চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

করোনা-দুর্যোগ থেকে মুক্তি কামনায় ভক্তির সিয়াম সাধনা

মনিরুল ইসলাম রফিক

১৬ এপ্রিল, ২০২১ | ১:২২ অপরাহ্ণ

এ যে মাহে রমযান রহমতের দরিয়া / এই দরিয়ায় কাটলে সাঁতার /  গুনাহ যাবে ঝরিয়া ॥…

ইসলামের পাচঁটি বুনিয়াদ- যার অন্যতম হচ্ছে সিয়াম বা সাওম। রমযানুল মোবারকের একটি মাস শরীয়তের দৃষ্টিতে যারা প্রাপ্তবয়স্ক তাদের জন্য সুবহি সাদিকের পূর্বমুহূর্ত থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যাবতীয় পানাহার কামাচার অনাচার ও পাপাচার থেকে বিরত থাকা তথা সিয়াম পালন করা ফরজ। মাসব্যাপী সিয়াম সাধনা মুসলিম জাতির জন্য এক বড় নিয়ামত স্বরুপ। এ মাসের সব অনুষ্ঠানমালা একজন মুসলমানকে যথাযথ অনুশীলনের মাধ্যমে দুনিয়াতে পূর্ণাঙ্গ মানুষে পরিণত করে।

আর আখিরাত জীবনের জন্য অফুরন্ত পুরস্কারের খোশখবরী নিয়ে আসে। গত বছরের মতো এ বছরও করোনা ভাইরাস আমাদের পিছু নিয়েছে। বেড়ে চলেছে সংক্রমনও মৃত্যু হার। চাকরি বাকরি ব্যবসা বানিজ্য সর্বত্র আজ হতাশা বিরাজ করছে। তবুও রহমতের মাস মুসলমানদের সংশোধন হওয়া ও পানাহ পাওয়ার সুযোগ নিয়ে এসেছে। তাই দুআ মুনাজাতের সর্বক্ষেত্রে মুসলমানরা আকুতি জানাচ্ছে: আললাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল বারসী ওয়াল জুনুনী ওয়াল জুঝামি, ওয়া করোনা ভাইরাস, ওয়ামিন সাঈয়্যিল আসকাম। মাহে রমজান নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রাসংগিক বিষয়ের উপর আলোচনায় আসতে চাই।

প্রথমে দেখি সিয়াম শব্দের ব্যাপক অর্থ-  সিয়াম আরবী শব্দ। এর অর্থ বিরত থাকা, আরাম করা, বিশ্রাম করা, উপোস থাকা। ইসলামের অন্য বুনিয়াদ যেমন সালাত ও যাকাতের উল্লেখ কুরআন মজীদের বিরাশির অধিক স্থানে রয়েছে। ঈমান ও হাজ্জ্বের উল্লেখও বেশ আছে। সিয়াম বা রোযার উল্লেখ দেখা যায় মাত্র দু’এক জায়গায়। যেমন সূরা বাকারার ১৮৩ থেকে ১৮৭ আয়াতে। এসব আয়াতে সিয়াম পালনের  নির্দেশ ও বিশদ বিধিবিধান বিধৃত হয়েছে। কুরআন মাজীদের  সূরা মরিয়ামের ২৬ নং আয়াতেও ‘সিয়াম’ শব্দটির উল্লে­খ দেখা যায়। এখানে সিয়াম শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে নিরবতা পালন  বা মৌনতা অবলম্বন অর্থে। ইরশাদ হচ্ছে : (হে মরিয়াম!) সুতরাং আহার কর, পান কর ও চোখ জুড়াও। কোন মানুষকে যদি তুমি দেখ তখন বলবে আমি রহমানের উদ্দেশ্যে সিয়াম পালন করছি- সুতরাং আমি আজ কিছুতেই কোন মানুষের সাথে কথা বলবোনা।’

সিয়াম ও মাহে রমযানের পটভূমি : আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ (স.)’র উম্মতদের জন্য ইসলামের অন্যান্য বিধানের মতো রোযাও পর্যায়ক্রমে ফরজ করা হয়। শুরুতে নবী (সা.) মুসলমানদেরকে মাত্র প্রতি তিন মাসে তিনটি রোযা রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ৬২২ খিস্টাব্দের রবিউল আউয়াল মাসে প্রিয় নবী হযরত (সা.) মক্কা মুয়াজ্জমা থেকে মদীনা মোনাওয়ারায় হিজরত করে আসেন।এরপর একে একে বহু বিধান আল্লাহ তায়ালা নাযিল করতে থাকেন। হিজরতের দ্বিতীয় বর্ষে অর্থাৎ অধিকাংশের মতে ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের শাবান মাসের মধ্যভাগে আল্লাহ তায়ালা সিয়ামের বিধান নাযিল করেন। মহান আল্ল­াহ পাক ইরশাদ করেন : ইয়া আয়্যুহাল লাযীনা আমানু কুতিবা আলাইকুমুস সিয়ামু কামা কুতিবা আলাল লাযীনা মিন কাবলিকুম——।’ অর্থাৎ হে মুমিনগণ! তোমাদের জন্য সিয়ামের বিধান দেয়া হলো যেমন দেয়া হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে। যাতে তোমরা খোদাভীতি অর্জন করতে পারো (২: ১৮৩)।

দ্বিতীয়ত: নাজিল হওয়া বিধানটি হলো এই : শাহরু রামাদানাল লাযী উনযিলা ফীহিল কুরআন অর্থাৎ রমযান মাস হলো সেই মাস , যাতে নাজিল করা হয়েছে কুরআন, যা মানুষের হেদায়েত এবং সত্যপথযাত্রীদের জন্য সুষ্পষ্ট পথ নির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক মাসটি পাবে সে এ মাসের রোযা রাখবে। আর যে লোক অসুস্থ কিন্বা মুসাফির অবস্থায় থাকবে সে অন্যদিনে গণনা পূরণ করবে।

আল্লাহ তোমাদের  জন্য সহজ করতে চান; তোমাদের জন্য জটিলতা কামনা করেননা। যাতে তোমরা গণনা পূরণ কর এবং তোমাদের হেদায়াত দান করার দরুণ। আল্ল­াহ তায়ালার মহত্ব বর্ণনা কর আর যাতে তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পার। (২: ১৮৫)। উপরোক্ত আয়াতে সিয়াম পালনের কেবল সুস্পষ্ট বিধানই আসেনি, বরং সেই সঙ্গে কোন মাসে কোন সময় থেকে কোন সময় পর্যন্ত কিভাবে সিয়াম পালন করতে হবে তারও বর্ণনা এসেছে। উপরন্তু এখানে পবিত্র রমযান মাসে সিয়াম পালনের বাধ্যবাধকতার ও যুক্তি ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, এ রমযান মাসেই প্রথম কুরআন মজীদ নাজিল হয়। গোটা কুরআন মজীদ লাওহে মাহফুজে সংরক্ষিত ছিল। সিয়ামের বিধান নাজিল হবার চৌদ্দ বছর আগে ৬১০ খ্রিস্টাব্দের ২৭ রমযান রাতে আল্ল­াহ জাল্লাহ শানুহু এই মহান কিতাব লাওহে মাহফুজ থেকে নাজিল করেন। হেরা গুহায় গভীর রাতে প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ (সা.) এর নিকট ফেরেসতা হযরত জিব্রাইল (আ.) তা বহন করে আনেন। সেদিন হযরত (সা.) নবুয়ত ও রিসালাতের অভিষেকে অভিষিক্ত হন। ঐ রাতেই কুরআন শরীফ প্রথম আসমানে রাখা হয় এবং পরবর্তীতে আস্তে আস্তে অংশ অংশ করে প্রয়োজনানুসারে তা হুজুরের (সা.) নিকট প্রায় ২৩ বছর ধরে নাজিল হতে থাকে। (নুরুল আনোয়ার)।

সিয়াম সাধনার ফজিলত:  সিয়াম অর্থ শুধু রোযা বা উপবাসব্রত পালনই নয়, এর অর্থ আরো ব্যাপক। উপবাসব্রত পালনের সাথে সিয়ামে থাকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ করণীয়। এসব অনুশীলনের মধ্যে সিয়াম সাধনার পূর্ণতা নিহিত। যারা এগুলোর কোনটির প্রতি শৈতিল্য প্রদর্শন করলো , তাদের রোযায় অসল খৎরা বা লোকসানী। এ মাসে একেত উপবাসের মর্মপীড়া; এর উপর রয়েছে দিনেরাতের সুনির্দিষ্ট ইবাদতের তাগিদ। সব মিলিয়ে একটা যেন পরীক্ষাক্ষেত্র। বস্তুত এ পরীক্ষাক্ষেত্রে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হতে পারাই মুমীনে জীবনের বড় সফলতা। এ মাস কষ্টের মাস, এ মাস সাধনার মাস, এ মাস পরীক্ষার মাস বলেই আল্ল­াহ পাকের কাছে সিয়াম সাধনার মূল্য অনেক। তাই আল্লাহ বলেছেন; ‘যেহেতু এই সিয়াম সাধনা একমাত্র আমার জন্যই করা হয়ে থাকে , সেহেতু আমি  নিজ হাতেই এর পুরস্কার দেব। হাদীস শরীফে আছে , ‘কিয়ামতের দিন অন্যান্য লোকজন যখন হিসেব নিকেশ বুঝিয়ে দেয়ার ব্যাপারে দারুন উৎকন্ঠায় থাকবে তখন রোযাদাররা এক সুশীতল ছায়ায় বসে সানন্দে পানাহার করবে। উৎকন্ঠিত লোকেরা বলবে এ কি ব্যাপার ! আমরা হিসাব দিতে হয়রান অথচ তারা কিনা দিব্যি পানাহার করছে।’ তখন উত্তর আসবে দুনিয়াতে যখন তোমরা সানন্দে পানাহারে মত্ত ছিলে তখন এরা আল্ল­াহর উদ্দেশ্যে রোযা রেখে ক্ষুৎ -পিপাসার যন্ত্রণা সহ্য করেছিল।

লেখক: মনিরুল ইসলাম রফিক অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতীব।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট