চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

অমল বড়ুয়ার অনবদ্য বই ‘বৌদ্ধ অনুচিন্তা’

নিজস্ব প্রতিবেদক

২৯ মে, ২০২১ | ১০:৩১ অপরাহ্ণ

সম্প্রতি বের হলো উদীয়মান লেখক, প্রাবন্ধিক ও গবেষক অমল বড়ুয়ার জীবনোপযোগী ধর্মের মৌলিক নীতিসমূহের অনবদ্য গ্রন্থ ‘বৌদ্ধ অনুচিন্তা’। বর্তমান অস্থির বিশ্বে শান্তি, সুশাসন, গণতন্ত্র চর্চা ও নৈতিকতাবোধ সম্পন্ন সমাজব্যবস্থা গঠনে কিছুটা স্বস্তি আনবে এই গ্রন্থটি। প্রিয়ভাজন অমল বড়ুয়া গবেষণার মাধ্যমে সমাজের প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলী দশটি প্রবন্ধের মাধ্যমে এই গ্রন্থটিতে তুলে ধরেছেন।

আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় গণতন্ত্র সর্বজন কর্তৃক প্রশংসিত ও গ্রহণযোগ্য শাসনব্যবস্থা। আর এই গণতন্ত্র সর্বসাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠার ফলে এবং এর অধিক চর্চার কারণে কিছু কিছু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী এটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার প্রয়াস চালাচ্ছেন। গণতন্ত্রের সুফলভোগী জনগণ হলেও কালের যাতাকলে পিষ্ট হয়ে জনগণ যে তিমিরে ছিল সে তিমিরেই রয়ে যাচ্ছে। সঙ্গতকারণে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক বিকাশ যতটুকু হওয়া দরকার ততটুকু হতে পারেনি।

সেটা শুধু বাংলাদেশে নয়, আমেরিকা ও ভারতের মত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার দাবিদার রাষ্ট্রগুলোও করে উঠতে পারেনি। এই গ্রন্থে বৌদ্ধধর্মে গণতন্ত্র বিষয়ে আলোকপাত করেছেন অমল বড়ুয়া। ধর্ম মানুষের সৎ সুন্দর জীবন গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আর জাতিকে উন্নত করার মূল সোপান হচ্ছে ধার্মিকতা। বুদ্ধের শিক্ষা বিশেষ কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠির বা শ্রেণির জন্য নয়। প্রত্যেকের জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। উদার গণতন্ত্র কল্যাণমূলক রাষ্ট্র বিনির্মাণে ভূমিকা রাখতে পারে। তাই এর সঠিক চর্চা প্রয়োজন বলে তিনি এই গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।

বুদ্ধ প্রচারিত ধর্ম বিনয়ের মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে- মানবকল্যাণ। রাজনীতি শিক্ষা দেওয়ার কোনো অভিপ্রায় বুদ্ধের ছিল না। বৌদ্ধ ভিক্ষু সম্প্রদায়ের সমন্বয়ে বুদ্ধ ‘সংঘ’ প্রতিষ্ঠা করেন। যেটা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার মডেল হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। তার প্রতিষ্ঠিত ‘সংঘ’ ব্যবস্থায় যদিও কখনো ‘গণতন্ত্র’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি তথাপি সংঘের আইন বা বিধান, পরিচালনা প্রক্রিয়া, অংশগ্রহণ প্রভৃতির ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। বুদ্ধ তার সর্বময় কর্তৃত্ব সংঘ ও সংঘের সকল সদস্যদের হাতে অর্পণ করেন। যাতে বিশেষ ঘটনার নিরিখে সকলে মিলে বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে সংঘের বিধান প্রয়োগ করতে পারেন। এই ধরনের গণতন্ত্র খুবই বিরল।

সংঘের যে কোনো সিদ্ধান্তের জন্য সর্বসম্মত ভোটের প্রয়োজন পড়ে। সংঘে গণতন্ত্রের অনুশীলন বিদ্যমান। বুদ্ধ সংঘের উপর বিনয়ের ক্ষুদ্রানুক্ষুদ্র শিক্ষাপদসমূহ পরিমার্জন বা পরিবর্তনের অভূতপূর্ব ক্ষমতা অর্পণ করেন। যা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অনন্য দৃষ্টান্ত। বৌদ্ধ অর্থনীতির আধুনিক প্রেক্ষিতে গবেষক অমল বড়ুয়া বলেছেন, বৌদ্ধ অর্থনীতি নৈতিকতাঋদ্ধ অর্থনীতি যা বর্তমান আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় অনুসৃত হলে বিশ্ব অর্থনীতি হতে পারে বৈষম্যহীন সমতাভিত্তিক সুষম অর্থনীতি।

আজ বিশ্ব সর্বক্ষেত্রে চরম অবনতির সম্মুখীন। এটা স্বীকার্য যে, এর প্রধান ও প্রকৃততম কারণ হচ্ছে আমাদের নৈতিক স্খলন।

আমাদের বর্তমান সমাজব্যবস্থা এমন অবস্থায় ঠেকেছে যে, নৈতিকতা এখন যাদুঘরে। প্রকৃতপক্ষে বৌদ্ধধর্ম শাসনব্যবস্থায় সুশাসন, ন্যায়পরায়ণতা, সততা, নৈতিকতা, পরমত সহিষ্ণুতা, জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা ও সচ্চরিত্রতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে থাকে। ধর্ম মানুষকে আলোর পথ দেখায় এবং পঙ্কিলতার পথ থেকে মুক্ত হতে অনুপ্রাণিত করে। কিন্তু এ অস্থির বিশ্বে ধর্মের নির্যাস গ্রহণ না করে ধর্মকে বিভেদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার একটি আত্মঘাতি প্রবণতা বিদ্যমান। তাই ধর্মের নির্দেশনা মেনে অপরাপর ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল আচরণের মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

সমস্ত জীবজগৎ তার নিজের পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। বলা হয়ে থাকে মানুষ পরিবেশের দাস। প্রাকৃতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার পারষ্পরিক মিথস্ক্রিয়ার ফলস্বরূপ মানবিক আচরণকে প্রভাবিত করে পরিবেশগত সংস্কৃতি। আর এই সংস্কৃতি হলো সেই দেশ, অঞ্চল বা এলাকার জীবনব্যবস্থার ধরণ ও জীবনযাত্রার প্রণালির বহি:প্রকাশ মাত্র। আর এই পরিবেশ দ্বারা মানুষ ও প্রাণীজগত সর্বদা প্রভাবিত।

বিশ্ব আজ মহামারীর কবলে পড়ে নিঃস্ব হচ্ছে। ধ্বংস হচ্ছে অর্থনীতির ভিত, বিনষ্ট হচ্ছে পারস্পারিক সৌর্হাদ্য সম্প্রীতি, নষ্ট হচ্ছে পারিবারিক বন্ধন, ভালবাসা। এইরূপ মহামারী থেকে সুরক্ষার জন্য উপযুক্ত ঔষধসেবা, সুষম খাবার ও আত্মরক্ষার কৌশল সর্ম্পকে বুদ্ধের উপদেশ প্রতিপালনে সুফল লাভ করা যায়।

বর্তমান যুগের বস্তুতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভোগের মধ্যে সুখ ও শান্তির মোহে প্রলুদ্ধ হচ্ছে মানুষ অবিরত। যার ফলে মানুয়ের ভোগাকাঙ্খা ও ঐশ্বর্যের মোহ কেবল বৃদ্ধি পাচ্ছে, তৃপ্তি বা নিবৃত্তির কোনো লক্ষণ নাই। তাই জগতজুড়ে লেগেছে স্বার্থে স্বার্থে সংঘাত, দেশে-দেশে জাতিতে-জাতিতে দ্বন্দ্ব, মারামারি, হানাহানি ও যুদ্ধবিগ্রহ। মানুষের অন্তর থেকে তিরোহিত হচ্ছে মানুষের প্রতি প্রেম, ভালোবাসা, সহানুভূতি আর তার স্থান দখল করেছে পরষ্পরের প্রতি দ্বেষ, সন্দেহ, অবিশ্বাস, ঈর্ষা।

লোভান্ধ মানুষের মাঝে চলছে স্বার্থপরতার অসম প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতার দাপটে মানুষ প্রতিনিয়ত অন্যায়, অপরাধ, হিংসা-হানাহানি, দুর্নীতি, শঠতা, প্রবঞ্চণা, অবিচার ইত্যাদিতে নিয়োজিত হচ্ছে। ফলে অস্থিরতা নেমে আসছে সমাজে। তিনি এ গ্রন্থে বৌদ্ধ অর্থনীতিতে সঞ্চয় ও ঋণ, বৌদ্ধধর্মে সৃষ্টিকর্তা বা ঈশ্বর সম্পর্কে মতবাদ, বাংলাদেশে বৌদ্ধ ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ে প্রবন্ধে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করেছেন। এ ক্ষুদ্র পরিসরে বিশদ আলোচনার সুযোগও নেই। তিনি যে বিষয়গুলো নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন সেগুলো এক একটি গবেষণারও বিষয় বটে।

বইটি পাঠে সকলের মনে জানার আগ্রহ সৃষ্টি হবে। যা পাঠককে আরো বেশি বই পড়তে অনুপ্রাণিত করবে নি:সন্দেহে। বইটির কোনো অংশ গবেষক অমল বড়ুয়ার কল্পনা বা বানানো বিষয় নয়। তিনি বিভিন্ন বই পড়ে বা ঘেটে নির্যাসটুকু পাঠকের জন্য তুলে এনেছেন এবং তার উদ্ধৃতিও অধ্যায় শেষে সংযোজন করেছেন যাতে পাঠকের পাঠশেষে সত্যতা যাচাইযের সুযোগ আছে। এটা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার।

আমি আশা করব তরুণ লেখক গবেষক অমল বড়ুয়া আমাদের জন্য আরো লিখবেন এবং আমাদেরকে পাঠে আগ্রহী করে তোলবেন। তিনি আরো নতুন নতুন বিষয় আমাদের মাঝে উপস্থাপন করবেন, আমরা আরো ঋদ্ধ হবো। পরিশেষে বইটির আরো প্রচার ও প্রসার কামনা করছি। ১৩৬ পৃষ্ঠার সুন্দর প্রচ্ছদের এই বইটি প্রকাশ করেছে চট্টগ্রামের স্বনামধন্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান অক্ষরবৃত্ত প্রকাশন। বইটির মূল্য রাখা হয়েছে ২৭৫ টাকা মাত্র।

লেখক: লিটন কুমার চৌধুরী
কবি, প্রাবন্ধিক ও প্রধান শিক্ষক।

পূর্বকোণ/মামুন/পারভেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট