চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

আবেগের বশে

দিপংকর দাশ

৫ জুলাই, ২০১৯ | ১:৪৮ পূর্বাহ্ণ

ভরা পূর্ণিমায় মা-বাবা, দাদা-দাদি ও সকল আত্মীয়ের মুখে হাসি ফুটিয়ে ত্রিভুবনে ভূমিষ্ঠ হয় এক কন্যা শিশু। জন্মের পরে সকল শিশুই কেঁদে ওঠে কিন্তু এই কন্যা শিশুটি কাঁদার বদলে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। যদিও এই ঘটনায় সবাই অবাক হয় কিন্তু সবার ভুল ধারণা ভাঙিয়ে দাদি বলেন, ‘আহা! কি ফুটফুটে নাতনি আমার। পূর্ণিমা চাঁদের জ্যোৎস্নায় আলোকিত হয়ে আছে এর মুখখানি। সত্যিই বড্ড লক্ষ্মী হবে আমার নাতনি।’ এ কথা শুনে মায়ের মুখেও এবার হাসি ফুটলো।
কিছুদিন পর কন্যার নাম রাখা হলো। দাদা-দাদি নাম দিলেন ভাগ্যবতী। প্রজ¦লিত প্রদীপের ন্যায় জ্বলজ্বল করে সারা সংসার আলোকিত করে রাখবে এই আশির্বাদ করলো সবাই। ক্রমশ বড় হচ্ছে ভাগ্যবতী। সাত মাস বয়সের সময় অন্নপ্রাশন হলো কন্যার। দুষ্টুমি আর চঞ্চলতার মধ্য দিয়ে বড় হতে থাকে সে।
ছয় বছর বয়স থেকে শুরু হয় পাঠশালায় যাওয়া-আসা। দেখতে দেখতে প্রাথমিক পর্যায়ের পড়া শেষ হয়। ভাগ্যবতীর ভাগ্য চাকা এবার তাকে উচ্চ বিদ্যালয়ে নিয়ে যায়। গ্রামের একমাত্র উচ্চ বিদ্যালয়ে শুরু হয় আরেক স্তরের পড়ালেখা। ভাগ্যবতী বিভিন্ন কাজে পারদর্শী । সে খুব সুন্দর করে রবীন্দ্রসংগীত গাইতে পারে। তাছাড়া ক্ল্যাসিক্যাল নৃত্যেও পারদর্শী । অষ্টম শ্রেণিতে উঠার পর সে উপজেলা ভিত্তিক নৃত্য প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অর্জন করেছে।
অষ্টম শ্রেণি পেরিয়ে নবম শ্রেণিতে ভাগ্যবতী। নতুনভাবে জীবন শুরুর সময়। স্কুলে যাওয়ার সময় সে একটা বিষয় প্রায় প্রতিদিনই খেয়াল করে। একটি ছেলে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। ছেলেটি নবম শ্রেণিতেই পড়ে। আগে কখনো এমনটি করতো না সে। কিন্তু কয়েকদিন ধরে সে ভাগ্যবতী ব্যতীত অন্যদিকে তাকায়ই না। ভাগ্যবতী কয়েকদিন ব্যাপারটি খেয়াল করলো। সে ছেলেটিকে চিনতো না। তাই সে কথা বলতে সাহস পায় না। একদিন ছেলেটি এসে ভাগ্যবতীর সাথে কুশল বিনিময় করে। তখন ভাগ্যবতী তার নাম জিজ্ঞাসা করে। ছেলেটির নাম হীরণ¥য়। চৌধুরী বাড়ির ছোট ছেলে। হীরন্ময় পড়ালেখায় মোটামুটি ভালো কিন্তু ভাগ্যবতী খুবই ভালো। পরিচয় জানার পর তারা কথা বলতে লাগলো।
হীরণ¥য় : তুমি তো পড়ালেখায় খুব ভালো। আমাকে একটু পরামর্শ দাও না কিভাবে ভালো করে পড়া যায়?
ভাগ্যবতী : ক্লাসে মনোযোগ সহকারে স্যারের কথা শুনবা।
হীরণ¥য় : আর স্যারের কথা। ক্লাসে তো আমি শুধু তোমাকেই দেখি। তোমার দিকেই চেয়ে থাকি।
ভাগ্যবতী : মানে?
হীরণ¥য় : না, মানে স্যারের কথা তো শুনিই। কিন্তু মাথায় বেশি একটা ঢুকে না।
ভাগ্যবতী : ওহ। আর হ্যাঁ, একটা কথা শোনো, তুমি কখনো আমার স্কুলে আসার পথে দাঁড়িয়ে থাকবা না।
হীরণ¥য় : ওকে। তোমার যদি খারাপ লাগে কখনো দাঁড়াবো না।
এই বলে দুজন দুদিকে চলে গেলো। তারপর থেকে হীরণ¥য় আর কখনো পথে দাঁড়িয়ে থাকে না। কদিন এভাবে চলে যাওয়ার পর ভাগ্যবতীর খুব খারাপ লাগে। সে মনে মনে হীরণ¥য়কে খুঁজে। কিন্তু সে তো আর আসে না। একদিন ক্লাসে ভাগ্যবতী হীরণ¥য়কে ডাক দেয়।
হীরণ¥য় : হ্যাঁ, বলো।
ভাগ্যবতী : কোথায় থাকো তুমি? তোমাকে দেখি না কেন?
হীরণ¥য় : আমি যেখানে খুশি থাকবো। তোমার সমস্যা কি?
ভাগ্যবতী : সমস্যা না। দেখি না বলেই বললাম।
হীরণ¥য় : দেখে কি আর হবে?
ভাগ্যবতী : না দেখলে খারাপ লাগে।
হীরণ¥য় : মানে?
ভাগ্যবতী : না কিছু না।
এই বলে চলে গেলো সে। হীরণ¥য় বুঝতে পারে ভাগ্যবতী তাকে একটু একটু… এখন প্রতিদিনই সে ভাগ্যবতীর জন্য অপেক্ষা করে। ভাগ্যবতীও তাকে দেখে মুচকি হাসে। এভাবে এক স্বাপ্নিক প্রেমের সূচনা ঘটে। দু’জনের মধ্যে বেশ ভাব উদয় হয়। এখন প্রতিদিন ক্লাসের পরে দুজন দুজনের সাথে গল্পে মেতে ওঠে। নবম শ্রেণি পেরিয়ে দশম শ্রেণিতে দুজনই।
হীরণ¥য় প্রতিদিন বিকালে একবার হলেও ভাগ্যবতীর বাড়ির পাশ দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যায় একটুকু দেখার জন্য। দুজন দুজনকে খুব ভালোবেসে ফেলে। অপ্রাপ্ত বয়সের প্রেম কতটুকু যথার্থ আবেগের বশে দুজনেই হয়তো জানে না। আকাশে উড়া শঙ্খচিলের ন্যায় উড়তে থাকে দুজনই। লুকিয়ে লুকিয়ে চিঠি আদান-প্রদান করে। পদ্মঝিলে নৌকোয় ভাসে দু’জন।
হঠাৎ একদিন ভাগ্যবতীর বাবা দেখতে পায় ওরা দুজন কথা বলছে। এই বুঝি উড়ন্ত শঙ্খচিলের গায়ে কেউ তীর মেরে দিলো। বাবা ছটে গেলেন। ভাগ্যবতীকে হুঁশিয়ার করে দিলেন। ওদিকে হীরণ¥য়কে শাসিয়ে দিলেন। খাঁচায় বন্দী পাখির মতো ভাগ্যবতীর জীবন ছন্নছাড়া হয়ে গেলো।
শুরু হলো এসএসসি পরীক্ষা। মন কি বসে পড়ার টেবিলে? দুজনই দু’জনকে দেখার জন্য ছটফট করতে লাগলো। পরীক্ষার সুবাদে হয়তো দেখা হবে এই প্রতীক্ষায় দুজনেই। পরীক্ষা কেন্দ্রে ভাগ্যবতীকে তার বাবা নিয়ে যায়। যাই হোক পরীক্ষা হলে দেখা মিলবে এই আশা নিয়ে অপেক্ষমাণ হীরণ¥য় । অবশেষে দেখা মিললো। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের কোণে জল। মুখে কোনো কথা নেই। ঘণ্টা বেজে উঠলো। পরীক্ষা শুরু। পরীক্ষার শেষ ঘণ্টা অবধি অপেক্ষা করার বেদনা খুঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছে দুজনকে। শেষ হল পরীক্ষা। আবার খানিকক্ষণ দেখা, কথা নেই। বাড়ির দিকে রওয়ানা। অনেকগুলো পরীক্ষা দেওয়া হয়ে গেছে। আজ শেষ পরীক্ষা।
দুজনেই ভাবছে হয়তো আজকের পর আর দেখা হবে না। লুকিয়ে লুকিয়ে কথা বলছে দুজন।
হীরণ¥য়: আর কি দেখা হবে না? কোন কলেজে ভর্তি হবে তুমি?
ভাগ্যবতী: জানি না। বাবা হয়তো আমাকে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দেবে।
হীরণ¥য় : তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না। আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি।
ভাগ্যবতী : সেতো আমিও বাসি। তোমাকে ছাড়া আমি কি সুখে থাকবো? আমার বাঁচার আশা যে তুমি।
ঘন্টা বেজে গেলো। পরীক্ষা শেষে আর কথা হবে কিনা কেউ জানে না। দুজনেই চোখের জল মুছতে মুছতে চলে গেলো। পরীক্ষা শেষে একটু দুজন দুজনের মুখটা দেখেছিলো। আর কথা হয় নি।
স্কুলের গ-ি পেরিয়ে দুজনেই এখন কলেজে। অনেক বন্ধু আছে। কিন্তু হীরণ¥য় চুপটি করে বসে থাকে ক্লাসের এক কোণে। এখনো হঠাৎ করে তার চোখের সামনে ভাগ্যবতীর মুখটি ভেসে ওঠে। হয়তো ভাগ্যবতীরও এমনটি হচ্ছে। এই ভেবে একটু স্বস্তি পেলেও ভুলতে পারে না ভাগ্যবতীকে।

শেয়ার করুন