চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

স্মার্টফোন

খোরশেদ আলম খোকন

২৮ জুন, ২০১৯ | ১:৪৬ পূর্বাহ্ণ

মধ্যবিত্ত এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করে একমাত্র আদরের সন্তান হিসেবেই বেড়ে ওঠে আল- মাহমুদ। ছোটবেলা থেকেই আচার আচরণ চলাফেরায় সকলের প্রশংসার পাত্র সে। বাবা-মা আর ছোটবোন মাঈশাকে নিয়ে তাদের সংসার। বাবা সামান্য স্কুল মাস্টার। মধ্যবিত্ত পরিবারে নিয়মতান্ত্রিক অভাব পরিলক্ষিত হলেও সে অভাব মাহমুদ কখনো বুঝতে পারেনি। হয়তো তাকে বুঝতে দেওয়া হয়নি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি পারিবারিক শিক্ষার মাধ্যমে ভালো ফলাফলে সততার সুনাম নিয়েই এগিয়ে চলছিল তার জীবনের গল্প।
অবাধ্যতার বয়সে প্রযুক্তির সন্ধিসূত্রে ষোল তে সামান্য টোল পড়লেও শেষপর্যন্ত তা স্থায়ী হতে দেয়নি তার বন্ধু আপেল।
আজকে মাহমুদের এসএসসি’র রেজাল্ট ঘোষণা হয়েছে। স্কুল থেকে ফলাফল নিয়ে বাড়ি ফিরছে মাহমুদ। খুশির বাধ যেন ভেঙে যাচ্ছে তার। উঠোনে এসে মা মা বলে চিৎকার করে ডাকছে। সবেমাত্র আছরের নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে পড়েছে মাহমুদের বাবা। মা এখনো নামাজে বসে।
আম্মু আমি এ প্লাস পেয়েছি!
এই যে শুনছেন? আপনার ছেলে এ প্লাস পেয়েছে।
আলহামদুলিল্লাহ। দেখছো! আল্লাহ আমাদের দোয়া কবুল করেছে।
ছোট বোন মাঈশা বলল,
আব্বু আমাদের কিন্তু মিষ্টি খাওয়াতে হবে?
তোমার ভাইয়াকে বলো?
হুম্… ভাইয়া কী চাকরি করে?
ঠিক আছে আম্মু। আমিই খাওয়াবো। তোমার ভাইয়াকে নিয়ে খেতে বসো এখন। আমি মিষ্টি নিয়ে আসছি।
এই বলে মাস্টার সাহেব বাজারের দিকে রওনা হলো মিষ্টি আনতে। পথিমধ্যে একটি চা-স্টলে বসে আছে মেম্বারসহ চার-পাঁচজন। মেম্বার মাস্টার সাহেবকে লক্ষ্য করে বলল,
মাস্টার সাহেব এদিকে কোথায় যান?
একটু বাজারে যাব ভাই। ছেলের রেজাল্ট বের হলো আজকে।
পাশ থেকে একজন বলে উঠল,
মিষ্টি আনতে যাচ্ছেন বুঝি?
হ্যাঁ ভাই, ঠিকই ধরেছ। সবারই কিন্তু মিষ্টি খাওয়ার দাওয়াত রইল।
এই বলে মাস্টার সাহেব যখন বাজারের দিকে প্রস্থান করিল, তখন মেম্বারসমেত সবাই আল- মাহমুদের প্রশংসায় লিপ্ত হইয়া পড়িল। যেমন আচার ব্যবহারে ছেলেটা খুব ভদ্র, সবাইকে সম্মান করে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, সে ছেলে ভালো হবে না তো খারাপ হবে?
মাহমুদ কলেজে ভর্তি হয়েছে। এখন সে কিছুতেই ভুলছে না স্মার্টফোনের কথা। মা কথা দিয়েছিল। ভালো রেজাল্ট করলে স্মার্টফোন কিনে দিবে।
আম্মু! এখন বলো? ফোন কখন পাচ্ছি?
দিবো বাবা, দিবো। দিতে চেয়েছি, অবশ্যই দিবো। তার আগে একটা শর্ত মানতে হবে?
কী এমন শর্ত মা?
ফোনের অপব্যবহার করা যানো। এই ফোন কিন্তুু এখন অনেক ছাত্র-ছাত্রীর ভবিষ্যত জীবন নষ্ট করছে। নষ্ট হচ্ছে কোমলমতি শিশুরাও!
ওসব নিয়ে তোমাকে একটুও ভাবতে হবেনা মা। ‘প্রত্যেক বস্তুর সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে।’ শুধু কী নষ্টই হচ্ছে? অনেকে ভালোও হচ্ছে।
আপেল আর মাহমুদ দুই বন্ধু একই কলেজে ভর্তি হয়েছে। নিয়মিত চলছে তাদের কলেজে যাওয়া আসা। আপেলও খুব ভালো ছেলে। সৎসঙ্গ পেলে যেমনটি হয় আর কি। ‘আপেল মাহমুদ’ একনাম মনে হলেও এভাবে ডাকলে দু’জনকেই ডাকা হয়ে যায়। সাহিত্যের ভাষায় যে সম্পর্ককে আমরা মানিকজোড় বলে থাকি। সেরকমই তাদের সম্পর্ক।
বন্ধু! আগামীকাল তোকে একটা সারপ্রাইজ দিবো।
তাই নাকি? ঠিক আছে আমিও অপেক্ষায় থাকলাম।
পরদিন সকালে হঠাৎ আন-নোন নম্বরে রিং এসে বেজে উঠলো আপেলের ফোন।
আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন? বন্ধু! মাত্র এক রাতের ব্যবধানে আমাকে ভুলে গেলি? আমি মাহমুদ। কী আশ্চর্য! ভুলে যাওয়ার কী হলো শুনি? নতুন নম্বর তাই বললাম।
বন্ধু, সারপ্রাইজ!
ততক্ষণে আপেলের বোঝার আর কিছুই বাকি থাকিল না। মাহমুদের হাতে স্মার্ট ফোন উঠেছে।
প্রথমত মোবাইলে শুধু অবসর সময় কাটালেও, ক্রমেক্রমে সে মাত্রা বহুগুণে বাড়িয়ে চলেছে! ইদানীং মাহমুদকে দেখলে অন্য জগতের কেউ মনে হয়। যে জগতে গুগল, ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, ইমো, টুইটরসহ আরও অনেক অনেক বৈজ্ঞানিক প্রাণীরা বাস করে। তাদের সাথে গভীর রাত গল্প করতে করতে অনিচ্ছাতেই ঘুমিয়ে পড়ে মাহমুদ।
মাহমুদ! উঠো আযান হয়েছে। সালাতে চলো?
ওহ্! আওয়াজে ঘুমিয়ে পড়ে আবার।
কী হলো, উঠলে না যে?
আব্বু তুমি যাও! আমি আসছি।
কিছুক্ষণ গড়াগড়ি দিয়ে আবার কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে।
ইদানিং দেরিতেই ঘুম ভাঙছে মাহমুদের। স্মার্টফোন কেড়ে নিয়েছে তার দুপুর রাতের ঘুম। কেড়ে নিয়েছে হাসি-খুশি মনে মা-বাবার সাথে কথা বলা। এমনকি, আদরের ছোট বোনকেও আর সহ্য হয় না!
ভাইয়া ওঠো, ভাত খাও? সময় হয়েছে, কলেজে যাবে কখন?
উহ্! যা তো এখান থেকে, ডিস্টার্ব করিস না?
তাড়াতাড়ি ওঠো! আব্বু এসে বকা দিলে, তখন বুঝবে মজা?
ততক্ষণে মাঈশাকে ডাকছে বাবা।
মাঈশা! মাহমুদ কলেজে গেছে?
ছোট বোন মিথ্যা না বলে একটা কৌশল খেটে বলল,
না বাবা। ভাইয়ার বোধয় মাথা ব্যথা করছে!
তাতো করবেই। দিনরাত মোবাইল নিয়ে থাকতে বলো? মোবাইলটা ভেঙে ফেললেই মাথা ব্যথা সেরে যাবে। এই বলে এগিয়ে গেল মাহমুদের রুমে। গিয়ে দেখল, দুইকানে ইয়ার ফোন লাগিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে মাহমুদ। ওমনি গিয়ে এক ছিটকানি দিলো মোবাইলটা!
আজ থেকে তোমার পড়াশোনা বন্ধ!
অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সবাই। কেউ কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না। কেমনে বলবে? সেতো প্রতিদিন এরকম রাগেনা। কিন্তু আজ?
কদিন হলো, মাহমুদ কলেজে যায়না। মোবাইলও বন্ধ। যোগাযোগ করতে না পেরে আপেল নিজেই এসেছে মাহমুদের বাড়ি।
কী ব্যাপার খালাম্মা? মাহমুদ কোথায়? আজ কদিন হচ্ছে কলেজ যায় না। তাছাড়া স্মার্টফোনের সুইচ অফ?
সে কথা আর বলো না বাবা! আমি ওকে ফোনটা কিনে দিয়ে ভুলই করেছি। রাতদিন শুধু সেটা নিয়েই পরে থাকে। সময়মত সালাতে যায় না। পড়াশোনাও ঠিকমতো করছে না। তাই ওর বাবা রাগ করে কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।
এ’সব কী বলছেন খালাম্মা? মাহমুদ এতটাই পাল্টে গেছে?
হ্যাঁ বাবা। তুমি নিজেই গিয়ে দেখ ওর অবস্থা!
ছি-ছি! মাহমুদ ছি! তোকে নিয়ে সারা গ্রামের মানুষ স্বপ্ন দেখে, গর্ব করে। যে যেখানে সবাই প্রশংসা করে। আর তুই কিনা…?
মাহমুদ কোনো কথাই বলছে না।
ঠিক আছে আজ থেকে তোর মনে তুই, আমার মনে আমি।
এই বলে আপেল রুম থেকে বেরিয়ে আসতেই খালাম্মা তাকে নষ্ট ফোন হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল।
ফোনটা কাউকে দেখিয়ে সেরে নিয়ে ওর ভুল ভাঙলে দিয়ে দিও?
আর ওহে.. শোন! তুমি ওর ভালো বন্ধু বলেই বলছি। ওকে ভালো করে বোঝানোর দায়িত্ব কিন্তু তোমার?
আজ মাহমুদের কাছে স্মার্টফোন নেই। তবুও কী সব যেন ভেবে ভেবে সারারাত ঘুম হয়নি তার। সবকিছুই যেন জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছিল। ধীরে ধীরে মন থেকে সরিয়ে যাচ্ছিল পরিবার বন্ধুবান্ধব। সবকিছুর মূলে সেই ফোনটি। আরও অনেক কিছু ভাবতে ভাবতে খুব অস্থির অবস্থায় কেটে গেল রাত। সে আবার সকলের কাছে আগের মাহমুদ হয়ে ফিরে আসতে চায়। রঙিন প্রভাতে ভুলে দিতে চায়, রাতের ঘন অন্ধকার।
আজ ফজরের আযান ভেসে আসছে তার কানে। সে ফজরের সালাত আদায় করেছে। মা-বাবার কাছে ক্ষমা চেয়েছে। সকাল সকাল কলেজে গিয়ে আপেলের সামনে পড়তেই, আপেল তাকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা …
বন্ধু আমাকে ক্ষমা কর! আমার ভুল হয়েছে। এরকম আর হবেনা।
ঠিক আছে এই নে তোর ফোন?
না বন্ধু, আমি আর ফোন ব্যবহার করব না।
কেন?
না, যার জন্য আমার এতো কিছু।
এসবের জন্য ফোন দায়ী নয়; দায়ী হলো তার অপব্যবহার। ভালো দিকটা ব্যবহার করতে দোষ কোথায়? বরং তোকে প্রমাণ করতে হবে, ‘প্রত্যেক বস্তুর সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে।’ মন্দ দিকটার অন্তরালে লুকিয়ে আছে ভালো দিকটাও।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট