চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

চাঁদের রাজ্যে হাজারো জলভালুক

রোজী আকতার

১৫ অক্টোবর, ২০১৯ | ২:১৬ পূর্বাহ্ণ

চাঁদের মাটিতে গত মাসে আছড়ে পড়েছিল ইসরায়েলের বেসরকারি মহাকাশযান বেরেশিট। আর এই দুর্ঘটনায় উপগ্রহটিতে ছড়িয়ে পড়েছে হাজারো ‘জলভালুক’ (টার্ডিগ্রেড)। এক মিটারের হাজার ভাগের এক ভাগ মাত্র আকারের ওই প্রাণীদের গোপনে নভোযানে তুলে দেওয়া হয়েছিল; এ বিষয়ে না কিছু জানত ইসরায়েল সরকার আর না জানত মার্কিন সরকার। এমনকি ইসরায়েলি যে বেসরকারি মহাকাশ সংস্থা এই অভিযান চালাচ্ছিল, সেই স্পেস-আইএল পর্যন্ত এ বিষয়ে কিছু জানত না। এখন প্রশ্ন উঠছে চাঁদে পার্থিব প্রাণের সম্ভাব্য বিস্তার নিয়ে, যা ‘বহিরাকাশ সুরক্ষা চুক্তি’র পরিপন্থী।

২২ ফেব্রুয়ারি চাঁদের মাটি ছোঁয়ার লক্ষ্য নিয়ে পৃথিবী থেকে উড়াল দিয়েছিল বেরেশিট। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেপ ক্যানাভেরাল মহাকাশবন্দর থেকে ফ্যালকন-৯ রকেটে করে একে উৎক্ষেপণ করা হয়। হিব্রু ভাষার বেরেশিটের মানে ‘আরম্ভ’। তবে শুরুতে এই অবতরক রোবটের নাম রাখা হয়েছিল ‘স্প্যারো’, যার অর্থ ‘চড়ুই’। চন্দ্রপৃষ্ঠে মাত্র দুই দিনের অভিযান ছিল তার, যা সফল হয়নি। ১১ এপ্রিল বেরেশিটের সফল অবতরণ হলে চন্দ্রপৃষ্ঠ ছোঁয়ায় ইসরায়েল হতো চতুর্থ দেশ। এখন সেই স্থানটি অর্জন করতে

যাচ্ছে ভারত, যাদের দ্বিতীয় চন্দ্রাভিযান (চন্দ্রযান-২) ৭ সেপ্টেম্বর চাঁদের মাটিতে নামতে যাচ্ছে।

এর আগে চাঁদের মাটিতে সফলভাবে রোবট অবতরণে সক্ষম হয়েছে মাত্র তিন দেশ-সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র এবং অধুনা চীন। সরকার পরিচালিত মহাকাশ গবেষণা সংস্থার যানই কেবল চাঁদের মাটিতে সফলভাবে অবতরণ করতে পেরেছে। বেরেশিট ছিল প্রথম কোনো বেসরকারি উদ্যোগ।
টার্ডিগ্রেড : পুঁচকে কিন্তু অদম্য প্রাণী

আমরা অনেক সময় বলি, ডায়নোসররা বিলীন হয়ে গেছে, তেলাপোকা টিকে আছে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে সবচেয়ে সহ্যক্ষমতা বেশি যে প্রাণীটির, তার নাম টার্ডিগ্রেড। আঠারো শতকে জার্মান প্রাণিবিজ্ঞানী জোহান অগাস্ট এফরাইম গজ এদের আবিষ্কার করেন। এর পর থেকেই এই প্রাণী নিয়ে বিজ্ঞানীদের বিস্ময়ের শেষ নেই। ভালুকেরা যেভাবে চলাফেরা করে, তার সঙ্গে মিল থাকায় গজ এদের নাম রেখেছিলেন ‘ক্লিনার ওয়াজারবার’ বা ‘জলভালুক’। আবার খাদ্যাভ্যাসের কারণে এদের ‘শ্যাওলা শুকর’ও বলা হয়। আকারে অতিছোট হলেও এরা বেশ শক্তপোক্ত প্রাণী; হিমশীতল, অতিউষ্ণ কিংবা বায়ুশূন্য-সব পরিবেশেই এরা টিকে থাকতে পারে। এ জন্যই এদের পৃথিবীর সবচেয়ে কষ্টসহিষ্ণু বা চরম অনমনীয় প্রাণী বলা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের মাসিক সাময়িকী ওয়াইরড তাদের অনলাইন সংস্করণে চাঁদে জলভালুকের বিষয়টি প্রথম প্রকাশ করে। যুক্তরাষ্ট্রের অলাভজনক একটি সংস্থা আর্ক মিশন ফাউন্ডেশন এই কাজটি করেছিল। এরা জ্ঞান সংরক্ষণে ‘পৃথিবীর ব্যাকআপ’ হওয়ার লক্ষ্যে কাজ করে। সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাতা নোভা স্পিভাক লস অ্যাঞ্জেলেসে বেরেশিটের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে বসে নভোযানটির চূড়ান্ত অবতরণ মুহূর্ত লাইভস্ট্রিমে দেখছিলেন। কিন্তু যখন জানা গেল বেরেশিট পরিকল্পনাকে ব্যর্থ করে বিধ্বস্ত হয়েছে, তখন স্পিভাকের মনে প্রশ্ন জাগল-তা হলে কি তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে অদম্য প্রাণী জলভালুকদের চাঁদে ছড়িয়েই দিলেন?
কিন্তু স্পিভাকের সংস্থা এই কাজটি গোপনে সেরেছেন। স্পেস-আইএল বা ইসরায়েল সরকার কিংবা নাসা বা মার্কিন সরকার-কাউকেই তারা কিছুই জানায়নি। ব্রিটিশ ডিজিটাল মিডিয়া ম্যাশেবলকে স্পিভাক বলেছেন, ‘আমরা যে এই অভিযানে জীবনও যুক্ত করছি, তাদের কাউকে আমরা তা বলিনি। মহাকাশ সংস্থাগুলো অভিযানে শেষ মুহূর্তে কোনো পরিবর্তন পছন্দ করে না। এ কারণে আমরা এ ঝুঁকিটা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।’

সূর্যের উচ্চ বিকিরণে, তাপমাত্রার হরদম রদবদল এবং প্রায় শূন্য আবহাওয়ার চাঁদে অ্যাম্বারে আচ্ছাদিত নির্জল করা এই জলভালুকেরা হয়তো আর জীবন ফিরে পাবে না; কিন্তু প্রশ্ন উঠছে-পাঁচ দশকের পুরনো চুক্তি কি তাহলে মূল্যহীন হয়ে পড়েছে? এখন কি তবে নতুন আন্তর্জাতিক মহাশূন্য আইন প্রণয়নের প্রয়োজন অবশ্যাম্ভাবী? কেননা বেসরকারি মহাকাশ সংস্থার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে এবং স্পিভাকের মতো আত্মস্বীকৃত ‘মহাকাশের জলদস্যু’র সংখ্যা বাড়ার আশঙ্কাও রয়েছে।
বহিরাকাশ সুরক্ষা চুক্তি

পৃথিবীর বাইরে অন্য কোনো মহাজাগতিক বিশ্বে কোনো পার্থিব অণুজীব বা প্রাণের বিস্তার ঘটানো যাবে কিনা, এ নিয়ে ১৯৬৭ সালে জাতিসংঘে একটি বৈশ্বিক চুক্তি হয়। এর নাম আউটার স্পেস ট্রিটি; আমরা বলতে পারি ‘বহিরাকাশ সুরক্ষা চুক্তি’। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও রাশিয়া ওই বছর জানুয়ারিতে চুক্তিটির সূত্রপাত করেন। একই বছর অক্টোবরে তা কার্যকর হয়। ১০৯টি দেশ এতে সই করে। এই চুক্তি অনুযায়ী-

১. পৃথিবীর বাইরের আকাশে অনুসন্ধান চালালে তা সব দেশের আগ্রহ ও কল্যাণের জন্য হতে হবে। অনুসন্ধান চালানো ওই অঞ্চল সমগ্র মানবজাতির বলে বিবেচিত হবে।
২. বহিরাকাশ অনুসন্ধানের জন্য উন্মুক্ত হতে হবে এবং সব রাষ্ট্রই ব্যবহার করতে পারবে।
৩.সার্বভৌমত্ব দাবি করে বহিরাকাশকে কোনো রাষ্ট্র ব্যবহার বা অধিকরণ কিংবা অন্য কোনো অর্থেই গ্রাস করতে পারবে না।
৪. পৃথিবীর কক্ষপথে কিংবা শূন্যে কোনো বস্তুতে কিংবা বহিরাকাশে গণবিধ্বংসী কোনো অস্ত্র রাখতে পারবে না কোনো রাষ্ট্রই।
৫. চাঁদ এবং এ রকম অন্যান্য অপার্থিব বিশ্ব শান্তিপূর্ণ কোনো উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে।
৬. নভোচারীরা মানবজাতির দূত হিসেবে বিবেচিত হবেন।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট