চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

খোলা চোখে সমগ্র

কায়েস আহমেদ

রহমান মতি

১৪ জুন, ২০১৯ | ১:২৭ পূর্বাহ্ণ

স্বল্পায়ু শিল্পীরা বোধ হয় শিল্পের বহু স্রােতের মধ্যে অল্পকে স্পর্শ করেই হয়ে ওঠেন অধরা। সে অধরা মাধুর্যের ভেতরের অবলোকনসূত্র আমাদের পাঠকে অপূর্ণ করে দেয় কখনও সখনও। সেই স্বল্পায়ু শিল্পীর একজন কায়েস আহমেদ, যিনি পাঠকের অবলোকন সূত্রকে জাগিয়ে দিয়ে একটি লাশকাটা ঘর, দিনযাপন, নির্বাসিত একজন, অন্ধ তীরন্দাজ লিখেই চলে যান। আমরা অপূর্ণ হই কারণ এ রকম শিল্প আরও কেন পাব না সেজন্যই। আরও পাবার অধিকার পাঠক রাখেন। কায়েস আহমেদ ষাটের দশকের শিল্পী যার প্রভাব আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহদের মতো অল্প লেখাতে বিস্তৃত ও স্থায়ী সাহিত্যিক আসনে বেষ্টিত।
কায়েস আহমেদের সমগ্র জীবন ও সাহিত্য বেদনামিশ্রিত জৈবনিক আখ্যান। জীবনের বাস্তবতাকে সাহিত্যে প্রতিফলিত করেছেন। যা লিখেছেন অভিজ্ঞতা থেকে, কখনও বা রহস্যজনক মানব অভিজ্ঞতার না জানা কথামালার মতো করেও। গল্পকার হলেও উপন্যাসে তিনি কুশলী শিল্পী। শিল্পীর বেদনাই মহৎ শিল্পের আবিষ্কারকে ইঙ্গিত করে কায়েস আহমেদ তাঁর সাক্ষী। অন্ধ তীরন্দাজ (১৯৭৮), লাশকাটা ঘর (১৯৮৭) দুটি গল্পগ্রন্থ; নির্বাসিত একজন (১৯৮৭), দিনযাপন (১৯৮৬) দুটি উপন্যাস, কিছু অগ্রন্থিত সাক্ষাৎকার, কবিতা, প্রবন্ধ নিয়ে সমগ্র কায়েস আহমেদের ব্যাপ্তি। সব জায়গায় তাঁর নিজস্বতা বৈশিষ্ট্য অনুসারে এসেছে।
‘অন্ধ তীরন্দাজ’ মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী দেশকাল আবহের চিত্র। সময়কে ধারণ করার গভীর আগ্রহ সেখানে। ‘বন্দী দুঃসময়’ গল্পে অস্তিত্ব রক্ষাকে পিঁপড়ার গ্লাসবন্দী অবস্থা এবং জলের মধ্যে সাঁতার কাটার দৃশ্যায়নে দেখানো হয়েছে। বাবলু দেখে যায় দেশে বন্যায় ফসল নষ্ট হয়েছে। মিল-কারখায় উৎপাদন নেই, বেকার সমস্যা বাড়ছে। জনসংখ্যা রোধ করা জরুরী। তাই, আশ্চর্যভাবে কায়েস আহমেদ গল্পে সমাধান দেন। শুধু পরিবার-পরিকল্পনা নয়, স্বামী-স্ত্রীর যৌন মিলনও বন্ধ রাখা উচিত এবং স্বামী-স্ত্রী পর¯পরকে যেন ভাই-বোন ভাবে। এ বোধ গল্পের শক্তি ও নতুন ভাবনা। সব থাকতেও বাঁচতে ভাল লাগে না সগুর তাই ‘অন্ধ তীরন্দাজ’ সে। ‘গন্তব্য’ গল্পে গাছের গুঁড়ির মাঝামাঝি করাত দেখে লেখক ভাবছেন এটা মানুষের মাথা থেকে বুক পর্যন্ত চিরে রেখেছে কেউ। ‘সম্পর্ক’ গল্পের দুই বন্ধুর সম্পর্ক ও মানসিক দূরত্বকে ঘিরে সহজাত বৈশিষ্ট্যের ব্যাখ্যা ব্যক্তিক কথা বলে। অন্ধ তীরন্দাজ গল্পগ্রন্থটি পারস্পরিক ব্যক্তি-দূরত্ব, দেশকালের কঠিন দুর্দিনে সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষের কথামালা।
‘লাশকাটা ঘর’ কায়েস আহমেদের বহুল প্রচারিত, বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত এবং কথাসাহিত্যে বাঁক প্রবর্তিত গল্পগ্রন্থ। প্রতিটি গল্পই মানবিকভাবে এগিয়ে থাকে। ভরাট বেদনার আর্তি সব সময়ই গল্পগুলোর ভেতরের শাঁসকে তাজা রেখেছে। প্রথম গল্প ‘পরাণ’-এ হরেন্দ্র মাঝি যখন বলে- ‘শ্যাক সাবরে ভোট দিলাম সুখে থাকনের লাইগ্যা। নয়টা মাস কুত্তা-বিলাইয়ের মতন পরাণ লইয়া পলাইয়া পলাইয়া কাটাইছিলাম’- কথাটা অত্যন্ত মূল্যবান হয়ে ওঠে রাজনৈতিক সত্যরূপে। তৃণমূলের স্বাধীনতার অবসান ও স্বাধীনতা পরবর্তী ‘চোর দাউরের রাজত্ব’-কেই বাস্তব মানতে হয়। পদ্মচরণকে আঘাত করে একটা মেয়েকে নিয়ে যায় আর তার আর্তি- ‘আমার মাইয়ারে ছাইরা দ্যাও, তোমরা আমার বাবা।’ সম্ভ্রমহানি যে পাকিস্তানীদের বৈশিষ্ট্য ছিল তা ফুরায়নি। মূলত যে পরাণ স্বাধীনতা চেয়েছিল সেই পরাণ স্বাধীনতা পেয়েও পরাধীন কারণ দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে স্খলন ঘটেছে। সুরেন বাবা ভরত কোলের গড়ে তোলা ইমেজ থেকে রক্ষা পায়নি ‘মহাকালের খাঁড়া’ গল্পে। ভরত রাজনীতি থেকে দূরে থাকলেও সম্পত্তি বা টাকার নেশা ভরতের আছে। শ্রেণীশত্রু হিসেবে বাবার পাশাপাশি ছেলেও তাতে নিশানা হতে পারে। সুরেন মদ খেয়ে যখন সবিতার ঘোরে মত্ত তখনই চার বন্ধুর নিশানা হয় সে। যখন মৃত্যু আসন্ন সুরেন বউয়ের বাচ্চা হবার দোহাই দিলেও বন্ধু হরি বলে- ‘তাহলে তো শালার যন্তরটাই সাবড়াতে হয় আগে।’ লিঙ্গ কেটে ফেলা হয়। লেখকের বর্ণনা- ‘শিশ্নটিকে বড় নিঃসঙ্গ দেখায়।’ বলি হওয়া সুরেন ভরতের জীবনকে নতুন অভিজ্ঞতায় আনে। অন্তর্গত রাজনীতি সেটাই যা ক্রমান্বয়ে আসে বাবা থেকে ছেলে। ‘দুই গায়কের গল্প’ বা ‘নিয়ামত আলীর জাগরণ’ গল্প দুটি নকশাল আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে। হরিদাস মারা যায় পুলিশের গুলিতে। পুলিশ নিয়ামত আলীকে বলে- ‘ইউ ব্লাডি নক্সালাইট’। ১৯৬৭ সালের মার্চে পশ্চিমবঙ্গে তরাই-এর নকশালবাড়ি, খড়িবাড়িতে নকশাল কৃষক আন্দোলনের জন্ম হয়। কৃষক থেকে শহরের ছাত্র, যুবক, বুদ্ধিজীবীরা এর সমর্থক হয়। ষাটের শেষে ও সত্তরের সময়ে তীব্রতর হয়। সামন্তবাদিতার বিরুদ্ধেও এ আন্দোলনের অবস্থান প্রধান ছিল। মহাশ্বেতা দেবীর হাজার চুরাশির মা উপন্যাসের মা যখন সন্তানের লাশ নির্ণয় করতে যান তখন লাশের সংখ্যায় তিনি হন হাজার চুরাশি। এই বাস্তবতা যেমন রাজনৈতিকভাবে স্বাদেশিক তেমনি মানবিকও। পাগল ও সুস্থ মানুষের মধ্যে পার্থক্য খুঁজতে কায়েস আহমেদ যান ‘পারাপার’ গল্পে। তাঁর বক্তব্য সুস্থ থাকাতে কেউ কেন পাগল বলে না? চাঁদের কলঙ্ককে সমাজের মনে করে গগন নিজে তা সারাবার জন্য মলম ব্যবহার করে অথচ সামাজিক সমস্যা থেকে পলায়নবাদী বীরেন ডাক্তার তাঁর দায়িত্ব এড়ান। মলম দেন রোগ সারাতে কিন্তু সমাজকে রোগমুক্ত করতে চান না। ‘গগনের চিকিৎসা তৎপরতা’ গল্পটি গগনের মৃত্যুতে সামাজিক বক্তব্যের গল্প হয়ে ওঠে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কায়েস আহমেদের প্রিয় লেখক ছিলেন। দায়বদ্ধতা থেকেই ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৈতৃক ভিটে ও মালপদিয়ার রমণী মুখুজ্জে’- গল্পটি রচিত হয়েছে। বিমল রমণী মুখুজ্জের পুত্র। বিমল পিতার মৃত্যু কামনা করে কারণ তাতে সে ভিটা ছেড়ে রক্ষা পেত। এর পেছনে দেশভাগ ক্রিয়াশীল। আবার বাড়ি পৌঁছে যখন হিন্দু-মুসলমান পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন ওঠে তখন সাম্প্রদায়িক কারণও বড় হয়ে ওঠে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পূর্বপুরুষ ও উত্তরপুরুষের মধ্যকার অবস্থান, দেশভাগ, সাম্প্রদায়িকতা, মানসিকতা ইত্যাদির একটি ডকুমেন্টেশন হয়ে ওঠে গল্পটি। অসাধারণ গল্প ‘নচিকেতাগণ’। জেলখানার প্রথম দিনের ভয় ও ধীরে ধীরে অন্যান্য দিনের ভয়ের মধ্যে যে পার্থক্য এটির মাধ্যমে সূত্রপাত। কথক আতিকের ধরে নিয়ে যাওয়া, নির্যাতন করার নমুনা দেখে নিজের পরিণতি নিয়ে ভাবে। সঙ্গে অন্যদের নিয়েও ভাবে। শেষে একটা চড়–ই পাখিকে দেখে বলে তার থেকেও তারা স্বাধীন কারণ তারা অবাধে মৃত্যুর ভয়কে জানতে পারছে এবং স্বাদেশিকতা তার ভেতরের কথা। পুরো গল্পের আবহ মিথকেও ধারণ করে। ‘নচিকেতা’ হলো উপনিষদীয় শব্দ। নচিকেতা বাবার সঙ্গে কথোপকথনের পর যমপুরে যায়। যম তাকে ৩টি বর দেন। তৃতীয় বরে নচিকেতা আত্মার স্বরূপকে জানতে চায়। নচিকেতার অর্থ ‘যে জানেনি’। এর অর্থ জানার আগ্রহ যার প্রবল। গল্পের কথক ও বাকিরা কিংবা আতিকসহ স্বদেশের নানা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা সেই নচিকেতাগণ। স্বপ্ন দেখতে সাহস পায় না এমন মানুষ জগতে অনেক। ‘প্রতারক জোসনা’-র অঞ্চলি তেমন মানুষ। ‘গোপাল কামারের তলোয়ার’ গল্পে নাতির আবদারে গোপাল যে তলোয়ার বানায় সেই তলোয়ার লুকানোর জন্যই তাকে সংগ্রাম করতে হয়। কারণ সময়টা নকশাল আন্দোলনের। ‘লাশকাটা ঘর’ গল্প চরমভাবে স্খলন, মূল্যবোধ নষ্ট হওয়া সামাজিকতার ওপর। কালীনাথ ইনজেকশন ফোঁড়া পছন্দ করে না তাই গিরিবালা স্বামীর এ বিষয়কে বজ্জাতি বলে। বলে- ‘গোয়ার নাই চাম, রাধাকিষ্ট নাম’। মনোতোষ মাস্টারি ও রাজনীতি করে। জয়ার রাজনীতি পছন্দ না। নিশিকান্তর বউ হৈমবতী ভাবে জয়ার সুখ অনেক কিন্তু জয়ার বক্তব্য- ‘হ মানুষ বাইর যাইক্যা ওইটাই দ্যাখে’। অন্তর্গত সত্যকে নির্দেশ করে। নিশিকান্ত জানে মনোতোষ সুবিধাবাদী। যে কম দামে জমি কিনে অপেক্ষা করে দাম বাড়ার জন্য। তাই সুবিধাবাদিতার জন্য তার প্রশ্ন- ‘সমাজতন্ত্র কারে কয়?’ সর্বানীর স্বামীর মাতাল হওয়া জয়ার পছন্দ নয় তাই সর্বানী বলে, নিজের পয়সায় খায়। গিরিবালা অভিযোগ করে কালীনাথ তার বাপ-দাদার ভিটাও রক্ষা করতে পারেনি তাই মুসলমানরা ভোগ করছে। তৎকালীন সুবিধাবাদ কিভাবে উভয় সম্প্রদায়ের ভেতরে চাউর হয়েছিল সেও বড় বাস্তবতা এখানে। নিশিকান্ত ভাবে মহিলাদের কাজ খালি গর্ভবতী হওয়া, খাওয়া, ঘুমানো। মনোতোষ জয়াকে বলে তার আচরণের জন্যই মনোতোষের বাবা বাড়িতে আসে না। জয়া মানতে পারে না। সর্বানীর স্বামী বাসুদেব মাতাল হয়ে সর্বানীর বস্ত্রহরণ করে আর ছেলে ঘুম থেকে উঠে তার মাকে উলঙ্গ দেখে। বাসুদেব কুকুরের মতো সর্বানীকে ভোগ করে। কালীনাথ হতাশ হয়ে মরতে চাইলে গিরিবালা বলে- ‘মরতে চাইলে একাই মরণ লাগবো, বুছছো, অখন আর সহমরণ নাই।’ গল্পে দৃশ্যগুলো স্খলনের, পার¯পরিক দূরত্ব, মূল্যবোধের ফাঁকির, পলায়নবাদিতার, আদর্শহীনতার দৃশ্য হয়ে ওঠে। তারা সবাই জীবন্মৃত এবং প্রত্যেকের সংসার এক একটা ‘লাশকাটা ঘর’।
নির্বাসিত একজন উপন্যাস নিয়ে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সংস্কৃতির ভাঙা সেতু গ্রন্থে ‘জতুগৃহে দিনযাপন’ নামে প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘কিন্তু কি গল্প বলার রীতি, কি চরিত্রের সঙ্গে স¤পর্ক, কি দৃষ্টিভঙ্গি সব ব্যাপারেই দুটি লেখায় লেখকের ভিন্ন স্বভাবের পরিচয় পাই।’ উপন্যাসটি নতুন টেকনিকের। উপন্যাসের মধ্যে গল্প সংযোজনের ভঙ্গি নতুন। নির্বাসিত একজন এবং জগদ্দল দুইভাগে বিভক্ত। দেশভাগ উপন্যাসকে করুণ বাস্তবতায় টানে। খোকার মা, ভাই, বোন সব হারাবার পর দেশভাগে ‘রিফ্যুজি’ হবার অভিজ্ঞতাই মূলত নির্বাসনকে ইঙ্গিত করে। ইতিহাস ও রাজনৈতিক মতাদর্শে কায়েস আহমেদ তাঁর শিল্পীস্বভাবকে একটি কাঠগড়ায় দাঁড় করান। কারণ, ইংরেজ তাড়িয়ে, হিন্দুস্তান, পাকিস্তান করেও যদি রিফ্যুজি হতে হয় তাহলে মুক্তি আসলে কোথায়? পরে খোকা অজিতকে ড্যাগার দিয়ে হত্যা করে এবং বলে- ‘আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলাম নিজের জন্যেই, খুনও করেছিলাম নিজের জন্যেই।’ পরে উপন্যাসে ‘জগদ্দল’ গল্পটি আসে রাজনৈতিক বোধ থেকে। পাকিস্তান বা ইন্ডিয়া এদের মধ্যে হিন্দু-মুসলামান নাই এরা বাঙালির দুই চোখের বিষ এটা মনে করে বিষ্ণুপদ। সে বলে, সুভাষ বোস থাকলে কী পাকিস্তান হতে পারত? জিন্না, লিয়াকত, নেহেরু সব ভেসে যেত কারণ আজাদ হিন্দ ফৌজ প্রায় এসে পড়েছিল। এখানে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের চিহ্ন উপন্যাসের কথাও প্রসঙ্গক্রমে বলা যেতে পারে। আজাদ হিন্দ-ফৌজ আন্দোলনসূত্রে এ উপন্যাসের হেমন্ত, অজয়, রসুল, যাদবরাও তেমনই।
গালির ব্যবহার এসেছে। যেমন- বাঞ্চোত, বোকাচোদা, চুতমারানি, শুয়োরের বাচ্চা, চ্যাটের ফাজলামো ইত্যাদি।
দিনযাপন উপন্যাসও বিপ্লবী সময়ের আখ্যান। এখানেও মনোতোষ, জয়া, নিশিকান্তরা চরিত্র হয়ে আসে। রাজনৈতিকভাবে সুবিধাবাদী শ্রেণীর উত্থান, রাজনীতি করে আদর্শের বড়াই করা, অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বলা, সাম্প্রদায়িক সূক্ষ্ম মনোভাব পোষণ করার বাস্তবতা এ উপন্যাসে রয়েছে। নিশিকান্ত হাবিব নামের ছেলে সম্পর্কে বলে সে নাকি মুক্তিযোদ্ধা ছিল। কিন্তু ১৯৭১-এর পর তো রাজাকারও নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে। হাবিব বাড়ি দখল করে মদ, নারীর আড্ডা জমায়। মনোতোষ প্রচার করে- ‘মানুষ বুঝতে শিখতাছে, অর্থনৈতিক মুক্তি ছাড়া…..’। তার অস¤পূর্ণ কথা অস¤পূর্ণ নয় বরং নিজের অবস্থান ঠিক রাখার জন্যে বলা। কায়েস আহমেদের এ দুটি উপন্যাসের মধ্যে সাদৃশ্য হলো দুটি উপন্যাসই পরিবর্তন দাবি করছে। যে সমাজটি আছে তা কলুষিত হয়ে গেছে তাই পরিবর্তন দরকার।
কায়েস আহমেদের অগ্রন্থিত রচনার মধ্যে উপন্যাস, প্রবন্ধ, কবিতা, সাক্ষাৎকার আছে। প্রশান্ত মৃধার স¤পাদনায় অগ্রন্থিত রচনা : কায়েস আহমেদ প্রকাশিত হয়েছে। প্রশান্ত মৃধা লিখেছেন- ‘আমাদের তো জানা আছে, জীবন আর সাহিত্যের ভেতরে কায়েস আহমেদ কোনো ফাঁক রাখেননি।’ এটি যথার্থ মূল্যায়ন। জীবনই কায়েস আহমেদের শিল্পসন্ধানের উপাদান। আয়তনে ছোট উপন্যাস কতিপয় মৃত স্বপ্নের চোখ। মধ্যবিত্ত সাংসারিক ক্রাইসিসে আশফাক চৌধুরীর স্বপ্নের দোলাচলের বিষয়। মেজো ছেলে তার বউকে চুমু খাচ্ছে। এটা আশফাক চৌধুরীর যৌবনকে স্মরণ করায় তাই বউ হিসেবে আমেনাকে তার আরো বেশি রোমাঞ্চসমৃদ্ধ মনে হয়নি। আমেনা তেমন নয়। মেয়েও বিয়ে করতে চায় না কারণ জীবনে একটা মন্দ স্মৃতি আছে। মেয়ের বিয়ে দিয়ে শান্তিতে মরতে চান আশফাক চৌধুরী। মেয়ের বাস্তবতাকে উপলব্ধি করে অন্য এক সংসারী ব্যক্তির চোখ থেকে। এভাবেই চরিত্রগুলো বেদনার স্বপ্নের বুনন হয়ে উঠেছে।
অবাক হয়ে কায়েস আহমেদের প্রবন্ধ পড়তে হয়। বিষয়, বিশ্লেষণ ও পাঠের গতিতে প্রবন্ধগুলো চমৎকার। কায়েস আহমেদ তুলনামূলক বিশ্লেষণে দৃষ্টি দেন। ভেতরের কথা ঘেঁটে বের করা তা সহজাত। লেখক ও শিল্পীর দৃষ্টিকোণ নিয়ে লিখেছেন ‘ঘূর্ণির টান ও নিরাবেগ বোঝাপড়া’। মধ্যবিত্তের বিবর্তনকে উত্তরাধিকারসূত্রে চর্চিত ও মূল্যায়িত করে আমরা ব্যবহার করি। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ইতিহাস ‘লেখাপড়া করে যে গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সে’-এ ধরনের কাব্যময়তার মাঝে মুখস্থ করি ইতিহাস মুখস্থের মতো করে। কায়েস আহমেদ মানিক, তারাশঙ্কর, অদ্বৈত মল্ল বর্মণের মধ্যবিত্ত চেতনার কথাও বলেন নিম্নিবত্তে টলস্টয়ের কথা বলেন যিনি সামন্ত প্রথার উচ্ছেদ চাইতেন এবং কৃষককে গুরুত্ব দিতেন। মধ্যবিত্ত আচরণ কিভাবে বিবর্তিত তা বলেছেন, ‘আমাদের দেশের কলকারখানার যে শ্রমিক সে শ্রমিক ক্ল্যাসিকাল শ্রমিক নয় তাঁরাও উঠে এসেছেন কৃষিনির্ভর জীবন থেকে। তাঁর মনের ভেতরও রয়ে গেছে জমির ক্ষুধা, যুক্ত হয়েছে নানারকম মধ্যবিত্তের ঝোঁক।’ তাই লেখাপড়া করেই গাড়ি-ঘোড়ার শখ করায় মধ্যবিত্ত কেন্দ্রিক জটিলতা বিদ্যমান থেকেছে। শক্ত অবস্থান ব্যক্ত করে ‘শিল্পের দাবি, শিল্পীর দায়’ প্রবন্ধটি। মানবতার সমার্থকতা যদি হয় সাম্যবাদ তাহলে মার্কসবাদ কোন পৃথিবীকে বাণী শোনায় এবং প্রয়োগের জন্য ব্যস্ত হয় এটাই কায়েস আহেমেদের জিজ্ঞাসা। উত্তরাধুনিকতা নিয়ে তাঁর অভিযোগ এটি যা কিছু ক্ল্যাসিক তাকে ধ্বংস করে। এমনকি মার্কসবাদী দ্বান্দ্বিকতাকেও তিনি প্রশ্নবিদ্ধ করেন। পুঁজি ও প্রগতি-ই তো দ্বন্দ্ব তৈরি করে। সমাজ ও ইতিহাসে যে দ্বান্দ্বিকতাকে মার্কসবাদ প্রযোজিত করে সাহিত্যে তা করে না। একে তিনি উদ্ভট যান্ত্রিকতাও বলেন। সাহিত্যিক-সাংবাদিক নতুন চিন্তায় লেখা প্রবন্ধ ‘স্বপ্ন আশার আসমানদারী’। কায়েস আহমেদ বলেন, ‘সাংবাদিকতা সাহিত্যের শত্রু’। পেশাগত দিকটি যখন সাহিত্যকে আক্রমণ করে তখন স্খলন ঘটে। সাংবাদিকতা করেও বড় সাহিত্যিক হয়েছেন এমন সাহিত্যিকদের নামও তিনি স্মরণ করেন। আল মাহমুদ, শামসুর রাহমান, আহসান হাবীব এরা সাহিত্যিক সত্তাকে সাংবাদিক সত্তায় মেলাননি। তিনি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর একটি চিঠির কথা উল্লেখ করেন যে চিঠি শওকত ওসমানকে লেখা, তাতে ছিল- ‘আমার ইচ্ছা সাংবাদিক কাগজের রিপোর্টারের উর্ধ্বে ওঠা। তোমরা কী চাও সাহিত্যিক রিপোর্টার হয়েই থাকুক। তাহলে কষ্ট করে লেখার প্রয়োজন কী?’ কায়েস আহমেদ এ চিঠির উল্লেখ করেন অনুসন্ধান হিসেবে। সাহিত্যিক ও সাংবাদিক ক্ষেত্র অনুসারে প্রয়োগ হয়। ওয়ালীউল্লাহ কিছুদিন সাংবাদিকতা করেছেন কিন্তু তাঁর সাহিত্যিক ক্ষেত্রকে ঐ ক্ষেত্র দ্বারা সঞ্চালিত করেননি। সাহিত্যিক সত্তার কাছে তাঁর সাংবাদিক সত্তা বড় হয়নি। ‘ছোটগল্পের দুঃসময়’ প্রবন্ধটি সময়োপযোগী বক্তব্যের। ষাটের দশকে কবিতার পাঠকবৃদ্ধি ও ছোটগল্পের প্রকাশনা কম হওয়ায় তিনি বলেন, ‘আসলে গল্প সম্পর্কে আমাদের দেশের প্রকাশককুলের এক ধরনের হাস্যকর ম্যানিয়া রয়েছে।’ নিজের অবস্থান পরিষ্কার করে বলেন নিজে গল্পকার বলে তিনি বলছেন না, বলছেন গল্পের প্রচার, বিকাশ, প্রকাশকদের মানসিকতাগত পরিবর্তনের জন্যেও। বাণিজ্যিক দিককেই লিটল ম্যাগাজিন যদি ধ্রুব ভাবে তাহলে তার সার্থকতা থাকে না। ‘লিটল ম্যাগাজিনের সমস্যা’ প্রবন্ধের বক্তব্য এ রকম। ‘সাহিত্যে বাস্তবতা’ প্রবন্ধে বলেছেন নতুন কথা। ১৯৭০-পরবর্তী বাংলাদেশ ও পূর্বের বাংলাদেশ আকাশ-পাতাল পার্থক্য। পরিবর্তিত বাস্তবতাকে নতুন আঙ্গিকে ধরতে ঐ বাস্তবতাকে বুঝতে হবে কারণ তিনি বিশ্বাস করেন সমাজবাস্তবতা ভেতর ও বাইরের বাস্তবতা। ‘কঠিন মাটি ও শক্ত ফ্রেম’ প্রবন্ধে হাসান আজিজুল হকের নির্বাচিত গল্প (১৯৮৭) নিয়ে বলেছেন, ‘হাসানের কোনো পুনরাবৃত্তি নেই, প্রথম গ্রন্থ থেকে এখন পর্যন্ত সর্বশেষ গ্রন্থের বিষয় ও প্রকাশরীতিতে প্রতিটি গ্রন্থেই স্বতন্ত্র।’ হাসান আজিজুল হকের কাছে থেকে তিনি উপন্যাসও আশা করেছেন প্রবন্ধে। আমরা আগুনপাখি এবং সম্প্রতি প্রকাশিত সাবিত্রী উপাখ্যান নামে দুটি উপন্যাস তাঁর কাছে পেয়েছি।
কায়েস আহমেদ ভরাট অনুভূতির কবি। গদ্যের ঢঙ আছে, অন্ত্যমিল আছে কোথাও। বলে যান কথকের মতো নিজেই। ‘যেটুকু আমি তার বেশি আমি নই/আমার চোখ দুটো আমারই চোখ, দুহাতের দশটি/আঙুল আমারই আঙুল/আমি তাদের ভালো করে চিনে নিতে চাই’ (বোঝাপড়া)। শরীরের অঙ্গ-প্রত্যক্ষ ‘আমি’-কে মৌলিকভাবে নির্ণয় করেছে এবং শেষ জিজ্ঞাসা ঐ ‘আমি’-র কাছেই। নস্টালজিক আবহে আসে ‘কোথায় লুকাবে তুমি?/যেখানেই যাও/ফেলে আসা দিনগুলো/তোমার সঙ্গে যায়’ (নিজের সঙ্গে কথা)। সরলভাষা এবং উপলব্ধিতে মানসভ্রমণকে যাপিত জীবনের সঙ্গে প্রকাশ করেছে।
সাংকেতিক দৃষ্টিভঙ্গিও কবিতায় এসেছে। যেমন- ‘পরাধীনতার মতো ঘৃণ্য/তোমার কাছে কিছু নেই/স্বাধীনতার মতো প্রিয়/তোমার কাছে কিছু নেই’ (দ্বৈরথ)। ছোট কোন শব্দ ব্যবহারে সাংকেতিকভাবে বড় ব্যাখ্যা দেন এভাবে- ‘পাখিরা সব জানে/তাদের বুকেও সুখ-দুঃখ আছে/জন্ম মৃতু; মিথুন আনন্দ- সব জানে তারা’ (পাখিরা সব জানে)। গদ্যে কায়েস আহমেদ অন্ধ তীরন্দাজ বা লাশকাটা ঘর- এর মধ্যেও কাব্যিকতাকে ব্যবহার করেছেন। কবিতার ছোট ছোট বাক্যে বিস্তৃত জীবনদৃষ্টি দেখে মনে হয় কায়েস আহমেদ কবিতা লিখলে খারাপ হতো না।
সাক্ষাতকার গ্রহণ করেছেন হাসান আজিজুল হক, আলাউদ্দিন আল আজাদ, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর-এর মত বড় লেখকের।
অতঃপর কায়েস আহমেদ মৃত্যুবরণ করেন আত্মহত্যায়। তিনি কেন আত্মহত্যা করলেন তা নিয়ে নানা কথা হয়েছে। সুশান্ত মজুমদারকে লেখা চিঠিতে কায়েস আহমেদের অন্তরঙ্গ বন্ধু কামাল বিন মাহতাব নানা কথার অবতারণা করেন। সূত্রাপুর থানার ওসি যখন কায়েস আহমেদের মৃত্যুকে ‘আনন্যাচারাল ডেথ’ বলেছেন কামাল বিন মাহতাবের কষ্ট হয়েছিল। ব্যক্তি জীবনের বন্ধু-বান্ধব, স্ত্রী জানুর হিস্টিরিয়া রোগ, অপর্ণা নামে মেয়েটিকে না পাওয়া ইত্যাদিকে যখন লোকে মৃত্যুর কারণ হিসেবে দেখান সেখানেও আপত্তি তোলেন তিনি। তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক মানুষের মধ্যে ইনস্যানিটি আছে। অনুকূল পরিবেশে তা জেগে উঠলে অবাক হওয়ার কিছু নেই কিংবা চারপাশের শোষণ-বিকৃতি দেখেও আমরা যখন দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিই এমন মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার বদলে মৃত্যুর মুক্তিই ভালো।’ এ জন্যও হতে পারে। এমনকি তিনি জীবনানন্দ দাশের ‘আট বছর আগের একদিন’-এর লোকটির কথাও বলেন যিনি ‘বিপন্ন বিস্ময়’ সন্ধানী ছিলেন, কায়েসও তেমনই বাস্তবতার শিকার।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সংস্কৃতির ভাঙা সেতু-তে ‘মরিবার হলো তার সাধ’ প্রবন্ধে কায়েস আহমেদ সম্পর্কে বলেছেন, ‘ফাল্গুনের তখনো ঢের দেরি, অথচ কায়েস আহমেদ সিলিং ফ্যানে সটান ঝুলে আত্মহত্যা করেছেন তখনই।’ সত্যি তো এটাই, কায়েস আহমেদ বাংলা কথাসাহিত্যে ফাল্গুনের দ্যুতি ছড়িয়ে চলে গেছেন রহস্য হয়ে। তাঁর জীবনে সেই ফাল্গুন ছিল না।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট