চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

অভিযান থেমে গেলে নিয়ন্ত্রণ থাকবে না সরকারের

একান্ত সাক্ষাতকারে সাবেক আইজিপি

ইমরান বিন ছবুর

২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ২:৩১ পূর্বাহ্ণ

এটা সত্যি যে, পুলিশ কর্তৃপক্ষ এই জুয়া বা ক্যাসিনার ব্যাপারে জানতো। এর দাপ্তরিক প্রমাণ হচ্ছে এটা নিয়ে চিঠি চালাচালি হয়েছে। ২০১৭ সালে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে। আবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় পুলিশ হেডকোয়াটরে চিঠি দিয়েছে। পুলিশের চোখে এসব না পড়লেও পুলিশ এবিষয়ে চিঠি তো পেয়েছে। এর ধারা বুঝা যায়, পুলিশ এ বিষয়ে জানতো। জানার পর পুলিশ কেন ব্যবস্থা নেয়নি এটা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়, সে সময়ে পুলিশের উপরের মহলে যারা ছিল, তাদের কেউ কেউ হয়তো বিষয়টি জানতো। জানার পরও কিন্তু চোখ বন্ধ করে ছিল। যদি সরকারের উর্দ্ধতন মহলের অনুমতি ছাড়া এক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেয়া যায় না। এক্ষেত্রে প্রশ্ন থাকবে, পুলিশের ঊর্দ্ধতন মহল থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে কিনা। এ ধরনের কোন পদক্ষেপ বা ব্যবস্থা নিয়েছে কিনা, যদি ব্যবস্থা নিত আমরা সবাই জানতে পারতাম। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় থেকে পুলিশ হেডকোয়ার্টার কখনো কোন নির্দেশনা চায়নি ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ক্যাসিনো চলছে এবং ছেয়ে গেছে, আমরা এটার বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেব। তারা যদি যোগাযোগ করতেন তাহলে কোন একটা সিদ্ধান্ত তো আসতো। চলমান অভিযান সম্পর্কে দৈনিক পূর্বকোণের সাথে আলাপে একথা বলেন প্রাক্তন ইনস্পেক্টর জেনারেল অব পুলিশ (আইজিপি) নুরুল আনোয়ার।

তিনি বলেন, পুলিশের আইজির সুযোগ আছে কখনো কখনো সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করার এবং কথা বলার। এই সুযোগ তারা নিয়েছেন কিনা। যদি না নিয়ে থাকেন, তাহলে কেন নেননি। ডিএমপির কমিশনার বলেছেন, ‘ক্যাসিনো কি আমি জানি না।’ এটা কি বললে হবে। তিনি বলতে পারতেন, আমরা জানতাম কিন্তু এ কারণে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারিনি। তার মত একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি একথা বলতে পারেন, ‘আমি ক্যাসিনো বুঝি না’। তাহলে বুঝা যাচ্ছে, পুলিশের ঊর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ বিষয়টি ভালো করে জানতেন। তারা কেন এসব বন্ধ করার পদক্ষেপ নেননি সেটা আমার জানা নেই। তবে আমি এটা নিশ্চিত বলতে পারি, পুলিশ এসব জিনিস পরিচালনা করে না। পাহারাও দেয় না। পুলিশ যেটা করে দায়িত্ব এড়িয়ে যায়।

১৯৯৩-৯৪ সালে রাঙামাটি থেকে উপ-কমিশনার পদে ঢাকায় আমার পোস্টিং হলো। তখন মেয়র ছিলেন মির্জা আব্বাস। আমি যখন এসব বন্ধ করার জন্য বলতে লাগলাম, তখন আমাকে বলেন, এসব বন্ধ করা সম্ভব না। এটার সাথে অনেকে জড়িত। তখন আরামবাগ এলাকায় মাঝেমধ্যে জুয়া খেলা এবং মদ বিক্রি হতো। কিন্তু ক্যাসিনো ছিল না।

আমি এসব বন্ধ করার জন্য চাপাচাপি করাতে মির্জা আব্বাস তার শাহজাহানপুর বাসায় আমাকে চায়ের দাওয়াত দেন। বাসায় তখন তার ভাই মির্জা খোকন, ফালুর একজন প্রতিনিধি, সাদেক হোসেন খোকা এবং কয়েকজন কমিশনার ছিলেন। আপ্যায়নের পর সবাই চলে যাওয়ার পর, আমাকে মির্জা আব্বাস খোলাখুলি বলেন, আমরা রাজনীতি করি আমাদের অনেক কিছু মেনে চলতে হয়। আমাদের ছেলেপেলে থাকে তাদের আর্থিক সাহায্য করতে হয়। তাদের এখরচ কোত্থেকে আসবে? এসব জায়গা থেকে তাদের খরচের ব্যবস্থা করতে হয়।

তিনি আমাকে আরো বলেন, আপনি তো পাহাড়ি এলাকা থেকে এসেছেন, অনেক জিনিস এখনো বুঝেন না। এসব একটু এভয়েড করিয়েন। আর আপনি বললে আমাদের লোকজন আপনার সাথে যোগাযোগ করবে। (তিনি আর্থিক লেনদেনের জন্য ইংগিত দিয়েছেন)। এরপর আমি তিন থেকে চার দিন এসব বন্ধ রেখেছিলাম। এরপরই আমি রাঙামাটি জেলায় বদলি হয়ে গেলাম। তখন আমি পুলিশের আইজি শাহজাহান সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম, আমি কেন বদলি হলাম? তিনি আমাকে উত্তর দিলেন, আমরা তো জানি না, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রস্তাব দিয়েছেন, প্রধানন্ত্রী সই করেছেন। আমরা কিছু জানি না। এরপর আমাকে প্রস্তাব দিলেন, আপনি যদি আবার আসতে চান তাহলে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ করেন। আমি কারো সাথে যোগাযোগ না করে রাঙামাটি চলে গেলাম।

সাবেক আইজিপি আরো বলেন, পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি এসব না চায় তো, তাহলে এসবের বিরুদ্ধে সরকারের কাছে লিখতো। ‘প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এসব করছে, সামাল দেয়া যাচ্ছে না, পুলিশের বদনাম হবে। আমরা সরকারের কাছে এব্যাপারে নির্দেশনা চাইছি।’ পুলিশ এ ধরণের কোন মেসেজ সরকারকে দিয়েছে বলে আমার জানা নেই। পুলিশ বা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিয়ে লজ্জাজনক নানা রকম গুজব বা কথা আমরা শুনতে পাচ্ছি।
চলমান অভিযান অব্যাহত থাকবে কিনা, এমন প্রশ্নের উত্তরে নুরুল আনোয়ার বলেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী যেখানে হাত দেয়, সে হাত মাঝপথে থামানোর সুযোগ নেই। যদি থামায় সরকারের আর কোন নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। যেখানে হাত দিচ্ছে সেখানেই টাকা পাওয়া যাচ্ছে, স্বর্ণ পাওয়া যাচ্ছে। মানুষ যে এতো পঁচে গেছে প্রধানমন্ত্রী তা বুঝতে পারেননি।
এ সমস্ত অপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা করে কোন এজেন্সি একা সামাল দিতে পারবে না। এখানে অনেক বড় বড় মাথা রয়েছে। আমি মনে করি, বিভিন্ন এজেন্সিকে আলাদা আলাদা করে দিলে ভালো হয়। কিছু দুদক করবে, কিছু, এনবিআর করবে, কিছু পিবিআই করবে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট