চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

আমাদের বাংলা বিভাগের ড. রাজীব হুমায়ূন স্মরণ

ডেইজী মউদুদ

৫ জুলাই, ২০১৯ | ১:৪৭ পূর্বাহ্ণ

ঊনাশি আশি সালে আমরা যখন চবি বাংলা বিভাগে ভর্তি হই, তখন ছিল বিভাগটির স্বর্ণযুগ। স্বর্ণযুগ বলছি এই কারণে, তখন আমরা দেশবরেণ্য প-িত ব্যক্তিদেরকেই শিক্ষক হিসাবে পেয়েছিলাম। বলবো এটি আমাদের পরম সৌভাগ্য। ড. আনিসুজ্জমান, ড. মনিরুজ্জমান, ড. জাহাঙ্গীর তারেক, ড. দিলোয়ার হোসেন, ড. রশীদ আল ফারুকী, ড. শামসুল আলম, চৌধুরী জহুরুল হক, ড. ভূঁইয়া ইকবাল, ড. গোলাম মুস্তাফা, ড. ময়ুখ চৌধুরী প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। আমাদের আগে ছিলেন ড. আবু হেনা মুস্তফা কামাল, ড. আবদুল আউয়াল প্রমুখ। সেই খ্যাতিমান ও প্রবীণ শিক্ষকদের পাশাপাশি বয়সে একবারে নবীন ও স্মার্ট শিক্ষক হিসাবে পেয়েছিলাম ড.রাজীব হুমায়ূন স্যারকে।
আমরা মাত্র প্রথম বর্ষ অনার্সের ছাত্রী। কৈশোর উত্তীর্ণ হয়ে সদ্য কলেজের মাঠ ছেড়ে বিশ^বিদ্যালয়ের অঙ্গনে প্রবেশ করেছি। বিশ^বিদ্যায়ের সুন্দর আর নান্দনিক পরিবেশে আমরা এমনিতেই মুগ্ধ, যে দিকে তাকাই কেবল সুন্দর আর সুন্দরের হাতছানি। তার উপরে পড়তে গিয়েছি বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে। প্রথম বর্ষেই মুগ্ধতা। আমাদের বাংলা বিভাগ, আমাদের কড়িডোর, সেমিনার রুম, ক্লাসরুম, সিনিয়র আপারা, ভাইয়ারা, সহপাঠী যেন আপন থেকে আপন হতে থাকলো। সাহিত্য বিভাগ হওয়ায় যেন “বার মাসের তের পার্বণ”। নিয়মিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান লেগেই থাকতো। এসবের মধ্য দিয়ে খুঁজে পেলাম মজার এক জগৎকে। একঝাঁক তরুণ কবি, গানের শিল্পীরা আমাদের বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন।
কাজলেন্দু দে, আসাদ মান্নান, খালিদ আহসান, ওমর কায়সার, রাহগীর মাহমুদ, সৈয়দা মালেকা আকতার, সেলিনা আকতার জাহান, সনজীব বড়–য়া, মিনার মনসুর, বিশ^জিৎ চৌধুরীসহ অনেকেই বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী। তাদের সরব পদচারণায় সেমিনার কক্ষ, করিডোর সদা মুখর থাকতো। কাজেই, খুবই ভালো লাগতো, ভীষণ উপভোগ করতাম। জানার এবং শেখার অদম্য এক আগ্রহ আমায় নিত্য তাড়িয়ে বেড়াতো। জীবনে কখনো ক্লাস মিস করবো তা ভাবতইে পারতাম না। তাই ঝড়-বৃষ্টি-দুর্যোগ উপেক্ষা করে ফার্স্ট পিরিয়ড ধরার জন্য সাতসকালে যাত্রা করতাম সেই ১২১ নম্বর কক্ষের উদ্দেশ্যে। প্রথম বর্ষের প্রথম ক্লাস নিতেন আনিস স্যার, তিনি পড়াতেন বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ উপন্যাস। স্যারের পড়ানোর সেকি স্টাইল, ছিল যাদুর মতো। রোহিনী, ভ্রমর আর গোবিন্দলালের ট্র্যাজিডিকে একসূত্রে গেঁথে দিয়েছিলেন আমাদের চেতনায়। ঠিক একইভাবে রাজীব হুমায়ূন স্যার ও তাঁর অসাধারণ উপস্থাপনা আর বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা এবং কালিদাশের যক্ষ্মপ্রিয়াকে আমাদের চেতনার সাথে একাকার করে দিয়েছিলেন। এখনো চোখে ভাসে
ক্লাশে প্রবেশ করতেন নাটকীয় ভঙ্গীতে, সোজা বোর্ডে গিয়ে ‘লিখতেন : ‘সদাই ধেয়ানে / চাহে মেঘপানে / না চলে নয়ানতারা/ বিরতি আহারে / রাঙাবাস পারে/ যেমতি যোগিনী পাড়া’ অথবা ‘এ সখি হামারি দুখের নাহিক ওর/ এ ভরা বাদর/ মাহ ভাদর/ শূন্য মন্দির মোর’ এরপর শুরু হতো তাঁর নান্দনিক বর্ণনা। পড়ানোর এমন যাদুকরী গুণে আমাদের আর বাসায় গিয়ে তেমন পড়তে হতো না।
‘মেঘদূত’ পড়াতে গিয়ে যে কথাটি প্রায় বলতেন তা এখনো আমার মনে আছে। তিনি শুরুতেই বলতেন ‘মেঘদূত মহাকবি কালিদাশ বিরচিত বুদ্ধদেব বসু অনূদিত বর্ষা বিরহের দূত কাব্য। মেঘ উড়ে প্রেমিকের কাছে গিয়ে বিরহী বার্তা পৌঁছাবে! ক্লাসে পিনপতন নিরবতা, শিক্ষার্থীরা সকলেই নবীন, এমন প্রেম কাহিনী সবাই মুগ্ধচিত্তে কেবল শুনছে। আবার যখন জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ কাব্য পড়াতেন তখন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিশদ আলোচনা করতেন। হাজার বছর ধরে, আমি যদি বনহংসী হতাম, হাওয়ার রাত, শিকার ইত্যাদি কবিতাগুলো কত সুন্দর করে ভেঙে ভেঙে পড়াতেন। কবির ইতিহাস চেতনা, প্রেমবোধ, স্বদেশপ্রেম, ঐতিহ্যপ্রীতি, শিল্পবোধ, পুরাণ কাহিনীর সাথে তিনি আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে আমাদের কল্পনা ও জানার জগৎকে অনেকাংশে সমৃদ্ধ করেছেন। পড়াতেন শেক্সপীয়রের ‘ম্যাকবেথ’ আর লেডি ম্যাকবেথকে তুলে ধরতেন চোখের সামনে। নাটকে ট্রাজিডি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে গ্রীক ট্যাজিডি আর শেক্সপীয়রিয়ান ট্র্যজিডির তুলানামূলক আলোচনা করতেন। একটি কথা এখনো মনে আছে বলতেন, গ্রীক ট্র্যাজিডি নিয়তি তাড়িত, আর শেক্সপীয়রিয়ান ট্র্যাজিডি চরিত্র-শাসিত। তিনি আমাদের রবীন্দ্রনাথ ও পড়িয়েছেন। আবার মাস্টার্স-এ আমাদের মাঝে পালির পরিবর্তে যাদের ভাষাবিজ্ঞান ছিল তাদের সমাজ ভাষাবিজ্ঞান পড়াতেন।
কিন্তু আমরা যখন যখন মাস্টার্স এ পড়ছি অর্থাৎ ’৮৫ সালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় ছেড়ে জাহাঙ্গীর নগর বিশ^বিদ্যালয়ে চলে যান। আমরা তখন ডিপার্টমেন্ট থেকে একটি বিদায় সংবর্ধনার আয়োজন করেছিলাম।। গ্যালারিতে আয়োজিত অনুষ্ঠানটিতে মানপত্র পাঠ, আমাদের বন্ধু শেলী স্যারের প্রিয় গান ‘এমনই বরষা ছিল সেদিন’ গানটি করে। আমি বিশুকে বলে স্যারকে ফুল দিয়েছিলাম। একটি ছবিও তুলেছিলাম সাদাকালো। আবার তাঁর প্রিয় শিক্ষার্থীরা স্যারকে রেল স্টেশনে গিয়ে বিদায় জানিয়েছিল। আসলে স্যারের সাথে আমাদের অনেক স্মৃতি। বিশেষ করে পড়াতে পড়াতে উনার সাথে আমাদের অদৃশ্য মানসিক এক সখ্য গড়ে ওঠে। তাঁর জ্ঞানের পরিধি এত বেশি ছিল যে, উনি যে বিষয়টি পড়াতেন সেখানে সীমাবদ্ধ থাকতেন না। তিনি সীমানা পেরিয়ে পাড়ি দিতেন জাতীয় থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও। তাই তো রবীন্দ্রনাথের ‘পরনে ঢাকাই শাড়ি কপালে সিঁদুর’ অথবা ‘বাবু, ডেকেছিস ক্যানে? এই জন্যে’, কবি আল মাহমুদের ‘কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুল খোলা আয়েষা আকতার’ কিংবা হাসান আজিজুল হকের ‘আমি একটি করবী ফুলের গাছ লাগাবো, ফুলের জন্য নয়, বিচির জন্য, কারণ করবী ফুলের বিচিতে ভালো বিষ হয়’-এসব নানাবিধ চরণ তিনি বুলেটের মতো আওড়াতেন। একই সাথে ইংরেজ কবিদের প্রসঙ্গ নিয়ে আসতেন। কোলরিজ, ওয়ার্ডওয়ার্থ, ফ্রয়েড, রিলকে, নীটশে কিছুই বাদ পড়তো না।
এতক্ষণ কেবল স্মৃতিচারণ করলাম। এবার স্যারের সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরার চেষ্টা করবো। সন্দ্বীপের মৌলভী সৈয়দ আহমদ ও আজমতেন্নেসা বেগমের ঘরে ১৯৫১ সালে জন্ম নেওয়া হুমায়ূন কবীর (রাজীব হুমায়ুন) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগ থেকে ১৯৭২ সালে স্নাতক এবং ১৯৭৪ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন।
১৯৭৮ সালে তিনি ভারতের পুনে ইউনিভার্সিটি থেকে ভাষাবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ১৯৮৫ সালে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন রাজীব হুমায়ুন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হিসেবে ১৯৯২ সাল থেকে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্যও ছিলেন তিনি। ২০০৪ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বেচ্ছায় অবসরে যান।
রাজীব হুমায়ুন আন্তর্জাতিক কাউন্সিল অব টিচার এডুকেশন (সিটিই)-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে সিটিইর সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
গবেষক রাজীব হুমায়ুনের উল্লেখযোগ্য প্রকাশনার মধ্যে রয়েছে-নজরুল ও বিশ্বসংস্কৃতি, নজরুল ইসলাম ও বাংলাদেশের সাহিত্য, নজরুলের লেখার কৌশল, আবুল মনসুর আহমদের ব্যঙ্গ রচনা ও সংস্কৃতি চিন্তা, সমাজ ভাষাবিজ্ঞান, সমাজ ও সংস্কৃতি।
তিনি বাংলা একাডেমি, এশিয়াটিক সোসাইটিসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সন্দ্বীপের ইতিহাস গ্রন্থটি তিনি সম্পাদনা করেছেন। রাজীব হুমায়ূন সত্তরের দশকে সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচীর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
রাজীব হুমায়ূনের টেলিভিশন নাটকের মধ্যে রয়েছে মহাপ্রস্থান (১৯৮৪), নীলপানিয়া (১৯৮৬), মাগো তুমি কেমন আছো (১৯৯৯), ব্রিফকেস, একটি পরিবারের গল্প, লাগুক দোলা। তাঁর একমাত্র মঞ্চনাটক ‘নীলপানিয়া’ গ্রন্থাকারেও প্রকাশিত হয়েছে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট