চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

জড়িয়ে নিলাম তোমায়!

২০ আগস্ট, ২০২১ | ১২:১৪ অপরাহ্ণ

সিমলার প্রতিবেশী। চারপাশের সবাই উনাকে ‘রসনি’ বলেই চেনে। উনিশ-বিশে পাড়া প্রতিবেশীদের গাল মন্দ করলেও মানুষ হিসেবে খুব একটা খারাপ না!
২০০৩ সাল। সিমলার সবে বিয়ে হলো। জানামতে গ্রামে-গঞ্জে সকালবেলায় মানুষের ঘুম ভাঙত পাখির কলকাকলিতে, মোরগের ডাকে আর ঘরের বউ-ঝিদের অভ্যাসের টানে! কিন্তু সিমলার ঘুম ভাঙত রসনির চিৎকার, চেচামেচিতে। নতুন বিয়ের রাত বলে কথা! খুব বিরক্ত বোধ করতো। ইচ্ছে হতো গলাটা টিপে দিয়ে আসি। মনে মনে ভাবতো, বাপরে বাপ এমনও মহিলা হয়!

তখন ছিল গ্রীষ্মকাল। মধুমাস। আম, জাম আর কাঁঠালের ভরপুর চারদিক। রসনির বাগানেও আম, জাম আর কাঁঠালের ভরপুর। জানলাম, রসনির হাতে টাকা কমে এলেই সাথে সাথেই সিমলাদের বাসায় একটা সুস্বাদু কাঁঠাল ধরিয়ে দিয়ে সম পরিমাণ টাকা নিয়ে যেত।

একদিন মুখোমুখি।
– বৌদি কাঁঠাল এনেছি খুব স্বাদের।
– তোমার কাঁঠাল খাব না। তুমি দুষ্টু প্রকৃতির মহিলা। তোমার জন্য হারাতে হয় স্বাদের ঘুম। আরামের ঘুমে অসুখ বাঁধিয়ে কাঁঠাল দিতে এসেছো? নিয়ে যাও।
– কি করবো বৌদি! পাড়ার দুষ্টু ছেলেদের কাণ্ডকীর্তনে আমি প্রায় ওষ্ঠাগত! কখনো ঘরের চালে ঢিল ছোঁড়া, কখনো গরুর দড়ি ছেড়ে দিয়ে, কখনো ছোট্ট উঠুনে মলত্যাগ করে চলে যায়। আমি একা মানুষ। দুটো খেটেখুটে খাই। জীবন চলে, পেট চলে গাছের ফলগুলো বিক্রি করে। সবচেয়ে দুঃখ লাগে যখন আমার ফলগুলো রাতের অন্ধকারে ছিঁড়ে নিয়ে যায়। বলেন মাথা কি আর ঠাণ্ডা থাকে? তাইতো গাল মন্দ করি।

আস্তে আস্তে রসনির সাথে সিমলার সখ্যতা বাড়ে। সুযোগ পেলেই আড্ডা দিতে চলে আসে। রূপকথার জন্মের পর সিমলাকে আর বৌদি বলে ডাকে না। ডাকে রূপপথির মা বলে। রূপকথার মা বলতে পারতো না। বলতো, ও রূপপথির মা ঘরত আছনি?
রূপকথার অন্নপ্রাশনের সময় সিমলাকে একটা টুকটুকে লাল কাপড়ের ব্লাউজের পিচ উপহার দেয়। সেইটা সিমলার শ্বাশুড়ি হাতে সেলাইও করে দিল। সিমলা পরম আনন্দে গায়ে জড়ায়।
তারপর ধীরে ধীরে জীবন গল্পে মেতে উঠে দুজন। আড্ডা জুড়ায় মনোখোরাকে!
– আচ্ছা তুমি একা থাক কেন?
– সে অনেক কথা। একদিন সব ছিল। এখন না থাকাটাই যেন আমার জীবনের গর্ব!
সিমলা জানার জন্য ব্যাকুল হতো!
– আমার ১ টি ২টি নয়। ১২ টির মতো সন্তান আমি পেটে ধারণ করেছি। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার ইশারায় আমার সন্তানরা পৃথিবীর আলো থেকে বঞ্চিত! শুধু একটি মাত্র মেয়েটি ছাড়া। আমি রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, খেয়ে না খেয়ে, পরিশ্রমের উপর পরিশ্রম করে টাকা অর্জন করে মেয়েটাকে বড় করেছি এবং বিয়েও দিয়েছি। সুখের জন্য যা করতে হয় করেছি। মোটামুটি চলছে মেয়ের জীবন। এখন মেয়েটা হাত বদল হওয়াতে আমি সম্পূর্ণ একা!
আসলে আমরা বাঙালিরা পরিশ্রম করে, খেটেখুটে জীবন খুব একটা পার করতে চাইনা শুধু অলসতার কারণে। অল্পতেই আরাম আয়েশের অপেক্ষায় থাকি। তাইতো অভাব লেগেই থাকে।
এইদিকে রসনি নিজেই নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আছে।
কারো উপর নির্ভর না থেকে জীবনকে আগলে রেখেছে।
– আচ্ছা মেয়ের বাবা কই?
– সে বেঁচে আছে। তবে মন থেকে আমি তাকে মৃত ঘোষণা করেছি।
– কেন?
– যেদিন নিজের চোখে দেখতে পেলাম আমার মানুষ অন্য নারীর দেহ পাহারা দিচ্ছে সেদিন থেকেই তার ঘর, তার সংসার ছেড়ে চলে এসেছি এক কাপড়ে। আর ফিরে তাকায়নি, মাড়ায়নি তার ছায়া।এরপর থেকে আজ অবধি কোনদিনই আমার মনোঘরে সে প্রবেশ করতে পারেনি।
তবে স্মৃতিরা মাঝে মধ্যে উথাল পাথাল করে ঠিকই তবুও ক্ষত অংশটা আর ক্ষতিগ্রস্ত হতে দিইনি।

এইভাবেই চলছে রসনির জীবন।

সিমলা শ্বশুর বাড়িতে গেলেই ছুটে আসে রসনিকে দেখতে। চা পানে, পান-সুপারি আর আবুল বিড়িতে চলে দুজনের আড্ডা।

 

পূর্বকোণ/এসি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট