চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

মানবসমাজে নৈতিক অবক্ষয়ের প্রভাব

সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভি (রহ.)

২৬ নভেম্বর, ২০২১ | ১:৩৩ অপরাহ্ণ

পৃথিবীতে যেমন আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত প্রাকৃতিক নিয়ম ও বিধি কার্যকর আছে, যেভাবে হাজার বছর ধরে আগুন প্রজ্বলিত হচ্ছে, পানি প্রবাহিত হচ্ছে, জমিনে শস্য উৎপাদিত হচ্ছে, চন্দ্র-সূর্য উদিত হয়ে অস্ত যাচ্ছে, খাদ্য-শস্য মানবদেহের শক্তি বৃদ্ধি করছে, ওষুধ মানুষকে রোগ-ব্যাধি থেকে রক্ষা করছে, ঠিক সেভাবে আল্লাহ পৃথিবীতে একটি নৈতিক বিধি দান করেছেন। আর সে আলোকেই মানুষের ভালো ও মন্দ চরিত্র ব্যক্তি ও সমাজের ওপর নিজস্ব প্রভাব বিস্তার করে।

পবিত্র কোরআনে অতীতে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর ইতিহাস বর্ণনা করে নৈতিক গুণাবলির ফলাফল ও পরিণতি স্পষ্ট করেছেন। যারা বিষয়টি সম্পর্কে অবগত হতে চায় তারা হুদ (আ.)-এর জাতি, সালেহ (আ.)-এর জাতি, লুত (আ.)-এর জাতি, শোয়াইব (আ.)-এর জাতির ইতিহাস ও অবস্থা জেনে নিতে পারে। যাদের প্রত্যেকে বিশেষ রোগ ও চারিত্রিক স্খলনের অধিকারী ছিল। তাদের নৈতিক স্খলন, আল্লাহর অবাধ্যতা ও চারিত্রিক ত্রুটি তাদের সামাজিক ও জাতিগত বিপর্যয় ডেকে এনেছিল।

কোরআনে তাদের কাজের পরিণতিও বর্ণনা করা হয়েছে যেন মানুষ তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। হাদিসেও রাসুলুল্লাহ (সা.) বিশেষ বিশেষ চরিত্র ও কাজের পরিণতি ও পার্থিব জীবনে তার প্রভাব বর্ণনা করেছেন। যেমন বিশেষ বিশেষ পাপের কারণে কেউ বরকত হারিয়ে ফেলবে, কেউ রোগাক্রান্ত হবে, কেউ মানসিক অস্থিরতায় আক্রান্ত হবে, কোনো সমাজে মৃত্যু হার বেড়ে যাবে, কেউ অপদস্থ হবে, কাউকে বার্ধক্য পেয়ে বসবে। ‘তিব্বে নববী’ এ বিষয়ে একটি উপকারী গ্রন্থ।

‘সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ’ ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে বলা হয়েছে, ‘তাদের দোয়া কবুল হবে না।’ হুজায়ফা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে সত্তার হাতে আমার প্রাণ তাঁর শপথ! তোমরা সৎকাজের আদেশ দিতে থাকো এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করতে থাকো। নতুবা আশঙ্কা করি, আল্লাহ তোমাদের ওপর শাস্তি প্রেরণ করবেন। এরপর তোমরা দোয়া করবে কিন্তু তোমাদের দোয়া কবুল করা হবে না।’

ভ্রান্ত বিশ্বাস, বিভ্রান্ত কাজ ও স্খলিত চরিত্র ছাড়াও মুসলিম সমাজের বহু মানুষ নিফাকে লিপ্ত আছে। বিশেষত সমাজের অভিজাত শ্রেণি ও নেতৃবৃন্দ বিশ্বাসগত নিফাকে (কপটতায়) লিপ্ত। তাদের বহুজন অবলীলায় ফরজ বিধান পালন করে না, নামাজের প্রতি উদাসীন, তারা প্রকাশ্যে নামাজ ছেড়ে দেয়। যা সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্ট করছে এবং অন্যায় ও অবিচারের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। তাই প্রয়োজন হলো সব রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মসূচির সঙ্গে মানুষের ঈমান, আমল ও চারিত্রিক পরিশুদ্ধির আহ্বান জানান এবং আল্লাহর প্রতিবিধান নীতি বিশেষত চারিত্রিক স্খলন ও মন্দ কাজের পরিণতি সম্পর্কে জাতিকে সতর্ক করা। কোরআন ও হাদিসে যে ব্যাপারে অসংখ্য সতর্ক বার্তা এসেছে।

একটি বিষয় অদৃশ্য জগৎ এবং সামাজিক ও জাতীয় জীবনে মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলে। তা হলো অপচয় ও অপব্যয়। মানুষ তার প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণ, খ্যাতি ও সুনামের মোহ, সামাজিক রসম ও সংস্কারের অনুসরণ করতে গিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ অপচয় করে। অপরদিকে নিজের প্রতিবেশী, আপনজন, সমাজের মানুষের দারিদ্র্য ও অসহায়ত, তাদের মানবেতর জীবন থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে রাখে। যদিও বিষয়টি সরাসরি হারাম নয়; কিন্তু তা আল্লাহর ন্যায়পরায়ণতা, দয়া ও অনুগ্রহের বৈশিষ্ট্যের বিপরীত। নিঃসন্দেহে তা আল্লাহর অপছন্দীয়।

আল্লাহর অপছন্দের একটি বিষয় হলো মেয়েপক্ষের কাছে অধিক পরিমাণে উপঢৌকন দাবি করা। বর্তমান সমাজের বহু ছেলে ও তার অভিভাবকরা মেয়েদের কাছে বহুমূল্যের উপঢৌকন (যা সামাজিকভাবে যৌতুক নামে পরিচিত) দাবি করে থাকে। আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপনের পূর্বশর্ত হিসেবে পেশ করা হয়। যদিও তাকে ‘সালামি’ ও ‘ঘর সাজান’ নামে নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা করা হয়। তবু যৌতুকের সঙ্গে অসংখ্য মেয়ে ও তার পরিবারের অশ্রু ও দীর্ঘশ্বাস জড়িয়ে আছে।

কন্যাকে পারিবারিক সামর্থ্য অনুসারে শরিয়ত বা সুন্নতবিরোধী নয়। কেননা সন্তানের প্রতি ভালোবাসা ও স্নেহের বহিঃপ্রকাশ। রাসুলুল্লাহ (সা.)-ও ফাতেমা (রা.)-এর বিয়ের সময় কিছু উপহার দিয়েছিলেন। কিন্তু বর্তমানে তার রূপ সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। কেননা এখন যারা উপহার দিচ্ছে তারা সুনাম-সুখ্যাতির জন্য দিচ্ছে এবং তারা নিচ্ছে তারা দাবি ও জোরপূর্বক নিচ্ছে। বিশেষত ভারতবর্ষে যৌতুক প্রথা অত্যন্ত ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। মেয়েপক্ষের জন্য বিয়ে এখন বিপদ হয়ে দেখা দিয়েছে। মুসলিম জাতি—যারা রহমাতুললিল-আলামিনের উম্মত তাদের উচিত অমুসলিম দেশ ও সমাজে বসবাস করলেও এমন অন্যায়-অবিচারে লিপ্ত না হওয়া, যা আল্লাহর শাস্তিকে ত্বরান্বিত করে; বরং তাদের উচিত, আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর অনুসরণ করা। কেননা নবীজি (সা.)-এর অনুসরণই তাদের আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা করতে পারে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহর নীতি এমন নয় যে আপনি তাদের মধ্যে থাকতে তিনি তাদের শাস্তি দেবেন।’ (সুরা আনফাল, আয়াত : ৩৩)

দুঃখের বিষয় হলো, মুসলিম সমাজেও যৌতুকের মতো বহুবিদ ব্যাধি ছড়িয়ে পড়েছে। এখন তারা এসব সামাজিক অন্যায় ও পাপকে দ্বিনদারির পরিপন্থী মনে করে না। সামান্য যৌতুকের জন্য নববধূকে শারীরিক নির্যাতন করে, তাকে ঘর থেকে বের করে দেয় এবং এমনকি তাকে তালাক পর্যন্ত দিয়ে দেয়। যৌতুকের মতো সামাজিক ব্যাধিগুলোর বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলা এবং মুসলমানের মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতি জাগ্রত করা দরকার। যেন এমন জুলুমের রীতি সমাজ থেকে চিরতরে বিদায় হয়ে যায়।

সূত্র: তামিরে হায়াত থেকে, মো. আবদুল মজিদ মোল্লার ভাষান্তর

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন