চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

দক্ষিণ এশিয়ার মাথাব্যথা রোহিঙ্গা

একান্ত সাক্ষাতকারে মেজর (অব.) এমদাদুল

মোহাম্মদ আলী

২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১:৩৪ পূর্বাহ্ণ

চীন ও ভারত তাদের ভূ-রাজনৈতিক কারণে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যেতে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। এ কারণে রোহিঙ্গারা তাদের দেশে ফিরে যেতে বিলম্ব হচ্ছে। রোহিঙ্গারা ফিরতে দেরি হলে একদিন তারা পুরো দক্ষিণ এশিয়াকে অস্থির করে তুলবে। এ কারণে সমস্যা শুধু একা বাংলাদেশের হবে না। পুরো এশিয়ার সবগুলো দেশই তাদের দ্বারা আক্রান্ত হবে। তাই পার্শ্ববর্তী দেশগুলো এ সমস্যা বুঝতে বিলম্ব করলে সবাইকে একদিন এর মাশুল গুনতে হবে। দেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) মো. এমদাদুল ইসলাম দৈনিক পূর্বকোণকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে একথা বলেন।

রোহিঙ্গারা অবৈধভাবে বাংলাদেশের স্মার্টকার্ড, পাসপোর্ট তৈরি, ইয়াবা ব্যবসাসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ার প্রসঙ্গে মেজর (অব.) মো. এমদাদুল ইসলাম বলেন, ‘বর্তমানে এই রোহিঙ্গারা আমাদের জন্য একটি বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। আসলে কোন মানুষ একটি গন্ডির মধ্যে থাকতে পারে না। তার মধ্যে গত দুই বছর ধরে তারা এমন একটি জায়গায় আবদ্ধ হয়ে আছে। যেখানে কোন আলো নেই, ভবিষ্যৎ নেই। সেখান থেকে আশাহীন মানুষগুলো পালাতে চাইবেই। এটি মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। কিন্তু এদের সেই জায়গায় ধরে রাখার দায়িত্ব আমাদের। আর আমরা সেটাই চেষ্টা করে যাচ্ছি। এর মধ্যে পাঁচ-দশজন মানুষ কোথাও চলে গেলে এটি এমন বড় কোন অন্যায়ও বলা যায় না। ঠিক আছে তাদের আমরা সাহায্য করেছি। কিন্তু তারাওতো মানুষ। যদিও কোথাও চলে যায় তবে এদের খুঁজে আনা আমাদেরই দায়িত্ব। আবার এদের স্মার্টকার্ড, জন্মনিবন্ধন সনদ, পাসপোর্ট যারা দিচ্ছে তারা আমাদেরই বাংলাদেশি। এরা লোভে পড়ে এই রোহিঙ্গাদের স্মার্টকার্ড দিচ্ছে। আবার এটির ওপর ভিত্তি করে রোহিঙ্গারা এদেশ থেকে অন্য দেশে বিশেষ করে মালেশিয়া, সৌদিআররে তাদের আত্মীয়স্বজনের কাছে পালানোর চেষ্টা করছে। এর আগেরও এমনটি হয়েছিল। তারা যখন দেখছে ৮ বাই ১২ থেকে ১৩ ফুটের একটি ক্যাম্প ঘরে তাদের থাকতে হচ্ছে, তখন তাদের মধ্যে এমন উৎশৃঙ্খলতা সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। অথচ তাদের যেখানে নিজ বসতবাড়ি ছিলো সেখানে তাদের এই পাড়ায় একটি বাড়ি তো ঐ পাড়ায় আর একটি বাড়ি ছিল। সেখানে তারা অনেক খোলামেলা পরিবেশের মধ্যে বেড়ে উঠেছিল। এ অবস্থায় এই ক্যাম্প জীবন তাদের জন্য সত্যিই দুর্বিসহ। তাই তারা তাদের এই জীবনকে তুচ্ছ মনে করে। এদেশে এখন নতুন করে মাদক চোরাচালান সৃষ্টি হয়নি। আগেও অনেক হয়েছে। এখন যদি আমাদের দেশের কেউ কেউ তাদের টাকার লোভ দেখায়, তবে তারাতো এসব করবেই। কারণ তারাতো চাইবেই তাদের পকেটটা ভারি হোক। সন্তানদের নিয়ে একটু ভালো থাকা, ভালো খাওয়া এসব সবাই চাইবে। মূল কথা হচ্ছে তাদের দিয়ে এসব কারা করাচ্ছে তাদেরই বের করতে হবে। বাংলাদেশের সবসময় এতো অপকর্ম হচ্ছে এসব কিছূ কি রোহিঙ্গারাই করছে ? আসলে এসব ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে এতো টানাটানি করে বড় ইস্যুকে ধামাচাপা দেওয়ার একটি নাটক। কিন্তু কাল যদি এই রোহিঙ্গাদের আবার তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হয়, তবে কি তারা আর এ দেশে আসবে পাসপোর্টের জন্য ? তাই আমাদের এখন প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত তাদেরকে কিভাবে ফেরত পাঠানো যায়। তাহলে রোহিঙ্গা সমস্যা অটোমেটিক সমাধান হয়ে যাবে। যতদিন পর্যন্ত তাদের এই দেশ থেকে তাদের দেশের ফেরত পাঠাতে না পারি ততদিন পর্যন্ত আমাদের সহ্য করতে হবে। কারণ আমরা প্রথমে এদের স্থান দিয়ে পৃথিবীব্যাপী যে মানবিকতা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছি, তাতো আমরা এখন নষ্ট করতে পারি না। আমরা সেই দেশ যারা মানবতার দিকে পৃথিবরি অন্যান্য জাতির চেয়ে অনেক উপরে। গত দুই বছরে একজন রোহিঙ্গাও না খেয়ে মারা যায়নি। কাপড়ের অভাবে ছেঁড়া কাপড় পড়েনি। বিনাচিকিৎসা মরেনি একজন রোহিঙ্গাও। এটাই হচ্ছে বাংলাদেশ। তাই আমাদের সেই নৈতিক শক্তিকে ধরে রাখতে হবে। কিন্তু এখন যে রোহিঙ্গারা এনআইডি কার্ড বানাচ্ছে, তা দিয়ে যখন পাসপোর্ট করতে যাবে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সঙ্গে সঙ্গে বুঝা যাবে সে একজন রোহিঙ্গা। তবে এ বিষয় আমাদের আরো আগেই সজাগ হওয়া দরকার ছিল। তবে এখন যখন ধরা পড়েছে রোহিঙ্গাদের দিকে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আরো সজাগ দৃষ্টি রাখছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শুধু তাদের ধরেইনি তারা সেটাকে প্রকাশ করেছে। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও নিয়েছে এবং অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখির ব্যবস্থাও নিচ্ছে।

রোহিঙ্গাদের নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে বিরূপ মনোভাব প্রসঙ্গে মেজর (অব.) মো. এমদাদুল ইসলাম বলেন, ‘রোহিঙ্গা নিয়ে টেকনাফ, উখিয়া ও কক্সবাজার এলাকার মানুষের তো সমস্যা হবেই। কারণে এই স্থানগুলোতে রোহিঙ্গাদের এক বিশাল অংশ দখল করে আছে। আবার এই রোহিঙ্গাদের জন্য দেশ বিদেশ থেকে আসছে রিলিফ। তারা বসে বসে সেই সুযোগগুলো ভোগ করেছে। আবার এখানের স্থানীয় বাসিন্দারা দেখছে একসময় তারা যেখানে কাঠ কাটতো সেখানে এখন আর কাঠ কাটার সুযোগ নেই। যেখানে গরু পালন করতো সেখানে এখন দখল করে আছে অন্য দেশের মানুষ। এক কথায় তাদের সবকিছু এখন বেদখল হয়ে গেছে। তারা একসময় সহজে কাজ পেত। এখন আর পায় না। সেটার উপর আঘাত আসছে। কারণ স্থানীয় বাসিন্দারা আগে যে পারিশ্রমিকে কাজ করতো এখন রোহিঙ্গারা তার চেয়ে অনেক কম টাকায় সেই কাজ করছে। এই যে অর্থনৈতিক একটি সমস্যা তা স্থানীয়দের মধ্যে প্রভাব পড়ছে। তারা মনে করছে তাদের সবকিছুই এ রোহিঙ্গারা দখল করে ফেলেছে। কিন্তু এখন জাতিসংঘ একটি ঘোষণা দিয়েছে যে, রোহিঙ্গাদের জন্য স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে যারা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে তাদেরকে সাহায্যের ব্যবস্থা করবে। এটি যদি শুরু হয় তবে স্থানীয় আর রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিশাল সমস্যার সমাধান অনেকাংশে লাগব হবে। এই রোহিঙ্গাদের নিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির উপরও এক ধরণের প্রভাব পড়ছে। তাদের পিছনে যে টাকা ব্যয় হচ্ছে তা দিয়ে দেশের উন্নয়ন করা যেতো। আমাদের সেনাবাহিনী সবসময় তাদের নিরাপত্তা দিচ্ছে। আমাদের সেনাবাহিনী বর্তমানে বিশ্বে অত্যন্ত প্রশংসিত বাহিনী। শান্তিরক্ষা মিশনে তারা পৃথিবীর অন্যান্য দেশে অত্যন্ত সুনামের সাথে কাজ করছে। এই রোহিঙ্গাদের নিদির্ষ্ট জায়গায় রাখতে সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সেই দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।’ রোহিঙ্গাদের নিয়ে চলমান সমস্যা সমাধান প্রসঙ্গে মেজর (অব.) মো. এমদাদুল ইসলাম বলেন, ‘মূলতঃ পুরো বিষয়টি বাংলাদেশের উপর নির্ভর করে না। এই সমস্যা যারা সৃষ্টি করেছে তাদেরই এই সমস্যার সমাধান করতে হবে। এই সমস্যাতো সৃষ্টি করেছে মিয়ানমার। তাই তাদের এই সমস্যার সমাধান করতে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ জাতিসংঘ থেকে শুরু করে সবাই বৈধ প্রমাণ দিয়ে বলেছে মিয়ানমারই এই রোহিঙ্গাদের সর্বশ্বান্ত করেছে। তাদের উপর গণহত্যা চালিয়েছে, ধর্ষণ করেছে। কিন্তু এতো কিছুর পরেও জাতিসংঘ তাদের কিছু করতে পারেনি। আবার সেখানে চীন একবার ভেটো দিয়েছে। এখানে চীন ও ভারত তাদের ভূ-রাজনৈতিক কারণে নানারকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। আমরা তাদের বলতে চাই আপনার আপনাদের নিজস্ব স্বার্থ নিয়ে থাকেন। কিন্তু রোহিঙ্গাদের তাদের নিজের জায়গায় যেতে হবেই। আমাদের উপরে এই বোঝা যেন দীর্ঘদিন চাপিয়ে দেয়া যাবে না। যদি এমনটি হয় তবে আমি জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের বলা সেই কথাটি বলবো। জাতিসংঘের এক অধিবেশনে কফি আনান বলেছিলেন- যদি রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ ভূমিতে ফেরত পাঠানো না হয়, তবে একদিন তারা পুরো দক্ষিণ এশিয়াকে অস্থির করে তুলবে এবং এর জন্য শুধু বাংলাদেশ একা ভোগ করবে না। বরং পুরো এশিয়ার মধ্যে সবগুলো দেশই এদের দ্বারা আক্রান্ত হবে। তাই এটি যদি পার্শ্ববর্তী দেশগুলো বুঝতে বিলম্ব করলে সবাইকে এর মাশুল গুনতে হবে।’

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট