চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

সঙ্গীত সাধক নজরুল

রতন কুমার তুরী

২৪ মে, ২০১৯ | ১২:৪৫ পূর্বাহ্ণ

সাহিত্যের অলি-গলি পেড়িয়ে নজরুল গানেও এক অনবদ্য কৃতি রেখে গেছেন। নজরুল প্রতিটি গান এখনো মানুষের মানসপটে গভীর চিন্তার উগ্রেক করে। নজরুলের জীবন দর্শন বিচার করলে নজরুলকে চির-দুঃখী মনে হলেও গানের ক্ষেত্রে অনেক সময় তাকে রাজার ভূমিকায় দেখা যায়।
১৯২৭ সালের এপ্রিল মাসে নজরুলের প্রথম পুত্র বুলবুলের জন্ম হয়। তার চারমাস আগে নজরুল ‘দারিদ্র্য’ কবিতাটি লিখেছিলেন। উক্ত কবিতায় খুব সম্ভবত নজরুল তার বাস্তব জীবনের ঘটনাই তুলে ধরেছিলেন। দারিদ্র্যের কষাঘাতে পিষ্ট কবি একবার আর কৃষ্ণনগরে বেশিদিন থাকেননি। জীবিকার প্রয়োজনে তাকে কলকাতা চলে যেতে হয়েছিল। কলকাতায় আগে থেকেই কিছু ঠিক করা ছিল না তাই কবি সপরিবারে কলকাতায় উঠেছিলেন নলিনীকান্ত সরকারের বাসায়। এরপর কিছুদিন এদিক-ওদিক থাকার পর অবশেষে কবির অনুরাগী শান্তিপদ সিংহের চেষ্টায় নজরুল পানবাগান লেনে বাসা করলেন। এই বাড়িতেই কবির দ্বিতীয় পুত্র সব্যসাচীর জন্ম হয়।
প্রকৃতপক্ষে কবির দ্বিতীয় পুত্র জন্ম হওয়ার পর পানবাগান বাড়িতে কবির গানের খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। কবির দেয়া গানের সুরের জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়তে লাগলো। গানের মসলিশের সভা সমিতি অনুষ্ঠানে অনেকেই নজরুলের রচিত গান উচ্চস্বরে গাইতে লাগলো-অথচ গ্রামোফোন কোম্পানির তরফ থেকে নজরুলের গানের রেকর্ডের কোনো অনুরোধ পর্যন্ত আসে না। বিভিন্ন মহলের এ নিয়ে সমালোচনায় ব্রিটিশ গ্রামোফোন কোম্পানির টনক নড়লো। যেহেতু নজরুল নজরুল রাজনীতি করতেন তাই এতোদিন ব্রিটিশ গ্রামোফোন কোম্পানি নজরুলকে এড়িয়ে চলেছিলেন। ব্যবসায়িক তাড়নায় ব্রিটিশ গ্রামোফোন কোম্পানি নজরুলের গান রেকর্ড করার জন্য ঠিকানা জোগাড় করতে গিয়ে দেখেন যে, তাদের অজ্ঞাতসারেই নজরুলের গান রেকর্ড হয়ে গেছে। রচয়িতার নাম গোপন করে শ্রীহরেন্দ্র ঘোষ নজরুলের লেখা দু’টি কবিতার কিছু অংশ বেছে নিয়ে সুর দিয়ে রেকর্ড করেছে। এরপর কোম্পানি ধাক্কা সামলে উঠে গান রচয়িতার প্রাপ্য-সম্মানি পাঠিয়ে দিয়ে ভদ্রতা দেখালেন। এভাবেই গ্রামোফোন কোম্পানির সাথে নজরুলের প্রথম যোগসূত্র স্থাপিত হয়। তাঁর রচিত গান রেকর্ড করার জন্য কোম্পানি অনুমতি চাইল। তারপর থেকে তার লেখা, সুর দেয়া এবং স্বকণ্ঠে গাওয়া গানের অৎ¯্র রেকর্ড গ্রামোফোন কোম্পানির কাছে অত্যন্ত প্রিয় হয়ে ওঠে।
ছোট বেলা থেকেই নজরুলের ঝোঁক ছিল গানের দিকে। শিয়ারসোলের স্কুলের শিক্ষক সতীশ কাঞ্চিলাল মশাই ছাত্রের এই প্রবণতা লক্ষ্য করে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তালিমও দিয়েছিলেন। কাঞ্চিলাল মশাই উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতচর্চা করতেন। নজরুল যখন পল্টনে ছিলেন তখন পাশ্চাত্য সঙ্গীতের তালিমও পেয়েছিলেন সহকর্মীদের কাছ থেকে। আর গ্রামোফোন কোম্পানির সহিত যোগসূত্র স্থাপিত হওয়ার পর থেকে ওস্তাদ জমীরুদ্দীন খাঁ সাহেবের কাছে নিয়মিত তালিম নিতে থাকেন। এক কথায় বলা যায় নজরুল তখন সুরের সাগরে গা ভাসিয়ে দিলেন। তার রচিত গানের সংখ্যা তিন হাজারেরও বেশি হবে। জমীরুদ্দীন খাঁ সাহেবের মৃত্যুর পর কবিকে তার শূন্য আসনে গ্রামোফোন কোম্পানি সাদরে বসিয়েছিলেন। পদটি ছিল ‘ট্রেনার’ ও হেড ‘কম্পোজার’। ১৯৩০ সালে নজরুলের প্রথম পুত্র বুলবুল মারা গেলে কবি বেশ শোকাহত হয়েছিলেন। কবি পুত্র খুব অল্প বয়সেই কবির গানগুলো হুবহু গাইতে পারতেন। বুলবুলের মৃত্যু কবি পরিবারে বিষাদের ছায়া নেমে এলো কবি কিছুদিন আধ্যাত্মিক দিকে ঝুঁকে পড়লেন। মৃত বুলবুলকে দেখার জন্য সেসময় কবি অনেক কিছুই করেছিলেন। পুত্রশোকে যে নজরুল সে সময় আধ্যাত্মিক শক্তির প্রতি ঝুঁকে পড়েছিলেন তা তার বিভিন্ন কার্যকলাপে প্রমাণিত হয়েছিল। ১৯৪২ সালের জুলাই মাসে অল ইন্ডিয়া রেডিওর প্রোগ্রামে অনুষ্ঠান করতে গিয়ে কবি টের পেলেন তার জিহ্বা কাজ করছে না। কথা বলতে গিয়ে গলা আটকে আসছে। তার রেডিও প্রোগ্রাম করা সম্ভব হলো না। নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় ঘোষণা করলেন কবি অসুস্থ। এরপর নগেন্দ্রকৃষ্ণ কবিকে ট্যাক্সিতে উঠিয়ে তার বাড়ি নিয়ে এলেন। এ সময় কবি দৈনিক ‘নবযুগ’-এর সম্পাদক ছিলেন। লুম্বিনী পার্কেও হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে কবিকে মধুপুরে বায়ু পরিবর্তনের জন্য পাঠানো হলো। অন্যের কাছে প্রকাশ পাওয়ার অনেক আগেই নজরুলের অসুখটা দেহে আত্মবিস্তার লাভ করেছিল। কাজেই যখন তার চিকিৎসা শুরু হলো তখন তা উপশমের বাইরে চলে গেছে। যতই যশ খ্যাতি থাকুক না কেনো সেময় এ রোগের চিকিৎসা করানোর মতো নজরুলের আর্থিক সামর্থ্য ছিল না। তার প্রথম বই ‘ব্যথার দান’ মাত্র দু’শ টাকায় স্বত্ত্ব বিক্রি হয়েছিল। হয়ত তখনকার দিনে দু’শ টাকা অনেক টাকা। কপিরাইট বিক্রি না করলে যেতো তার আপন বন্ধুটিও তার বইটি প্রকাশে হাত বাড়াতো না। তার দ্বিতীয় কপিরাইট বিক্রি হয় ওই বছরই ১৯৯১ সালে ‘রিক্তের বেদন’ এবং আরো দু’টি বই মাত্র চার’শো টাকা। ‘অগ্নিবীণা’ ও ‘যুগবাণী’ প্রথম দিকে স্বত্ত্ব বিক্রি করা হয়নি। যারা নজরুলের লেখার অনুরাগী তাদের মধ্যে কেউ কেউ গ্রন্থ প্রকাশের সমস্ত ব্যয়ভার গ্রহণ করলেও সরকারি ঝামেলার কারণে নিজেদের নাম ছাপাতে চান নি। আর্য পাবলিশিং হাউস থেকে ‘যুগবাণী’ এবং ‘অগ্নিবীণার’ প্রকাসক হিসেবে নজরুলের নামাংকিত হয়েই বেরিয়েছিল। পরবর্তীকালে অবশ্যই অগ্নিবীণার কপিরাইট কেনেন ডি.এম লাইব্রেরি। ডি.এম লাইব্রেরী অবশ্য নজরুলের অধিকাংশ বই প্রকাশ করেন। গ্রামোফোন কোম্পানির সাথে চুক্তির আগে নজরুলের পরিবারের জীবনযাত্রা সাধারণত তার লেখার সম্মানির উপরই নির্ভর ছিল। তার ‘বিষের বাঁশি’ ও ‘ভাঙার গান’ গ্রন্থ দু’টি সরকার বাজেয়াপ্ত করেছিল কিন্তু তখন অনেকেই গোপনে বইগুলো কিনে কবিকে দু’র্দিনে সাহায্য করেছিল। অনেকের ধারণা, নজরুলের আয় ছিল প্রচুর, কিন্তু ব্যয়ের হাতখানা তার এতো দরাজ ছিল যে যেভাবে টাকা এসেছে ঠিক সেভাবে হাওয়া হয়ে গেছে। নিজে খেয়ে বন্ধু বান্ধবদের খাইয়ে এবং তার বেড়ানোর পেছনে কম টাকা খরচ হয়নি। হিসেব করে চললে হয়তো স্ত্রী প্রমীলার অসুখের সময় এইচ.এম.ভি’র সমস্ত গানের সম্মানি বন্ধক রেখে তাকে চার হাজার টাকা ধার করতে হতো না।
প্রকৃতপক্ষে নজরুল তার জীবনের সমস্ত সময় ব্যয় করেছে গান এবং সাহিত্য চর্চা নিয়ে। তার সাহিত্যে এবং গানে উঠে এসেছে দুঃখী এবং নিপীড়িত মানুষের মুখচ্ছবি। দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য নজরুল কখনো বিদ্রোহী হয়েছেন আবার কখনো প্রেমিক হয়েছেন। তার কাছে আর্থিক চিন্তা একেবারেই গৌণ ছিল। তাই হয়তো কবিকে সারা জীবন আর্থিক কষ্টে ভোগতে হয়েছে। তবে এতো কিছুর পরও নজরুল আজ কালজয়ী সাহিত্যিক। আর তাই নজরুলের গান এবং সাহিত্যে আজও পৃথিবীর অসংখ্য মানুষকে আশার পথ দেখায়। নজরুলের জীবন দর্শন এখনও অন্যান্য সাহিত্যিকদের প্রেরণা জোগায়।

শেয়ার করুন