চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

অভীক ওসমানের

গদ্যের ভাস্কর্য চিত্র

দিনা আফরোজ

২৮ জুন, ২০১৯ | ১:৪৭ পূর্বাহ্ণ

পৃথিবীর পাঠশালার পাঠকের কাছে কবি খ্যাতি পাওয়া অভীক ওসমান হতে পারেন কবিতায় জননন্দিত কিন্তু তাঁর গদ্যের বিকাশও যে অনন্যসাধারণ হতে পারে তা ইতোমধ্যে সাধারণ্যে জেনে গেছেন। ১৯৬৯-‘৭০ এর ডামাডোলে বেড়ে ওঠা ‘৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রামে মুক্তিযোদ্বাদের কিশোর সহযোদ্ধার ভূমিকায় নামা, পরবর্তীতে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে রাজনীতির পাঠ নিয়ে শঙ্খ তীরবর্তী কিশোর ওসমানের এগিয়ে যাওয়া। জীবনের প্রাকৃতিক নিয়মে যখন হেসে-খেলে বেড়ানোর কথা সেই সময় পিতৃ-মাতৃহীন এই কিশোর পৃথিবীর কঠিন পাথুরে মাটিতে লেখার কৃষি শুরু করেন।
তাঁর লেখায় বাল্য-কৈশোর-যৌবন বলে কিছু নেই। সবটাতেই তারুণ্য ঝকঝক করছে। তবে লেখার গহীন অরণ্যে পৌঁছে গেলে অনুভব করা আজন্ম বাউল আপন ভোলা এক কিশোরকে, মানুষের জন্য যাঁর অপরিসীম ভালোবাসা। আবার অন্যায়-অনাচারের প্রতি যাঁর তীব্র ঘৃণা। লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে তিনি আঁকিবুকি কেটেছেন এমন নয়। তাঁর প্রবন্ধের পসরা ‘গদ্যকথা’ (১৯৯৬) আবেগ, ভালোবাসা আর ক্ষুরধার কলমের পরিমিত বিন্যাসে বেড়ে ওঠা সুস্থিত শিল্প। নিজের অভিজ্ঞতা-প্রসূত বক্তব্যকে প্রবন্ধের ভাষা শৈলীতে যুক্তিনিষ্ঠার সাহচর্যে বাক্সময় করে তুলেছেন। প্রতিটি বক্তব্যে বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন ঋদ্ধতার। এতে তাঁর চিন্তাধারাকে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর পর্যায়ে অবলোকন করার পথ প্রশস্ত হয়েছে। পাঠক পেয়েছে অনুধাবিত আর বিশ্লেষিত প্রজ্ঞার শিল্পালোকে অবগাহনের সুযোগ। নয়টি প্রবন্ধের এই ‘গদ্যকথা’য় পর্যায়ক্রমে রয়েছে চার রকমের কাজ-(সূত্র : লিটল ম্যাগ ‘মূল্যায়নে’র ফেব্রু’৯৮-অক্টোবর’৯৮ সংখ্যা)
ক) ভাষাবিদ ড. মুহাম্মদ এনামুল হক ও চট্টল তত্ত্ববিদ গবেষক আবদুল হক চৌধুরী বিষয়ক রচনা।
খ) গদ্য সাহিত্যের আলোকে নির্বাচন-শওকত ওসমানের ‘জননী’ ও আবু ইসহাকের জয়গুন।
গ) ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক লেখা, এবং
ঘ) কবি ও কবিতায় মননশীলতার প্রাঞ্জলতার বৈষয়িক বিশ্লেষণ।
উপর্য্ক্তু চার রকমের কাজ দিয়ে অভীক ওসমানের ‘গদ্যকথা’র প্রবন্ধ সংকলন পাঠকের কাছে সুখপাঠ্য। শওকত ওসমান আর আবু ইসহাকের উপন্যাস দু’টির আলোচনা ছাত্র-ছাত্রীদের পড়বার বিষয়কে সহজ করে দিয়েছে। বাঙালির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বিষয়ক দুটি প্রবন্ধ গতানুগতিক। তবে কবি ও কবিতায় আরবি সাহিত্যের কাহ্লিল জিবরান ও শেকস্পিয়র সম্পর্কে চমৎকার ধারণা দেয়াসহ আবুল হাসান আর শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মেধা ও মননশীলতার প্রায় সবটাই নতুন প্রজন্মের পাঠককে চিনিয়ে দিতে সাহায্য করেছে। বড়োকথা হলো অতিকথনের বাহুল্যবর্জিত নির্মেদ ঝরঝরে সুঠাম দেহের ‘গদ্যকথা’ তরুণ প্রজন্মকে হাত ধরে নিকুঞ্জ বনে নিয়ে যায় আর যেতেই থাকে। প্রবন্ধ কথা হলেও বিষয়াবলির প্রকাশভঙ্গী যেন গল্প বলে যাওয়া। কবিতা আর রাজনীতির প্রসঙ্গ গল্পচ্ছলে প্রকাশ করাটা একটু ভিন্ন ধাঁচেরই বটে। এই যেমন “সমাজতন্ত্র বিনির্মাণের নবীন প্রজন্ম আমাদের অগ্রজ এক টগবগে চিকিৎসাবিজ্ঞানী ছাত্রনেতা নির্দেশ প্রদান করেছিলেন, ‘হয় কবিতা নতুবা রাজনীতি, দুটোর একটা ছাড়তে হবে।’ পরবর্তীতে সর্বহারা পার্টির এক বোদ্ধার মুখে শুনেছি, ‘কবিতায় কী হয়, রমণীয় মনোরঞ্জন ছাড়া।’ এই দু’জনেই জানতেন না বিপ্লবপূর্ব রাশিয়ায় লেনিনের বক্তৃতার পর মায়কোভস্কির কবিতা শোনার জন্য শ্রমিকরা অপেক্ষা করতো।”(কবিতা ও রাজনীতি : গদ্যকথা পৃষ্ঠা-৩৭) এই রকম বৈশ্বিক বিশ্লেষণ এক জায়গাই থেমে থাকেনি। তিনি বলতে চেয়েছেন, “বাঙালির ভূমিকাও স্পষ্ট হয় কবিতার মধ্যে, চর্যাপদে ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে বৌদ্ধ সহজিয়াদের দ্রোহে। অথবা ভাষা অন্দোলন নিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারির বিখ্যাত সেই কবিতা, যা পরবর্তীতে গান-‘আমার ভাইয়ের রক্ত রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ তেমনি ‘৭৪-এর দুর্ভিক্ষের ক্রোধ ‘ভাত দে হারামজাদা, নইলে মানচিত্র খাবো’ আর মধ্য ‘৮০-র স্বৈরাচারবিরোধী কবি যোদ্ধার দুঃসাহসী উচ্চারণ’ এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাওয়ার তাঁর শ্রেষ্ঠ সময়।’ যৌবন আর যুদ্ধের কি চমৎকার যুগলবন্দি। যে কারণে জেনারেল শাসিত এই তৃতীয় বিশ্বে নূর হোসেন নামের দুর্দান্ত কৃষ্ণতরুণ বুকের প্ল্যাকার্ডে কবিতা লেখে, ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক/গণতন্ত্র মুক্তি পাক।’ নূর হোসেন হয়ে যায় মহাকাব্যের মহানায়ক”। কবিতা আর রাজনীতি মিলেমিশে একাকার হতে থাকে। (প্রাগুক্ত পৃষ্ঠা-৪০) আর হতেই থাকে। এভাবেই অভীক ওসমানের চিন্তার দিগন্ত উন্মোচিত হয়। এক সময়কার মার্কস-লেনিনবাদের ভক্ত, বিত্ত আর চিত্ত যার সমান প্রসারিত, ভেতরে ভেতরে কবিতার জন্য যার অহর্নিশ দহন আশ্চর্য এক রিদমের ভেতর দিয়ে তার যেন গদ্যকথার রাজ্যে এগিয়ে যাওয়া তবে তার মনভূগোলের মানচিত্র দেখতে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে আরো কিছুদূূর। ‘বাঙালির সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ নিয়ে তাঁর কথামালায়। “আমাদের কৃষি নির্ভর সমাজের মূল-সংস্কৃতির ভেতর যেগুলো আমরা পালা-পার্বণ আর আনন্দ উৎসবে দেখি, দেখি পার্বণিক লোকসঙ্গীত যেমন-গাজনে, গম্ভীরায়, লোকবাদ্যে, একতারা-দোতারায়, শিঙ্গার-বাঁশিতে, ঢাকে-ঢোলে, আঁতুড়-ঘরের আচারে, লক্ষ্মীপুজোয়, গায়ে-হলুদে ধানে-দূর্বায়, ধূপে-ধূনোয়, বুনো হিংস্র জীব পূজায় অথবা মহামারীর দেবতা পূজায়। এগুলোর মধ্যেই লুকিয়ে আছে বাঙালির গায়ের গন্ধ।” (প্রাগুক্ত পৃষ্ঠা-৩৫) বাঙালির সম্মিলিত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য কবি তাই যতোই শহুরে হোন না কেন-তাঁর ভেতরটা সেই মাটির সোঁদা গন্ধের মধ্যেই ডুবে যাবে। প্রকৃতির কোলে মৃন্ময় মাটির গন্ধে বেড়ে ওঠা তাঁর শৈশব-কৈশোর অজান্তেই গোটা জীবনের ওপর ছায়া দিয়ে রাখে। জীবন কি এক আশ্চর্য শক্তিধর কবিতার নাম।

২.
অভীক ওসমানের ‘প্রয়াত ৫ জন ও ইবসেন’ (ফেব্রুয়ারি-২০০৯) গদ্যরচনা বটে, কিন্তু সেও এক কথার মালা। সুঁই-সুতো দিয়ে আপন মনে বুনে যাওয়া। তাঁর নিজস্ব ঢঙ, নিজস্ব স্বাতন্ত্র্যে তৈরি স্মৃতিকথা। তিনি বলে যাচ্ছেন-তাঁর প্রিয় মানুষদের কথা। কবিতা, গান, কাজ, নাটক, আর প্রতিবাদ-প্রতিরোধের কথা। বইটির মুখবন্ধ রচয়িতা সলিমুল্লাহ খান যথার্থই লিখেছেন, “সৌভাগ্যের কথা অভীক ওসমান আজও অপ্রয়াত আছেন, এমনকি বলা যায় আছেন অপরাজিতও। তিনি একসময় নেতা ছিলেন, ছিলেন অভিনেতা ও গ্রন্থপ্রণেতা। সৌভাগ্যের কথা আজও তিনি অন্তত গ্রন্থপ্রণেতা আছেন। আমরা-তার বন্ধুরা অনেকেই অকালে প্রয়াত হয়েছি। অনেকে আর অভিনেতা নই, নেতাও হবো না কোনোদিন। গ্রন্থপ্রণেতার গৌরবমুকুট ও আমাদের শিরে সংক্রান্তির কারণ মাত্র। কিন্তু অভীক আজও যোগ্যপাত্র। তিনি প্রয়াত কয়েকজন বন্ধুর স্মৃথিকথা, লিখেছেন। এ লেখা পর্দা করে না মরমে প্রবেশ করে।” এতে অত্যুক্তি নেই ঠিকই কিন্তু সলিমুল্লাহ খান নিজেকে গ্রন্থপ্রণেতার গৌরব-মুকুট দিতে চান না। আমাদের ভেতর এখন কে আর না জানে সলিমুল্লাহ খান এই দেশের দশ দিগন্ত আলো করে রেখেছেন। যাহোক, সত্যিকারভাবেই মরমিয়া লেখার কর্ষক তিনি নাট্যজন সদরুল পাশার স্মৃতিকথায় আমাদের দেখিয়েছেন একজন মানুষ, অভিনেতা, আর নাটক কখন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। সবকিছু, আমজনতার মর্মকে স্পর্শ করার জন্য তাঁর একটি লাইনই যথেষ্ট, “তখন কোনো ব্যক্তির নয়, সংগঠনের নয়, ব্যবসার নয়, নাটক তখন তারুণ্যের।” (সদরুল পাশা এবং যামিনীভূষণ রায়দের নিয়তি : প্রয়াত ৫জন ও ইবসেন পৃষ্ঠা ৪৮) তা ছাড়া ঢাকায় মাইগ্রেটেড তাঁর অকাল প্রয়াত দুই বন্ধু বোহেমিয়ান কবি ত্রিদিব দস্তিদার ও বাংলাদেশের নাটকে গানের ব্যবহারের জনক এস. এম. সোলায়মানকে নিয়ে লিখেছেন আরো দু’টি প্রবন্ধ। যে প্রবন্ধে ক্যাপশন পরিচয় করিয়ে দেয় তাঁরা কেমন ছিলেন যেমন ‘এ অবেলায় একটি বালক : ত্রিদিব দস্তিদার অপরটি ‘আমার ঘরে আগুন লেগেছে ; এস. এম সোলায়মান’। প্রয়াত ৫ জনের একজন শিল্পপতি, শিল্পী ও কবি জহিরউদ্দিন খানকে চিনিয়ে দিতে নিজের সাথে খানের চিন্তা-চেতনার যে একাত্মতা তা তুলে এনেছেন এভাবে যে-“তিনি বিশ্বাস করেন, ঃযব পঁষঃঁৎব ড়ভ ঃযরং ংঁন-পড়হঃরহবহঃ রং ধ মরভঃ ড়ভ ঐরসধষধুধং। আর একে জহিরউদ্দিন খান যেভাবে বিশ্লেষণ করলেন তা হলো, “ডরঃযড়ঁঃ ঢ়ৎড়-ঃবপঃরাব বহারৎড়হসবহঃ ড়ভ ঃযব ঐরসধষধুধং ঃযব ঁহরয়ঁবহবংং ধহফ ঢ়বধপবভঁষ ঢ়ৎড়মৎবংং ধহফ ফবাবষড়ঢ়সবহঃ ড়ভ াধৎরড়ঁং ধংঢ়বপঃং ড়ভ পঁষঃঁৎব ধহফ ংড়পরধষ ফবাবষড়ঢ়সবহঃ ড়ভ ঃযব ংঁন-পড়হঃরহবহঃ পড়ঁষফ হড়ঃ যধাব ঃধশবহ ঢ়ষধপব.” (প্রাগুক্ত পৃষ্ঠা ৩৬) তাঁদের দুয়ের সংস্কৃতি ভাবনায় আমরা দেখে নিই হিমালয়বেষ্টিত পরিবেশই বহুধারায় প্রবাহমান আমাদের সংস্কৃতি ও সামাজিক অগ্রগতিকে দিয়েছে শান্ত, সমাহিত এক সুন্দর রূপ।
৩.
শঙ্খ তীরবর্তী জনপদের জননায়ক দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেন, মাওলানা এছলামাবাদী, ভাষাসৈনিক প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম ও আহমদ ছফার উত্তরসূরি অভীক ওসমান মাওলানা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান এছলামাবাদীর ‘হতাশ জীবন’ (২০০৯) এবং প্রকাশিত অন্তিম রচনাবলীরও সম্পাদনা করে আমাদেরকে সামাজিক দায় থেকে কিঞ্চিৎ মুক্ত করেছেন। “এই উপমহাদেশের ইতিহাসে যে কয়েকজন আলেম আর মৌলানা প্রসিদ্ধি অর্জন করেছেন তাঁদেরই একজন মনিরুজ্জামান এছলামাবাদী। একাধারে স্বাধীনতা সংগ্রামী, জাতীয়বাদী রাজনৈতিক নেতা ও সমাজ সংস্কারক হিসেবে তিনি প্রতিষ্ঠিত। রাজনীতিতে, শিক্ষা-প্রসারে এবং বঞ্চিতজনের বঞ্চনা মোচনে তাঁর কীর্তি চির অমøান। অভীক ওসমানের এই কাজের অনন্য দিক হলো, এছলামাবাদীর জীবনের অন্তিমলগ্নের অপ্রকাশিত রচনার মধ্য দিয়ে মৌলানার সমস্যাগ্রস্ত সংগ্রামী জীবনের এক টুকরো চিত্র উপস্থাপন। ঐতিহাসিক বিচারে এর মূল্য অপরিমেয়। অভীক ওসমান এই কীর্তিমান মনীষীর জীবন আর কাজ নিয়ে ব্যাপক কোনো গবেষণা কর্মে হাত দেননি; কিন্তÍ এছলামাবাদীর বহুধাবিস্তৃত কর্মযজ্ঞের বেশ কিছু অজানা দিকের সন্ধান দিতে পেরেছেন-যা এই নির্ভীক লড়াকু জনপদের মানুষদের অনুপ্রেরণার উৎসমুখ।” (সূত্র : ড. অনুপম সেনের ভূমিকা “মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান এছলামাবাদী হতাশ জীবন)

৪.
‘হতাশ জীবনছাড়াও তিনি সম্পাদনা করেছেন আরো দু’টি গ্রন্থ। মোতাহের হোসেন চৌধুরীর ‘গান ও কবিতা’ (২০০২) আর নজরুল জন্মশতবর্ষের স্মারক ‘চির উন্নত শির।’ (২০০০) সম্পাদনা করার জন্য কেবলই কি দায়বদ্ধতা ছিল তাঁর? বরং মনে হয়েছে ওখানে ভালবাসার আর্দ্র এক মানুষের কোমল প্রাণের ডানা ঝাপটানি। ‘চিত্র উন্নত শিরে’র সম্পাদকীয়তে তাই তাঁর বিনম্র উচ্চারণ “কাজী নজরুলের জন্মক্ষণ যখন রবীন্দ্রনাথ তখন দুপুর সূর্যের মতো জ্বলছেন। ‘তবু সেই কবির লাগি কান পেতে আছি।’ তাঁর একান্ত প্রত্যাশা ছিল আরেকজন নতুন কবির জন্য যে কবি হবেন আনন্দ-বেদনায়, সুন্দর-অসুন্দরে, শ্রমে-ঘামে জীবনে মানুষের রক্তজ আত্মীয়। শুধু কবির নয়-দেশ-কাল-সমাজের সেই কাক্সিক্ষত কবিপুরুষ হিসেবেই নজরুলের জন্ম।” ২২ সেপ্টেম্বর ২০০০ দৈনিক প্রথম আলোয় শুভময় হকের তথ্যানুযায়ী ‘বইটিতে চট্টগ্রামের লেখকদের প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। চট্টগ্রামের সঙ্গে নজরুলের সংশ্লিষ্টতাকে গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরা হয়েছে। চট্টগ্রামে তোলা নজরুলের কিছু ছবিও এতে স্থান পেয়েছে। ব্যক্তি ও সাহিত্য-স্রষ্টা নজরুলের নানা দিকের প্রতিফলন ঘটেছে এ সংকলনে। নজরুল সম্পর্কিত সাহিত্যে এটি একটি মূল্যবান সংযোজন বলে বিবেচিত হবে’। আর মোতাহের হোসেন চৌধুরীর ‘গান ও কবিতা’ (২০০২) প্রকাশ করতে গিয়ে বলেই বসেছেন, ‘আমাদের ব্যক্তি ও সমাজ মানসে এখন যখন দুর্যোগময় সন্ধ্যা মোতাহের হোসেন চৌধুরী যেন এগিয়ে আসছেন পরিত্রাতা হিসেবে হাতে তাঁর ঈধহফষব।’ জীবনকে আলোকিত করার প্রদীপ খুঁজে পেতে পৃথিবী চষার দরকার নেই। এ যেন একটি ধানের শীষের উপর একটি শিশির বিন্দু, কেবল চোখ মেলে দেখা চাই।

৫.
মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাসে সফল সংগঠক হিসেবে পরিচিত যে মানুষটি প্রাণ ছুঁয়ে যায় প্রমা ও লাবণ্যে, দুঃখের পবিত্রতায় স্নাত গভীর প্রিয় অর্জন যাঁকে দিয়েছে সাধনার বৃহত্তম সেবক হয়ে ওঠার ক্ষমতা, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার মতো দুর্জয় শক্তি সে মানুষটি অভীক ওসমান। অনেক কিছুর পাশাপাশি লিখেছেন আত্মজৈবনিক কাহিনি ‘পৃথিবীর করুণ ডাঙায়।’ (২০০৫) কবি ফাউজুল কবির ‘পৃথিবীর করুণ ডাঙা’র ভূমিকায় তাঁকে মেলে ধরেছেন অন্যভাবে। সাহিত্য সংসদ, বিবর্তন, গনায়ন, নাট্য সম্প্রদায়, চৌরঙ্গী সংস্কৃতি পরিবার, চট্টগ্রামের সংস্কৃতি পরিষদ, ১ বৈশাখ ও ২ বৈশাখ উদ্যাপন পরিষদ, একুশে মেলা উদ্যাপন পরিষদসহ উল্লেখযোগ্য সংগঠনসমূহের প্রতিষ্ঠাতা সংগঠক হিসেবে।
জীবনের খুঁটিনাটি বিষয়ের সৌন্দর্যও বাদ পড়েনি। মানুষকে কীভাবে সম্মানিত করতে হয় তারও নজির রেখেছেন মায়ের স্মৃতিকথায় তাজউদ্দিন আহমদের কথা বলতে গিয়ে। তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন ‘তাজউদ্দিন আহমদ : (শেখ মুজিবরে জন্ম না হলে যিনি বঙ্গবন্ধু হতেন তিনি কি চমৎকার ডায়েরি লিখতেন অথচ আমার কিছুই করা হলো না)। গুণী মানুষকে সম্মান দেয়ার জন্য কি অসাধারণ শব্দ চয়নের আয়োজন (প্রাগুক্ত পৃষ্ঠা-৮৩)। অবশ্য বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে ও ততোধিক সুন্দর কথামালা, শরীফা বুলবুল সম্পাদিত ‘খ্যাতিমানদের প্রিয়’ গ্রন্থে তিনি বাক্যবন্দি করেছেন এভাবে, “দেশে আমার প্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁকে বঙ্গোপসাগরের আকার ও ঢেউয়ের সাথে প্রতীকায়িত করা যায়। বামনের দেশে মহাকায় তিনি। তাঁর সমগ্র জীবন দিয়ে বাঙালি জাতির আবেগ ও স্বপ্নকে একীভূত করেছেন তিনি। বাঙালি-জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে একটি রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধ, একটি দেশ, একটি পতাকা উপহার দিয়েছেন। সর্বোপরি বাঙালি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে আমাদের চর্চা করার সুযোগ করে দিয়েছেন। কিন্তু এই প্রতারক জনপদের মানুষ জুডাসরা তাঁকে সপরিবারে হত্যা করে চমৎকার বিনিময় মূল্য দিয়েছে।” বাংলার এই প্রমিথিউস মহাপুরুষকে এই রকম করে বোধের গভীরে নিয়ে আসার অমন অমল-ধবল জাদুকরী প্রয়াসকে অভিনন্দন।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট