চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

শিল্পচর্চা হয় ভালোবেসে, হিসেব করে নয়

একান্ত সাক্ষাৎকারে আবৃত্তিশিল্পী মুনমুন মুখার্জী

তাসফিয়া ফারিহা

২৬ অক্টোবর, ২০১৯ | ২:১৫ পূর্বাহ্ণ

কোন মা যেমন নিজের সন্তানদের মাঝে ভেদাভেদ করতে পারেন না, কাকে বেশি ভালোবাসেন, আমার ক্ষেত্রেও কবিতা ঠিক তেমনিই। নিজের পছন্দের কবিতা সম্পর্কে জানতে চাইলে এভাবেই সাবলীল মনোভাব ব্যক্ত করলেন মুনমুন মুখার্জী। দুই বাংলাতেই সমানভাবে জনপ্রিয় এই বাচিকশিল্পী সম্প্রতি এসেছিলেন চট্টগ্রামের রেডিসন ব্লুতে। বঙ্গবন্ধু শিশু-কিশোর মেলার আয়োজনে অনুষ্ঠিত হওয়া ‘প্রণতি গ্রহণ করো’ শিরোনামের একটি অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করেন ২০টি কবিতা। কলকাতার জনপ্রিয় ও প্রতিভাবান বাচিকশিল্পী মুনমুন মুখার্জী ছিলেন দৈনিক পূর্বকোণের এবারের আড্ডায়।
পূর্বকোণ: কেমন আছেন?
মুনমুন মুখার্জী: অনেক ধন্যবাদ, ভালো আছি।
পূর্বকোণ: চট্টগ্রাম কেমন লাগছে?
মুনমুন মুখার্জী: চট্টগ্রামের সাথে তো আমার প্রথম দেখা। আমি শুনেছিলাম চট্টগ্রাম প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে খুব সুন্দর একটা শহর। যেখানে রয়েছে সমুদ্র, নদী আর পাহাড়। বরং চট্টগ্রামের মানুষদের সাথে পরিচয় হয়ে অনেক ভালো লাগা কাজ করছে।
পূর্বকোণ: কবিতার সাথে ভালো লাগা ও ভালবাসার সম্পর্কেও শুরুটা কবে থেকে?
মুনমুন মুখার্জী: আমি কবিতা শিখতে শুরু করি একদম ছোটবেলায়, চার বছর বয়স থেকেই। মায়ের হাত ধরেই প্রথম কবিতা শিখতে যাওয়া। চার বছর বয়স থেকে যখন আমি কবিতা শিখতে শুরু করি তখন আমি নাচ, গান, আঁকা সবই শিখতাম। কিন্তু এতকিছুর মাঝে থেকে সবচেয়ে ভালো লেগে গেল আবৃত্তিকে, ওটাই থেকে গেল সাথে।
পূর্বকোণ: মুনমুন মুখার্জী যদি একজন আবৃত্তিশিল্পী না হতেন তবে কী হতেন? অন্য কোন শিল্পের প্রতি কী ঝোঁক আছে?
মুনমুন মুখার্জী: আবৃত্তিশিল্পী হওয়ার ছিল তাই

হয়ত সেটাই হয়েছি, অন্য কিছু হয়ত হওয়ার ছিল না। তবে আমি তিনটি টিভি চ্যানেলে উপস্থাপনা করি। কিন্তু সেটার জায়গা আলাদা। তবে চার বছর বয়স থেকে যে আবৃত্তি করছি তার সঙ্গেই এখনো জুড়ে রয়েছি।
পূর্বকোণ: আপনার পছন্দের কবি ও কবিতা সম্পর্কে জানতে চাই।
মুনমুন মুখার্জী: পছন্দের কবি অনেকেই আছেন। এ ব্যাপারে একটি কথা বলি। যিনি লিখেন তিনি তো তার সবটা ভালো লাগা দিয়েই লিখেন, সেই কবিতা বা লেখাটা হয়ত আমরা সব সময় সেভাবে এক্সপ্রেস করতে পারিনা। সেটা কিন্তু আমাদের অক্ষমতা। কিন্তু কবি হিসেবে সবাই তার ১০০% দিয়েই লেখার চেষ্টা করেন। আর সেই হিসেবে সকলেই ভালো লাগার। আর আমার পছন্দের কবিতা অসংখ্য, যেকোন একটি কবিতার নাম বলা যাবেনা। কারণ যেগুলো পছন্দের সেগুলোই তো আবৃত্তি করি।
পূর্বকোণ: দেশের আবৃত্তি সংগঠনগুলো আবৃত্তি শেখার ক্ষেত্রে যেভাবে কাজ করছে সে মানের আবৃত্তি শিল্পী কি আমরা পাচ্ছি?
মুনমুন মুখার্জী: আবৃত্তি শিল্পী পাওয়ার জন্য কোন সংগঠন কাজ করেনা। সংগঠনে যারা কাজ করেন বা আবৃত্তি চর্চা করেন তারা শিল্পটাকে ভালোবেসেই কাজ করেন। এ ব্যাপারে আমি একটা কথা বলতে চাই, আমাদের দুই বাংলায় হাজারে একজন শিল্পীর জন্ম না হতে পারে, কিন্তু হাজারে একটা ঘরে শিল্পটা পৌঁছে যাক, সেটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। শিল্প যদি পৌঁছে যায়, শিল্পী নিজেই তৈরি হবে।
পূর্বকোণ: যেমনটা আপনি বললেন, খুব ভালো লাগার জায়গা থেকেই আবৃত্তিটা করা। পেশা হিসেবে কেউ নিতে চাইলে আবৃত্তির ভবিষ্যৎ কেমন?
মুনমুন মুখার্জী: আমি মনে করি নাচ, গান, আবৃত্তি এগুলো তো শিল্প মাধ্যম। শিল্প মাধ্যমের সাথে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার যে মাধ্যম তার একটা তফাৎ রয়েছে। আমাদের ছোটবেলা থেকে যে পড়াশুনা করতে হয় সেটা কিন্তু বাধ্যতামূলক। কিন্তু শিল্পচর্চা যখন আমরা করি তখন সেটা খুব ভালোবেসেই করি। তখন কিন্তু এটা মনে হয় না আমি নৃত্যশিল্পী হব তাই নাচটা শিখছি। বরং শিখতে শিখতে কারো যদি মনে হয় তার প্রতিভা সেই জায়গায় তাকে উত্তীর্ণ করলো তখন একজন শিল্পীকে আমরা পাই। আর তাই আমি জীবনে কী এচিভ করবো বা কোন জায়গাটায় পৌঁছাব তার হিসেবটা না করাই উচিত। কারণ, শিল্প কখনো হিসেব করে চর্চা হয়না,ভালোবেসেই এর চর্চা হয়।
পূর্বকোণ: আপনার কী মনে হয় নাচ, গান, অভিনয় বা অন্যান্য শিল্প যতটা প্রাধান্য পাচ্ছে আবৃত্তি শিল্পও কি ততটা প্রাধান্য পাচ্ছে?
মুনমুন মুখার্জী: প্রাধান্য না পেলে আমার চ্যানেলে দুই লাখ সাবস্ক্রাইবার কীভাবে হলো! এখানে কিছু বিষয় আছে। আমরা শুধু বলি লোকে শুনছেনা, আমাদেরও কিন্তু একটা দায়বদ্ধতা আছে মানুষকে শোনানোর। মানুষের কী দায় বলুন তো? আমাদের কবিতা মানুষকে কেন শুনতেই হবে তার সময় দিয়ে, পরিশ্রম দিয়ে বা তার জন্য টিকেটের ব্যবস্থা করলে সেটার মূল্য দিয়ে? তার তো কোন দায় নেই। সে তখনই শুনবে যখন আমরা তাদের টানতে পারি। মানুষকে টানতে না পারলে সেটা আমাদের ব্যর্থতা, আর পারলে সেখানটাতেই আমাদের সার্থকতা।
পূর্বকোণ: একজন ভালো আবৃত্তিশিল্পী হতে হলে কী কী গুণাবলী থাকা উচিত বলে আপনার মনে হয়?
মুনমুন মুখার্জী: একজন ভালো আবৃত্তিশিল্পী হতে গেলে আবৃত্তিটাকে ভীষণ ভালোবাসতে হয়। আর ভালোবাসলে সেখানে পরিশ্রমের জায়গাটাও থাকে। এখানে আমি একটা কথা বলি, আপনি যেমনটা জানতে চেয়েছিলেন পেশা হিসেবে আবৃত্তিকে নিতে গেলে কী করতে হবে। আমার মনে হয় এটাকে পেশা হিসেবে নিব কি নিব না সেটা আমার চয়েস হতে পারেনা। কারণ শিল্পী নিজেকে নিজে তৈরি করতে পারেনা, শিল্পী তৈরি করেন মানুষ। এটি একটি চিরকালীন সত্য। স্বাভাবিকভাবে মানুষ যদি আমাকে শিল্পীর মর্যাদা দেন অটোমেটিক্যালি সেটা আমার কাছে প্রফেশন হিসেবে চলে আসে আর যদি সেভাবে মানুষ না শুনেন তাহলে শিল্পটাকে ভালোবেসে চর্চা করে যাওয়া উচিত অন্যকে শোনানোর জন্য। এ ধরনের শিল্পকার্য যেগুলো আমরা করি তাতে প্রথমে সবকিছু পাওয়া যায়না। কিন্তু তারপরেও যদি ধৈর্য রেখে এটার সাধনা করে যাওয়া উচিত। কারণ কখনো কখনো সাধনার কোন বিকল্প হয়না।
পূর্বকোণ: চট্টগ্রামে তো আপনি প্রথমবার এসেছেন। চট্টগ্রামের বিভিন্ন আবৃত্তি সংগঠনের অনেকেই আপনার আবৃত্তি দেখেছেন। ভবিষ্যতে চট্টগ্রামের আবৃত্তি সংগঠনগুলো নিয়ে কাজ করার কোন ইচ্ছে কী আছে?
মুনমুন মুখার্জী: আবৃত্তি সংগঠনগুলো খুব ভালোভাবেই কাজ করছেন। তবে তারা যদি আমাকে কখনো পেতে চান তবে অবশ্যই আমাকে পাওয়া যাবে। আবৃত্তি সংগঠনগুলো এমনিতেই ভালো কাজ করছে, তাদের জন্য আমার অনেক অনেক শুভেচ্ছা।
পূর্বকোণ: চট্টগ্রামের আবৃত্তিশিল্পীদের উদ্দেশ্যে কিছু কী বলার আছে?
মুনমুন মুখার্জী: চট্টগ্রামের আবৃত্তিশিল্পীরা খুব ভালো আবৃত্তি করেন। আমি শুনেছি তাদের আবৃত্তি। সত্যি কথা বলতে, বাংলাদেশের যারা আবৃত্তিশিল্পী তারা খুব ভালোবেসেই শিল্পচর্চাটা করেন, এর সঙ্গে যুক্ত থাকেন। আর তাই তাদেরকে আমার আলাদাভাবে সাজেশন দেয়ার কিছু নেই। আপনারা এভাবেই ভালোবাসায় থাকুন, ভালোবাসায় থাকলে এমনিতে ভালোবাসা পাবেন সবার কাছ থেকে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট