চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

চট্টগ্রামে নজরুল আগমন ও রচনা

ড. মুহাম্মদ কামাল উদ্দিন

২৪ মে, ২০১৯ | ১২:৪৫ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশ ও বাংলা সাহিত্যে জাতীয় কবি, সাম্যের কবি, বিদ্রোহের কবি, অনুভূতির কবি কাজী নজরুল ইসলাম এক ও অবিভাজ্য বিষয়। কবির গান, কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ ইত্যাদি ছিল মানব মুক্তির পক্ষে। মানবতাকে বড় করে দেখতে গিয়ে প্রথম জীবনে কবিকে কারাগারে যেতে হয়েছে। শাসক শ্রেণীর নিপিড়নে সাহিত্য চর্চা থেমে থাকেনি বরং এর কারণে সাহিত্যের উন্মাদনা বেড়ে গিয়েছিল। প্রকৃত পক্ষে নজরুলের বিষয়ে যত দিন যাচ্ছে মানুষের মনে তত বদ্ধমূল ধারণা জন্মাচ্ছে। আমি ছাত্রাবস্থায় থাকাকালে কখনও নজরুল নিয়ে আমার শিক্ষকদেরকেও তেমন কিছু বলতে শুনিনি। আজ আমার যারা ছাত্র তারা নিঃসন্দেহে নজরুল নিয়ে ভাবে। এটা আশার কথা যে, আমাদের জাতীয় কবিকে নিয়ে আমরা ভাবতে শুরু করেছি।
কবি বাংলাদেশের মানুষের মনে মননে মিশে আছেন, হয়ে আছেন একাকার। কবি আবদুল হাই শিকদারের ভাষায়, “চুরুলিয়ার দুখু মিঞার জন্য এত দরদ বাংলাদেশে জমা ছিল কে জানত?” আসলেও তাই। বাংলাদেশের অন্য অনেক এলাকার মত কবি চট্টগ্রামেও বার বার এসেছেন। ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রামের ভূমিকা অনন্য। আর কবি ছিলেন এই আন্দোলনের পুরোধা। যার ফলে কবিকে বার বার চট্টগ্রাম ছুটে আসতে হয়েছে। তিনি এসেছেন। কবি বন্ধু কমরেড মুজাফফর আহমেদ, কবি দিদারুল আলম, হাবিবুল্লাহ বাহার প্রমুখের সাথে। প্রথমবার তিনি চট্টগ্রাম আসেন ১৯২৬ সালে। কিন্তু ১৯২২ সালে একবার আসতে চেয়েছিলেন; কবি বন্ধু আফজল-উল-হককে লেখা চিঠি থেকে তা জানা যায়।
১৯২৬ সাল : ১৯২৬ সালের জুলাই মাস। কবি প্রথম বারের মত চট্টগ্রাম আসেন। চট্টগ্রাম কলেজের তৎকালীন ছাত্র সংসদের নেতা কবি বন্ধু হাবিবুল্লাহর বাহারের দাওয়াত এবং কলেজ কর্তৃক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেয়াই ছিল উদ্দেশ্য। সাথে ছিলেন কংগ্রেস নেতা অধ্যাপক হেমন্ত সরকার। কলকাতা থেকে এসে সরাসরি ডাক বাংলোতে ওঠেন। হাবিবুল্লাহ বাহার ও তার বোন শামসুনন্নাহার মাহামুদ কবিকে তাঁদের বাসায় নিয়ে যান। চট্টগ্রাম কলেজে সংবর্ধনায় কবি ছাড়াও সংবর্ধিত হয়েছিলেন সর্বভারতীয় জাতীয় নেত্রী বিশিষ্ট কবি সরোজিনী নাইড়–। অধ্যক্ষ কামাল উদ্দিন উক্ত সভায় সভাপতিত্ব করেন। একই বার চট্টগ্রাম কলেজ ছাড়াও সীতাকু-, জে এম সেন স্কুল তাঁকে সংবর্ধনা দেয়। এছাড়াও এ যাত্রায় আন্দরকিল্লা জামে মসজিদ, মুসলিম হল, সীতাকু- পাহাড় ইত্যাদি স্থানে বেড়াতে যান।
প্রথমবারের চট্টগ্রাম আগমণ কবিকে দারুণভাবে উৎসাহিত করে। বেগম শামসুন নাহারকে লেখা চিঠি থেকে আমরা তা অনুমান করতে পারি। কবি শামসুন নাহারকে লিখেছেন, “ফুল যদি কোথাও ফুটে, আলো যদি কোথাও হাসে, সেখানে আমার গান গাওয়ার পায়, গান গাই। গাওয়ার শোভা পায়, গান গাই। সেই আলো, সেই ফুল পেয়েছিলাম এবার চট্টলায়, তাই গেয়েছি গান। … কবিকে খুশী করতে হলে দিতে হয় অমূল্য ফুলের সওগাত।”
১৯২৯ সাল : জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম দ্বিতীয় বারের মত চট্টগ্রামের মাটিতে আসেন ১৯২৯ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে। কবি এই যাত্রায় প্রায় মাস খানেক চট্টগ্রামে অবস্থান করেন। এই সময় তিনি কাট্টলী চৌধুরী পরিবারে যান এবং এখানে তাঁকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। এই বিষয়ে জনাব আমীর হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরীর সাথে কথা বললে তিনি বলেন, ‘সেই স্মৃতিতো আর নাই। সেই জায়গাগুলোও সংরক্ষণ করা হয়নি।’ কাট্টলীতে কবিকে সংবর্ধনা দেয়া হয় মুসলিম লীগ নেতা মাহমুদুন্নবী চৌধুরী ও মৌলভী তমিজুর রহমানের উদ্যোগে। সেই যাত্রায় কবি যান পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে, ফতেয়াবাদ আলম পরিবারে, সন্দ্বীপ মোজাফফর আহমদের বাড়ী ও আজীজ মঞ্জিলে।
১৯৩২ মতান্তরে ১৯৩৩ সাল : কবি নজরুল ইসলাম তৃতীয় বারের মত চট্টগ্রাম আসেন ১৯৩২ সালে কারো কারো মতে তা ১৯৩৩ সাল। এই যাত্রায় কবি আরো কিছু নতুন এলাকা সফর করেন। রাউজান তরুণ কনফারেন্স ও শিক্ষা সম্মিলনীতে যোগদান ছিল মূর্খ্য। এখানে গরু ছাগল জবাই করে মেজবান খাওয়ানো হয়। টিকেট কেটে কবি দর্শন এখানেই প্রথম।
কবি চতুর্থ বারের মত এসেছেন চট্টগ্রামে ১৯৭৩ সালে। এই প্রসঙ্গে ড. দিল আফরোজ বেগম লিখেছেন এভাবে, ‘চতুর্থ বারের মত কবি চট্টগ্রাম আসেন ১৯৭৩ সালে। তখন বয়স ৭৫ বছর, অসুস্থ, বাক ও স্মৃতি শক্তি রহিত। একদিন পরই আবার তাঁকে ঢাকায় ফিরিয়ে নেয়া হয়।
চট্টগ্রামে কবি লিখেছেন-চক্রবাক, শীতের সিন্ধু, শিশু যাদুকর, সাত ভাই চম্পার অধিকাংশ কবিতা, মধুমালা, আমার সাম্পান যাত্রী লয়, ওরে মাঝি ভাই তুই কি দুঃখ পেয়ে কুল হারালি অকুল দরিয়ায়, তোমায় কুলে তুলে বন্ধু আমি নামলাম জলে, পর জনমে দেখা হবে প্রিয়া ইত্যাদি স্মরণীয় কবিতা ও গান।
চট্টগ্রামে কবির আগমন নিয়ে নানা কথা নানা মত ও চিন্তা রয়েছে। তবুও চেষ্টা করা হয়েছে উল্লেখযোগ্য স্থান ও তারিখ গুলো লিপিবদ্ধ করার। প্রজন্ম, অভিভাবক তথা সকল শ্রেণীর মানুষের জানার অধিকার রয়েছে জাতীয় কবি সম্পর্কে। আর আমার সীমাবদ্ধ জ্ঞানে যেটুকু দৃষ্টি গিয়েছে তার সবটুকু নির্ভুলভাবে তুলে ধরার চেষ্টায় ত্রুটি রাখিনি। আমাদের জাতীয় কবিকে সকলের নিকট তুলে ধরার মধ্য দিয়ে আমরা সম্মানিত হতে পারি। আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার যে স্থান কবির সৃষ্টি কর্মকে সব কালে, স্থানে গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরতে হবে। আমার মনেহয় আমরা কবির সকল কর্মকে মর্যাদা দেয়ার মধ্য দিয়েই আমাদের মর্যাদাকে বাড়াতে পারি।

শাহী জামে মসজিদে নজরুল
আন্দরকিল্লাস্থ চট্টগ্রাম শাহী জামে মসজিদ চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক ইসলামী ঐতিহ্য। চারদিকে ব্যস্ত রাস্তা, লাইব্রেরী, দোকান, ষ্টেশনারীসহ নানা দোকানের মাঝে বুঝার উপায় নেই এত ঝামেলার উপরে ইসলামের মহান ঐতিহ্য দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হিসাবে। আরো মজার ব্যাপার হল এই স্থানটি নানা কারনে ইতিহাসের এক মহান সাক্ষী। সবচেয়ে বড় বিষয় হল আমাদের চেতনার, সমৃদ্ধির কবি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এই মসজিদের এক সভায় ১৯২৬ সালে এসেছিলেন।
এখানে শেষ নয়। কবিকে চারদিকে ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষীরা কটাক্ষ করেছে তারও নিন্দা জ্ঞাপন করে প্রস্তাব পাশ করে। কারণ যে কবি মসজিদের পাশে তাঁকে কবর দেয়ার আহবান জানিয়েছে তাঁকে গালি দিবে আর মুসলমানরা বসে থাকবে তা হতে পারে না। কবির সেই শ্রেষ্ঠ উক্তি গুলো ছিল এভাবে,
‘‘মসজিদেরি পাশে আমার কবর দিও ভাই
যেন গোরে থেকেও মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই।

আমার গোরের পাশ দিয়ে ভাই নামাজীরা যাবে,
পবিত্র সেই পায়ের ধ্বনি এ বান্দা শুনতে পাবে।
গোর আজাব থেকে এ গুনাগার পাইবে রেহাই।

পরহেজগার খোদার ভক্ত নবীজীর উম্মত
ঐ মসজিদে করে রে ভাই কোরান তেলাওয়াৎ।
সেই কোরান শুনে যেন আমি পরান জুড়াই।”

ডিসি হিলে নজরুল
৭ জুলাই,২০০৫ রাউজান একাডেমী কর্তৃক কবিয়াল ফণি বড়–য়ার স্মরণ সভা। সভাটি হচ্ছিল সাবেক ডিসি হিল বর্তমানে যার নামকরন হয়েছে ‘নজরুল স্কোয়ার’ ঠিক তার উলটো দিকে একটি হলে। বেলা তিনটায় চিত্রাংকন প্রতিযোগিতার উদ্বোধনের পর প্রতিযোগিরা ছবি আঁকছিল। এই মুহূর্তে আমাদের অনুষ্ঠানে কোন কার্যক্রম না থাকায় মনে করলাম একটু ঘুরে আসি। সাথে তো সব সময় আমার ছাত্র-ছাত্রী থাকেই। আমি কোন অনুষ্ঠানে যেতে হলে আমার ছাত্র-ছাত্রীরাতো বায়না ধরে তারাও যাবে। আমিও এই সুযোগ হাত ছাড়া করি না। ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে নজরুল স্কোয়ারে গিয়ে মনটা ভরে গেল। সকালটা ভীষণ কষ্টে কেটেছে। কারণ সকাল বেলা আমার প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা ছিল। বাংলা বিষয়ে প্রভাষক নিয়োগ। যেহেতু বাংলা বিভাগে জাতীয় কবি ও রবীন্দ্রনাথ সর্ম্পকে কিছু প্রশ্ন ছিল। পরীক্ষার্থীদের জাতীয় কবি সর্ম্পকে ধারণা দেখে মনে মনে আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা ও কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার অবস্থা দেখে আমি রীতিমত এই দেশের মানুষ হিসাবে ভাবতে লজ্জা লাগছিল।
যাক সেকথা, বলছিলাম মনটা ভরে গেল। কারণ আজ থেকে কয়েক মাস পূর্বেও যখন চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় জাতীয় কবিকে নিয়ে আলোচনা সভা, সমাবেশে, প্রকাশনা নিয়ে আমি কাজ করতে গিয়েছিলাম তখন ডিসি হিলের গায়ে গতরে নজরুলের চিহ্ন পর্যন্ত দেখতে পাইনি। আজকের ডিসি হিল যেন জীবন্ত নজরুলের প্রতিচ্ছবি। চারদিকে নজরুল যেন আমাকেই-এই আমাকেই ডাকছে।
ভীষণ আবেগ প্রবণ হয়ে উঠলাম।
অনেক দিন পর হলেও চট্টগ্রামের মানুষ নজরুলকে নিজেদের স্বার্থে সম্মান দেখাতে সক্ষম হচ্ছে বলে মনে হল। বাংলাদেশ ও বাংলা সাহিত্যে জাতীয় কবি, সাম্যের কবি, বিদ্রোহের কবি, অনুভূতির কবি কাজী নজরুল ইসলাম এক ও অবিভাজ্য বিষয়। কবির গান, কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ ইত্যাদি ছিল মানব মুক্তির পক্ষে। মানবতাকে বড় করে দেখতে গিয়ে প্রথম জীবনে কবিকে কারাগারে যেতে হয়েছে। শাসক শ্রেণীর নিপীড়নে সাহিত্য চর্চা থেমে থাকেনি বরং এর কারণে সাহিত্যের উম্মাদনা বেড়ে গিয়েছিল। প্রকৃত পক্ষে নজরুলের বিষয়ে যত দিন যাচ্ছে মানুষের মনে তত বদ্ধমূল ধারণা জম্মাচ্ছে। আমি যখন ছাত্রাবস্থায় ছিলাম ঠিক কখনও নজরুল নিয়ে আমার শিক্ষকদেরকেও তেমন কিছু বলতে শুনিনি। আজ আমরা যারা ছাত্র তারা নিঃসন্দেহে নজরুল নিয়ে ভাবে। এটা আশার কথা যে, আমাদের জাতীয় কবিকে নিয়ে আমরা ভাবতে শিখেছি।
কথা হল যারা যে উদ্দেশ্য নিয়ে করুক না কেন নজরুলের নাম দেয়া হয়েছে এটি আমার কাছে প্রাপ্তির। কিন্তু অস্থিত্বহীন-বেনামী অনেক মানুষ আজ এই কাজের অহেতুক বাড়াবাড়ি করছে। চট্টগ্রামের অনেক নজরুল প্রেমিক, সাহিত্যিক, কবি, অধ্যাপক, বিজ্ঞানীদের মত আমি একজন ক্ষুধে নজরুল ভক্তের আজ বড় কষ্ট হয় যখন দেখি অহেতুক লোকজন এই কাজের আহামরি সফলতা নিজের দাবী করে। আসলে নজরুল আমাদের জাতীয় কবি, আমাদের চেতনার কবি, আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের কৃষ্টির কবি। জাতীয় কবি মানে জাতীয় সম্পদ। জাতীয় কবিকে সম্মান জানানোর মাধ্যমে আমরা আমাদেরকে সম্মানিত করব নিঃসন্দেহে। কিন্তু কিছু লোক জাতীয় কবিকে সম্মান জানানোর নামে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত আছে, আর অহেতুক বাড়াবাড়িতে লিপ্ত। ডিসি হিলের চারদিক আজ নজরুলের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। এটি আমাদের দেশের জন্য, আমাদের ঐতিহ্যের জন্য গর্বের এতে কোন সন্দেহ নেই। আমাদের প্রজন্ম কে জাতীয় কবি, আমাদের সাহিত্য সম্পর্কে জানাতে হলে অবশ্যই আজ এইভাবে স্মৃতি সংরক্ষণের মাধ্যমে তা করতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে কয়েকজন কে কিন্তু অংশ নিবে সমাজ সচেতন সবাই। এতেই কেবল একটি মহৎ কাজ সমাজে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করতে পারে। কিন্তু নজরুল স্কয়ার এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে চট্টগ্রামের অনেক নজরুল ভক্ত জানতেও পারেনি। এই অবস্থা এই পরিস্থিতি কারো কাম্য নয়, আশাও করে না কেউ। এই জাতীয় কার্যকলাপ যারা করে তাদের জন্য সমাজের আরো অনেক সচেতন মানুষের মত আমারও কষ্ট হয়। কারণ এরা প্রকৃত অর্থে অন্যের সম্মান নয়, নিজেকে নিয়ে বেশি ব্যস্ত।
প্রথম গেইটে ঢুকতেই বাম পাশে নজরুলের লেখা,
‘‘ওগো ও কর্ণফুলী-
নজরুলের ছবি সুন্দরভাবে অংকিত আছে। ডানপাশে যে মঞ্চে সদা সভা সমাবেশ হয় তার নাম দেয়া হয়েছে ‘নজরুল মঞ্চ’। উপরে উঠলাম আরেকটি নজরুলের ছবি। নজরুলের লেখা আরেকটি কবিতা।
‘বিদায় হে মোর বাতায়নে-
আমার গুবাক তরুর সারি।’’
চট্টগ্রামের মাটিতে কবির আগমন প্রথমবার হয়েছিল কোন পথে ? হয়ত রেলপথে।
সঙ্গে ছিল কবিবন্ধু হেমন্ত সরকার। তাঁদের আগমনের হেতু ছিল রাজনৈতিক। সরাসরি গিয়ে উঠেন ডাকবাংলোতে। মূহুর্তে খবর ছড়িয়ে পড়ে শহরে। হাবীবুল্লাহ বাহারের নেতৃত্বে সরগরম হয়ে ওঠে বাংলো। সম্ভবত সালটি ১৯২৬। কোথায় সেই ডাকবাংলো? যেখানে কবি প্রথমবারের মত চট্টগ্রামকে, চট্টগ্রামের মানুষকে সম্মানিত করেছিলেন এসে ? কোন সচেতন সমাজ এর জবাব দিতে পারবে না। (সূত্রঃ বাংলাদেশে নজরুল- নজরুলের বাংলাদেশ)
রাউজানে নজরুল
এখন থেকে একশত বছর আগের কথা বলছি। দেশে তখন এত বেশি লোক ছিল না। বঙ্গ দেশ তখন পরাধীন। দেশে ইংরেজদের শাসন চলছিল। জমিদার প্রথা চালু সর্বত্র। কলকারখানা এত হয়নি। চাষাবাদ ছিল এ উপমহাদেশের লোকজনের প্রধান আয়ের উৎস। গ্রামের লোকদের মধ্যে দু’একটি পরিবার ছিল যাদের সামান্য আয় উপার্জন ছিল আর তারা উৎসব আদিতে গ্রামে ছুটে যেত। তখন চাইলে এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় ছুটে যাওয়ার ব্যবস্থা ছিল না। উড়োজাহাজ চোখে দেখেনি কেউ। রেলগাড়ি চড়া-সেতো জীবনের একটি অভিজ্ঞতা। গ্রাম আর শহরের ভিতরে যাতায়াত আদান প্রদান ছিল কম। শহর থাক না তার ব্যস্ততা ছুটাছুটি নিয়ে। ঘরে ঘরে তখন রেডিও ট্র্যানজিষ্টর ছিল না, পাড়ার মোড়লের বাড়িতেও ছিল না কোনো টেলিভিশন।
হয়তো দূরে আছে কোন ভাগ্যবান গ্রাম। সেখানে আছে রেল নাইন-রেল স্টেশন। হঠাৎ করে গ্রামের কোনো লোক শহরে এলে তার কাছ থেকে গাল গপ্প শুনছে সকলে মিলে আর শহরে আসা মানে তিনি অতিমাত্রায় চালাক বনে যাওয়া। শহরে মানুষ যায়? শহরে যাওয়ার কথা মনে পড়লে ভয়ে মানুষের মুখ শুকিয়ে যায়। এমনিভাবে শহর আর গ্রাম দু’জন দু’দিকে মুখ ফিরিয়ে দূরে দূরে একা-একা যে যার মর্জি নিয়ে পড়ে থাকে।
সে যোজন যোজন দূরে থাকা গ্রাম আর শহরের অবস্থান। সে অবস্থান কে ভেদ করেছে রাউজানের হাজী বাড়িতে ‘তরুণ কনফারেন্স ও শিক্ষা সম্মিলনী এর ৫ ও ৬ মে ১৯৩৩ সালে প্রধান অতিথি হিসাবে যোগ দিতে। প্রধান অতিথির দাওয়াত দিয়েছিলেন নূরুল আবসার ও নূরুল হুদা চৌধুরী। তারাই ছিলেন সম্মেলনের উদ্যোক্তা।
রাউজানের বহুসাংবাদিক, লেখক, সাহিত্যিক এর সাথে আমার অনেক আগে থেকে ভাল যোগাযোগ রয়েছে। আমি বার বার রাউজান নোয়াপাড়া, পাঁচখানই, বেলখানই গিয়েছি সভা সমিতিতে বক্তৃতা করেছি। আজকের এ যাত্রা ভিন্ন কারণ। খুব সকালে লেখক-সাহিত্যিক বন্ধুবর মহিউদ্দিন ইমনকে বললাম ইমন ভাই আমি রাউজান আসছি। ইমন ভাই কেন আসছি প্রশ্ন না করে বললেন আমি কোথায় থাকব জানাবেন কি?
যথাসময়ে ইমন ভাই মুরাদপুর অপেক্ষা করছেন। আমরা ইমন ভাই, নোটন প্রসাদ ঘোষ, নেজাম উদ্দিন রানা, নুর মোহাম্মদ মিলে এবার টেক্সী নিয়ে যাত্রা শুরু করলাম। তারা বার বার প্রশ্ন করছে কোথায় যাচ্ছি ‘বললাম হাজী পাড়া, হাজী বাড়ী’ যেখানে জাতীয় কবি এসেছিলেন।
গ্রামের সুন্দর আঁকা বাঁকা পথ দিয়ে টেক্সী চলছে আর মনে হচ্ছে আমিও কবি হয়ে যাচ্ছি। ইমন ভাইয়ের নীরব কৌতুহলে আমি আকৃষ্ট হয়ে যাচ্ছি। তিনি বুঝতেই পারছেন না আমি হঠাৎ কেনই বা রাউজান হাজী বাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম ? তবে তিনি এটুকু বুঝেছেন যে, আমি কোন বড় উদ্দেশ্য নিয়ে সেখানে যাচ্ছি। উদ্দেশ্য অবশ্যই বড় কারণ কবির স্মৃতিধন্য জায়গা দেখতে যাওয়াও আমি মনে করি মানুষ হিসাবে আমার স্বার্থকতা বৈ-কি?
হাজী বাড়ির কৃতি সন্তান দৈনিক পূর্বকোণের চেয়ারম্যান ইউসুফ চৌধুরীর একান্ত চেষ্টায় ও জেলা প্রশাসক চট্টগ্রামের উদ্যোগে জাতীয় কবির আগমনের ৬৭তম বছরে হাজী বাড়ির সামনে রাস্তা ও স্কুলের পাশে স্থাপিত হয়েছে নজরুল স্মৃতি ফলক। নজরুল স্মরণ-এটি মহৎ প্রাণের উদাত্ত আহবান। ফলকে পুরো লেখাটা এমন,
‘‘বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৯৩৩ সালে তৃতীয়বারের মত চট্টগ্রাম এলে এ বাড়িতে অবস্থান করে একসাহিত্য সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন। সম্মেলনের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ছিল কবির গান ও আবৃত্তি। নজরুল স্মৃতি রাউজানবাসীর জন্য এক পরম ও সুখকর গৌরবের অনুষঙ্গ।’’
রাউজান একমাত্র চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক স্থান যেখানে কবিকে দেখতে জনতাকে টিকেট কাটতে হয়েছিল। কে জানত রাউজানের সে কবি দর্শন আজ ইতিহাস হবে? চট্টগ্রামে নজরুল নিয়ে যে ভাববে তাকেই রাউজানের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে হবে। দুইদিন ব্যাপি সম্মেলনের জন্য বিশাল প্যান্ডেল নির্মাণ করা হয় হাজী বাড়ির উত্তর পাশে রায় মুকুট দীঘির পূর্ব পাড়ে। শুধু চট্টগ্রাম নয় অনেক দূর দুরান্ত থেকে লোকজন ছুটে এসেছিলেন সে সভায়। হাজার হাজার মানুষের ঢল নির্দিষ্ট এই প্যান্ডেলে ধরছিল না তাই উদ্যোক্তাদের অনেকে মনে করলেন টিকেটের ব্যবস্থা করা দরকার। আর সে সভায় কবিকে দেখতে টিকেট কাটতে হয়েছিল জনতাকে।
টিকেট কেটে কবি দর্শনের এ সভায় প্রথম দিনে সভাপতিত্ব করেন চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার খান বাহাদুর আবদুল মোমেন। স্বাগত ভাষণ দেন ড. এনামুল হক। দ্বিতীয় দিনে সভাপতির আসন অলংকৃত করেন আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ। স্বাগত ভাষণ দেন ড. এনামুল হক। সবগুলো সভায় বক্তব্য রাখেন যথাক্রমে-হাবীবুল্লাহ বাহার, আবুল ফজল, মাহবুবুল আলম, নজীর আহমেদ প্রমুখ। নানা কথা। শিক্ষা-সংস্কৃতি, ঐতিহ্য কি বাদ ছিল সে সভায় ? কিছুই না। চট্টগ্রামের উন্নয়নসহ সকল কথা। মানুষ শুনেছে কবির বক্তব্য, গান আর কবিতা।
সম্মেলন প্রস্তুতি ও আয়োজনের মূল দায়িত্বে ছিলেন-আহমদ চৌধুরী, এডভোকেট অলি মিয়া চৌধুরী, মোজাহারুল ইসলাম চৌধুরী, ইউনূস চৌধুরী, হাফিজুর রহমানসহ এলাকার মুরুব্বিরা। চট্টগ্রামে এমন আয়োজন কবিকে নিয়ে আর কেউ করেনি। কবির স্মৃতি রক্ষা করার জন্য আজ রাউজানবাসীই সর্বোচ্চ সর্তক। তারা আরো একটি ইতিহাস গড়ে তুলতে চায়। কবি নজরুল শুধু রাউজান নয় চট্টগ্রামের অনেক জায়গায় এসেছেন কিন্তু কেউ রাউজানের মত আয়োজন করছে না। অনেকের এ বিষয়ে কোন আগ্রহ আমি দেখতে পেলাম না।
দু’দিনের অনুষ্ঠানে কবি ভাষণের পর কবিতা আবৃত্তি, গান গেয়েছে। কবির বক্তৃতা শুরুর পূর্বে চারদিকে মূহুর্মুহু করতালি আর শ্লোগান। কবির কথা শুনে উপস্থিত জনতা আবেগ আর আনন্দ ধরে রাখতে পারছিলেন না। তারা মনে করছিলেন এ মহান কবি আমাদের শ্রদ্ধার কবি, জাতীয় উন্নয়নের পথিক আমাদের সামনে এ এক বড় পাওনা বটে। এভাবে নানা আয়োজনের মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটে দু’দিন ব্যাপী সম্মেলনের। রাউজান হাজী বাড়ি। আর একটি কাচারী ঘর। ঐতিহ্য আর ইতিহাসের এমন এক বিস্তর সাক্ষী। কত নামী-দামী মহামানুষকে পৃথিবীতে স্বাগত জানিয়েছে আবার অতিকষ্টে চির বিদায় দিয়েছে। কালের নীরব নিথর সাক্ষী এই সেই কাচারী ঘর। যা এখনও নীরবে দাঁড়িয়ে আছে জাতীয় কবির সন্মানে। এই কাচারী ঘরে জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম দু’রাত কাটিয়েছেন। এই ঘরে কেউ থাকে না। হাজী বাড়ির লোকজন কবিকে সম্মান জানাতে এই ঘরের কোন ক্ষতি সাধন করেনি। কবির ভাষায় বলতে হয়-
‘‘আমাদের শত ব্যথিত হৃদয়ে
জাগিয়া রহিবে তুমি ব্যথা হয়ে,
হলে পরিজন চির-পরিচয়ে-
পুনঃ পাব তব দরশনে,
এ নহে পথের আলাপন ।।’’
রাউজান হাজি বাড়ির কাচারি ঘরটি ইতিহাসের এই মহান মানুষকে দু’রাত রেখেছে। তাঁকে ঘুমিয়েছে যেই ঘরে চাইলে রাউজানবাসী একটি ‘কবি নজরুল স্মৃতি পাঠাগার’ স্থাপন করতে পারে। আর এতে করে রাউজানের মানুষ কবির ইতিহাসকে আরো সুন্দর ও স্বার্থক রূপে দেখতে পাবে। চিরকাল হাজার বছর ইতিহাস লালন করবে এই কাচারী ঘরের স্থানটি । তা হবেই- হবে আমরা আশা করছি।
এভাবে নানা স্থান পরিদর্শন এবং ইতিহাস জানার মধ্য দিয়ে আমাদের ভ্রমন সমাপ্তি হয়। রাউজানবাসীকে শুভেচ্ছা জানাই এই কারণে যে, তারা জাতীয় কবিকে সর্বোচ্চ সম্মান দেখিয়েছেন নানাভাবে। তারা শুধু জাতীয় কবিকে সম্মান জানায়নি বরং জাতীয় কবিকে সম্মান জানানোর মধ্য দিয়ে রাউজানকে জাতির কাছে সম্মানিত করেছেন। তাদের এই বোধকে আমি শ্রদ্ধা জানাই।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট