চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

পাষ- ভালোবাসা

আহমেদ মনসুর

৩১ মে, ২০১৯ | ২:০৪ পূর্বাহ্ণ

ছেলেটি যে এত ভালো ছিলো, মরে গিয়ে যদি প্রমাণ না করতো ইহ জনমে তবে আমার তা জানাই হতো না। অথচ আমার পাশের বাড়িতেই থাকতো সে। বেঁচে থাকতে সবাই ওকে গালিই দিতো শুধু। আফরোজার কপাল নাকি ভেঙেছে সে। অলক্ষ্মী কিংবা লক্ষ্মীছাড়া ছেলে। ঘর থেকে বের হয়ে প্রথমেই তার চেহেরা যদি দেখতো পুনরায় ঘরে ফিরে যেত সবাই, অমঙ্গল হওয়ার ভয়ে। সমাজের সবারই ছিলো তার প্রতি এমনই মনোভাব। মরার পর এখন সকলেই তার প্রশংসায় যেন পঞ্চমুখ।
রাতুল হাসান। কত শখ করে ছেলের নাম রেখেছিলো আফরোজা খানম। বাপের নামের সাথে মিলিয়ে। রাতুলের বাবার নাম মেহেদী হাসান। বিয়ে করে রাতুলকে আফরোজার গর্ভে দিয়েই মেহেদী চলে যায় জার্মানীতে। বিয়ের আগেও সে জার্মানিতে ছিলো বেশ কয়েকবছর। পড়ালেখার পাশাপাশি টুকটাক চাকরী-বাকরী করতো। ডিগ্রী শেষ করে একটা কোম্পানীতে স্থায়ী চাকরী ঠিক করেই দেশে এসেছিলো বিয়ে করতে।
বউকে দেশে একা ফেলে রেখে যেতে তার একদমই ইচ্ছা ছিলো না, তবুও চলে যেতে হলো। তবে কাজে যোগ দিয়েই দেখলো ওখানে কয়েকজন বাঙালি আছে। এদের মধ্যে একজন আবার মেয়ে, বেশ সুন্দরী। মনে মনে খুশি হলো সে। মেয়ের নামটাও জম্পেশ, রোদেলা ঈশান। একটু গায়ে পড়া স্বভাব। মেহেদীর খুব পছন্দ হয়ে গেল। রোদেলারও মেহেদীকে মনে ধরে যায়।
মেহেদী প্রথমে ভেবেছিলো বউকে ছেড়ে একা এই প্রবাসে রোদেলার সাথে ভালো টাইম পাস করা যাবে। কিন্তু নিজের অজান্তেই মেহেদী কখন যে রোদেলার প্রেমে মজে যায় বুঝতে পারে না। অফিস শেষ করে অনেক সময় দুজন একসাথেই ঘুরে বেড়ায় জার্মানীর দর্শনীয় সব জায়গায়। মাঝে মাঝে রোদেলা মেহেদীর বাসায় রাতযাপনও করে।
আফরোজার সন্তান প্রসবের সময় ঘনিয়ে আসে। মেহেদীকে সব কথা ফোনে সে বলে, এ নিয়ে মেহেদীর কোন উচ্ছ্বাস পরিলক্ষিত হয় না। মনে মনে কষ্ট পায়, তবুও বলে না কিছুই। প্রবাসে থাকে, কখন কোন অবস্থায় থাকতে হয়। কত কষ্ট করে, অথচ স্ত্রী হয়েও স্বামীর কোন দায়িত্ব সে পালন করতে পারে না। এ নিয়ে তার কত মনোযাতনা, কত খারাপ লাগা।
রাতুল জন্ম নেয়, বড় হতে থাকে। এদিকে মেহেদীও ক্রমান্বয়ে যোগাযোগ কমিয়ে দেয়। আফরোজার অস্থিরতা বাড়ে। দেখতে দেখতে কেটে যায় দশটি বছর। আফরোজা রাতুলকে কত কষ্টে বড় করছে, সত্যি বলতে কি পাশের বাড়িতে থেকেও আমি সে খবর কখনও রাখিনি।
ওদিকে রোদেলার গর্ভেও জন্ম নেয় মেহেদীর সন্তান। রোদেলা তাকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকে। হাজার হোক দিন শেষে সেও একজন বাঙালি নারী। ছেলের স্বীকৃতি আর স্ত্রীর মর্যাদা তারও কাম্য। শুনেছি তাতে মেহেদীরও অমত নেই, নিমরাজি, তবে রোদেলার একটা শর্তের কারণে স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না সে। শর্তটাও বেশ কিছুটা জটিল বৈকি, ইস্পাতকঠিন। যেন সাপও মরে লাঠিও না ভাঙে। দেশে গিয়ে রাতুলকে কৌশলে খুন করে আফরোজাকে তালাক দিতে হবে। রোদেলার প্রেম মেহেদীকে এতটাই অন্ধ করে দিয়েছে, শেষ পর্যন্ত ওর শর্তটাই তাকে মেনে নিতে হয় অবোধ বালকের মতো।
মেহেদী হাসান দেশে ফেরে রাতুল আর স্ত্রীর জন্য নানা সামগ্রী নিয়ে। আফরোজা তো মহাখুশি। হারানো সম্পদ ফিরে পেলে লোকে যেমন খুশি হয়। আফরোজার চেয়েও অধিক খুশি হয় রাতুল। আজ যেন ঈদ। গেল ঈদে মায়ের কাছ থেকে নতুন জামা পেয়েও তার এতটা আনন্দ লাগেনি। বাবার কথা মায়ের মুখেই শুধু শুনেছে সে, এর আগে চোখেও দেখেনি কোনদিন।

গ্রীষ্মের মধ্যদুপুর। কাঠফাটা রোদের তাপে চারদিক চৌচির। গণগণে গরমে পুরো শরীর ঘামে নেয়ে উঠলে বাপ ছেলে পুকুরে যায় গোসল করতে। আশেপাশে শকুনের মতো সুতীক্ষè দৃষ্টিতে একবার চোখ বুলিয়ে নেয় মেহেদী, না, কাউকে দেখা যায় দেখা না। গ্রীষ্মের এই তপ্ত দুপুরে কারো বাইরে থাকার কথাও নয়। সুযোগ বুঝে তাই রাতুলের গাঢ়টা দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে পানির নিচে চেপে ধরে রাখে মেহেদী। রাতুলের কি পা-হাত ছোটাছুটি, প্রাণে বাঁচার সে কি আকুল আকুতি। এদিকে প্রাণে বাঁচতে পিতার সাথে যুদ্ধ করে শিশুপুত্র রাতুল, আর ওদিকে কেঁপে কেঁপে ওঠে খোদার আরশ, অথচ পাষ- পিতার বুক কাঁপলো না একটুও। মুহূর্তেই রাতুলের ছোট্ট দেহ থেকে প্রাণটা বের হয়ে যায়।
আফরোজাকে অবশ্য তালাক আর দেওয়া হলো না, হলো না রোদেলাকে বিয়ে করাও। একটু আগেই দেখলাম পুলিশ ধরে নিয়ে গেলো মেহেদী হাসানকে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট