন