চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

অনুপম স্মৃতিসৌধ তাজমহল

রোজী আকতার

১০ মার্চ, ২০২০ | ৩:০৭ পূর্বাহ্ণ

প্রখ্যাত স্মৃতিসৌধ। এটি ভারতের উত্তর প্রদেশের আগ্রা নগরীতে অবস্থিত। ভারতবর্ষের পঞ্চম মোগল সম্রাট শাহজাহান এই স্মৃতিসৌধটি নির্মাণ করেন। ১৬৩১ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট শাহজাহানের দ্বিতীয় স্ত্রী মমতাজ মহল (আরজুমান্দ বানু) চতুর্দশ সন্তান গওহর বেগমের প্রসবের সময় মৃত্যুবরণ করেন। এই স্ত্রীর মৃত্যুতে শাহজাহান প্রচণ্ড শোকাহত হন। এই স্ত্রীর স্মরণে তিনি একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের উদ্যোগ নেন। এই স্মৃতিসৌধটি তাজমহল নামে খ্যাত। উল্লেখ্য তাজমহল তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল ১৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে, মূল সৌধের অংশ শেষ হয়েছিল ১৬৪৩ খ্রিষ্টাব্দে। আর পরিকল্পনা অনুসারে সম্পূর্ণ তাজমহল শেষ হয়েছিল ১৬৫৩ খ্রিষ্টাব্দে। তাজমহল তৈরির ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের গুণী প্রকৌশলী নিয়োগ করা হয়েছিল। বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রকৌশলীদের যে তালিকা পাওয়া যায়, তা হলো ১. পারস্যদেশীয় স্থপতি, ওস্তাদ ঈসা। ইনি চত্বরের নকশা করার বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন, ২. বড় গম্বুজটির নকশা করেছিলেন অটোমান সাম্রাজ্য থেকে আগত ইসমাইল খা, ৩. কাজিম খাঁন লাহোরের বাসিন্দা, বড় গম্বুজের চূড়ার স্বর্ণের দণ্ড স্থাপন করেছিলেন, ৪. চিরঞ্জিলাল দিল্লি থেকে আগত প্রধান ভাস্কর ও মোজাইক-কারক, ৫. আমানত খাঁ প্রধান চারুলিপিকর। তার নাম তাজমহলের প্রবেশপথের দরজায় প্রত্যায়িত করা আছে, ৬. মোহাম্মদ হানিফ। রাজমিস্ত্রিদের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন এবং ৭. মীর আব্দুল করিম এবং মুক্কারিমাত খাঁন প্রধান ব্যবস্থাপক।
শাহজাহান তাজমহলের জন্য যমুনা নদীর তীরে আগ্রা শহরের দক্ষিণে একটি জায়গা নির্বাচন করেন। এই জায়গাটির মালিক ছিল মহারাজা জয় শিং। শাহজাহান তাঁকে আগ্রা শহরের মাঝখানে একটি বিশাল প্রাসাদ দেয়ার বদলে জমিটি অধিগ্রহণ করেন। সম্পূর্ণ এলাকাকে নদীর পাড় থেকে প্রায় ৫০ মিটার উঁচু করা সমান করা হয়। এরপর পুরো তাজমহলের জন্য ৫৫ মিটার লম্বা জায়গা তৈরি করা হয়। এর ভিতরে সমাধি স্থানের জন্য ১৮ মিটার ব্যাসের জায়গা নির্বাচন করে। এরপর ২৪ মিটার উচ্চ সমাধিভবন তৈরি করা হয়।
পরিকল্পনা অনুসারে, তাজমহলের সামনের চত্বরে একটি বড় চারবাগ (মুঘল বাগান পূর্বে চার অংশে বিভক্ত থাকতো) করা হয়েছিল। ৩০০ মিটার জায়গার বাগানের প্রতি চতুর্থাংশ উঁচু পথ ব্যবহার করে ভাগগুলোকে ১৬টি ফুলের বাগানে ভাগ করা হয়েছিল। এর ভিতর মাজার অংশ এবং দরজার মাঝামাঝি আংশে এবং বাগানের মধ্যখানে একটি উঁচু মার্বেল পাথরের পানির চৌবাচ্চা বসানো হয়েছিল। তাজমহলকে অধিকতর সৌন্দর্যম-িত করার জন্য বাগানের নকশায় যমুনা নদীটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।
তাজমহল এর চত্বরটি বেলে পাথরের দুর্গের মত দেয়াল দিয়ে তিন দিক থেকে বেষ্টিত। নদীর দিকের পাশটিতে স্বল্প উচ্চতার দেয়াল আছে। এই দেয়াল বেষ্টনির বাইরে আরও সমাধি রয়েছে যার মধ্যে শাহজাহানের অন্য স্ত্রীদের সমাধি এবং মমতাজ মহলের প্রিয় পরিচারিকাদের একটি বড় সমাধি রয়েছে। এ স্থাপত্যসমূহ প্রধানত লাল বেলে পাথর দ্বারা তৈরি, দেখতে সেসময়কার ছোট আকারের মুঘল সাধারণ সমাধির মতন। দেয়ালের ভিতরের দিকটা হিন্দু মন্দিরে আদলে তৈরি। দেয়ালগুলোয় বিচিত্র গম্বুজাকৃতির ইমারত দিয়ে সংযুক্ত। এগুলোকে পর্যবেক্ষণ চৌকি হিসেবে ব্যবহার করা হতো। বর্তমানে এই অংশ জাদুঘর হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
তাজমহলে ঢোকার প্রধান ফটক মার্বেল পাথরে তৈরি। এর উপরে রয়েছে অনেকগুলো ছোটো গম্বুজ। দরজাটির নকশা ও ধরন মুঘল সম্রাটদের স্থাপত্যরীতির। এর খিলানসমূহের আকৃতি সমাধির খিলানসমূহের অনুরূপ।
তাজমহল তৈরির জন্য নানা দেশ থেকে নানা ধরনের উপকরণ সংগ্রহ করা হয়েছিল। এর ভিতরে ছিল মাখরান নামক আলো-প্রবাহী অস্বচ্ছ সাদা মার্বেল পাথর। এই পাথর আনা হয়েছিল রাজস্থান থেকে। পাঞ্জাব থেকে আনা হয়েছিল লাল, হলুদ বা বাদামী রঙের মধ্যম মানের পাথর। চীন থেকে আনা হয়েছিল ইয়াশ্ম্ নামক কঠিন, সাদা, সবুজ পাথর এবং স্ফটিক টুকরা, তিব্বত থেকে সবুজ-নীলাভ (ফিরোজা) রঙের বৈদূর্য রত্ন এবং আফগানিস্তান থেকে নীলকান্তমণি আনা হয়েছিল। এছাড়া নীলমণি (উজ্জ্বল নীল রত্ন) আনা হয়েছিল শ্রীলঙ্কা থেকে। নির্মাণ কাজের সময় এসকল সামগ্রী বহনের জন্য ১,০০০ এরও বেশি হাতি ব্যবহার করা হয়েছিল। আর ২০,০০০ শ্রমিক এই নির্মাণ কাজে অংশ নিয়েছিল। তাজমহল সম্প্রতি যে হুমকির মুখে পড়েছে তা হল যমুনা নদীর তীরের পরিবেশ দূষণ। সাথে আছে মাথুরাতে তেল পরিশোধনাগারের কারণে সৃষ্ট এসিড বৃষ্টি। ১৯৮৩ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট