চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

‘জুয়া ছাড়া ক্লাব চলে না’ কথাটি ভাওতাবাজি

ক্রীড়া সংগঠক দিদারুল আলম চৌধুরী

নিজস্ব প্রতিবেদক

২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১:২৭ পূর্বাহ্ণ

খেলা যদি মানুষের স্বার্থে হয়ে থাকে তাহলে এখানে ক্লাব নামক দানবের দ্বারা হাজারো মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হতো না। আগে কিশোর-যুবকরা খেলায় মগ্ন থাকতো বলেই চুরি, ছিনতাইয়ের পথে পা বাড়াত না। বর্তমানে ক্লাবসমূহ জুয়াড়িদের আস্তানায় পরিণত হয়েছে। সেখানে খেলোয়াড়দের অবস্থান করার পরিবেশ না থাকায় কিশোর-যুবকরা বিপথে পা বাড়াচ্ছে। চট্টগ্রাম আবাহনী ক্লাবের উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক দিদারুল আলম চৌধুরী পূর্বকোণকে একান্ত সাক্ষাতকারে একথা বলেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা যখন ক্লাব চালিয়েছি তখন ক্লাব ঘরও ছিল না। ‘জুয়া ছাড়া ক্লাব চলে না।’ এ-কথাটি ভাওতাবাজি ছাড়া আর কিছুই না। ৮০’র দশকে খেলা দেখার জন্য মাঠে লোকে লোকারণ্য ছিল। হাজারো মানুষ খেলা দেখার জন্য মাঠে উপস্থিত হতেন। তিন-চার ঘণ্টা মানুষ খেলা দেখা এবং খেলার মধ্যে ব্যস্ত থাকতো। আজ সেই সময়টা জুয়ায় কাটাচ্ছে।

বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বর্তমানে একটি খেলায় ২০০ থেকে ২৫০ এর বেশি দর্শক হয় না। আর মাঠে থাকে দুই দলের ২২ জন এবং রেফারি ও লাইন্সম্যান মিলে মোট ২৫ জন। আড়াইশ’ দর্শকের মধ্যে আবার অনেকেই ক্লাবের কর্মকর্তা-কর্মচারী। আড়াইশ’ মানুষকে বিনোদন দেয়ার জন্য ক্লাব নামের একটি দানব চালানো হচ্ছে। দানব বলছি এই কারণে, ক্লাবে জুয়া খেলে হাজারো পরিবার নিঃস্ব হচ্ছে। অনেক সংসার ভেঙে যাচ্ছে। অনেক যুবকের ভবিষ্যৎ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। অনেক ব্যবসায়ী সর্বস্বান্ত হয়ে ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ঋণখেলাপি হয়ে পড়ছে। সন্তানদের বিয়ে শাদী দিতে অক্ষম হয়ে পড়ছে। ক্লাবগুলি মানুষকে ধ্বংস করার যন্ত্রে পরিণত হয়েছে।

আবাহনী ক্লাবকে নিজের প্রাণের সংগঠন উল্লেখ করে বলেন, এই ক্লাবের মান মর্যাদার বিষয়ে তিনি সবসময় দিয়েছেন। ক্লাবের দুঃসময়ে সবসময় এগিয়ে এসেছেন।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বর্তমানে কৌশলে একজন মহাসচিব হয়ে গেছেন। ক্লাবকে লিমিটেড কোম্পানি করেছেন। প্রথম দিকেই সেই কনসেপ্টে আমি বিরোধিতা করেছিলাম। কারণ আমার ধারণা ছিল কোম্পানি করে বাণিজ্য করবে। খেলাধূলার মধ্যে ক্লাবের কর্মকা- সীমাবদ্ধ থাকবে না। যে শঙ্কা প্রকাশ করেছিলাম তাই সত্য হয়েছে। ক্লাবকে লিমিটেড কোম্পানি করার পর প্রথমে কিছু মানুষের কাছ থেকে আড়াই লাখ টাকা করে চাঁদা তুলেছেন বর্তমান মহাসচিব। তিনি এবং তার বডিগার্ড সিগনেটরি হয়ে টাকাগুলি আত্মসাত করেছেন। তার অফিসের পাশেই একটি প্রাইভেট ব্যাংকে একাউন্ট খুলে টাকা তুলে নেন। নুরুল ইসলাম বিএসসি সেটা জানার পর তিনি হিসাব চান। পরে তিনি রাগারাগি করে ক্লাব ছেড়ে চলে যান। ল-ন কেলেংকারির পর যেখানে তার শাস্তি হওয়ার কথা সেখানে তিনি আরো জেঁকে বসেন। অতীত এবং বর্তমানে ক্লাবের পার্থক্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তখন মাঠ ছিল। লীগের তিন-চার মাস অনুশীলন শুরু হয়ে যেত। শহরের বিভিন্ন মাঠে খেলোয়াড়রা অনুশীলন করতো। আবহানী ক্লাবকে সরকার মাঠের জন্য যে জায়গাটি দিয়েছে। সেখানে ক্লাবে একটি নিজস্ব মাঠ করার সুযোগ ছিল। কিন্তু তা না করে সেখানে একটি শেড করে জুয়ার বোর্ড বসানো হয়েছে। অথচ এই জায়গাটিকে মাঠ বানিয়ে শিশু, কিশোরদের খেলোয়াড় হিসেবে গড়ে তোলার সুযোগ ছিল। অতীতে তাই হত। মাঠ ভাড়া দিয়ে টাকা আয় করছে। জুয়ার বোর্ড বসিয়ে টাকা আয় করছে। খেলার চেয়ে জুয়ার প্রতি আগ্রহ বেশি।

আর্থিক অনিয়মের কথা তুলে ধরে বলেন, ২০০৭ সালের কথা। মেয়ের বিয়ের কার্ড নিয়ে রফিকুল আনোয়ারের কাছে গিয়েছিলাম। তখন তিনি আমাকে ক্লাবের দায়িত্ব নেয়ার অনুরোধ জানান। তিনি আমাকে ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যান করে দেন। বাফুফে’র গাইড লাইন অনুযায়ী তখন একটি ব্যাংক একাউন্ট খুলতে হয়। প্রিমিয়ার ব্যাংকে একটি একাউন্ট খুলি। নিয়ম অনুযায়ী ক্লাবের চেয়ারম্যান, মহাসচিব এবং আমার স্বাক্ষরে চেকের টাকা উত্তোলন হতো। কিছুদিন পর দেখি আমার কাছ থেকে স্বাক্ষর নেয় না। আরো কিছুদিন খবর নিয়ে জানলাম প্রায় ৩৫ লাখ টাকা একাউন্টে আছে। আমি সিগনেটরি থাকা সত্ত্বেও আমার স্বাক্ষর না নেয়ায় আমি ব্যাংকে গিয়ে খবর নিয়ে জানতে পারি চেক দিয়ে টাকা তোলা হয়। সেখানে একটি রেজ্যুলেশন দেয়া হয়েছে, দিদারুল আলম চৌধুরী ব্যস্ত থাকায় দুইজনের স্বাক্ষরে চেক অনুমোদন হবে। বিষয়টি আমাকে জানানো হয়নি। তাদের বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমাকে সিগনেটরি করা হয়েছিল। বোর্ডের সিদ্ধান্ত ছাড়াই আমাকে বাদ দেয়া হয়েছে। তাই ব্যাংকে অভিযোগ করে আমি একাউন্টটি বন্ধ করে দিই। এই ঘটনায় ক্ষুদ্ধ হয়ে হুইপের পুত্র অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেছে। মারধরের হুমকি দিয়েছে। সবকিছু মোবাইলে রেকর্ড আছে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ক্লাব হল জনকল্যাণের জন্য। মানুষের উপকারের জন্য। কিন্তু এখানে জনকল্যাণের সাইনবোর্ড লাগিয়ে অকল্যাণ করা হচ্ছে। গণমাধ্যমকে তিনি বলেছেন, ‘আমাকে নাকি বহিষ্কার করেছে। তাহলে আমার নামে এখনো কেন একাউন্ট চলমান আছে।’ যোগ করেন দিদার।
চট্টগ্রাম আবাহনী ক্লাব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সুস্থ বিনোদনের লক্ষ্য নিয়ে ক্লাব চালিয়েছিলাম। একটা মানুষের কত টাকা দরকার। এসমস্ত মানুষকে চিহ্নিত করে খেলাধূলা থেকে তাদের আজীবন নিষিদ্ধ এবং আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।

ক্লাবগুলি বাজে অবস্থার কারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তখন যাদের রক্তের মাঝে খেলাধূলা ছিল তারাই ছিলেন ক্রীড়া সংগঠক। এখন ব্যবসায়ী এবং বাটপারদের হাতে চলে যাচ্ছে বলেই আজকের এই দশা।

আবাহনী ক্লাবের সাথে শেখ হাসিনার ইজ্জত জড়িত। এই ক্লাবের মান-সম্মান রক্ষা করা ক্লাবের দায়িত্বপ্রাপ্তদের দায়িত্ব। তার লাজ-লজ্জা থাকলে কখনোই জুয়ার পক্ষে সাফাই গাইতে পারতো না।
আবাহনীকে সরকার যে জায়গাটি বরাদ্দ দিয়েছে সেটিও এখন ক্লাবে নামে নেই বলে তিনি শুনেছেন দাবি করে বলেন, এই ধরনের ঘটনা ঘটে থাকলে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট