চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

একান্ত আলাপে কানাডা প্রবাসী রিয়াজ

বিতর্ক থেকে স্বপ্নকে নিয়ে যেতে চাই জাতিসংঘ পর্যন্ত

তাসফিয়া ফারিহা

১ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ২:৫৯ পূর্বাহ্ণ

ভাল বিতার্কিক হতে হলে
প্র্যাকটিসের বিকল্প নেই

ক্লাস সেভেনে যখন পড়ি তখন থেকেই চাইতাম মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলবো, সবার এটেনশন থাকবে আমার দিকেই। কিন্তু সেটা বাস্তবে রূপ দিতে সক্ষম হই যখন ক্লাস নাইনে বিতর্ক ক্লাবে যোগ দিই। দেশ-বিদেশের নানান রকমের বিতর্ক প্রতিযোগিতা দেখে মনে মনে ভাবতাম আমিও একদিন অনেক বড় একজন বিতার্কিক হব। সেই থেকেই শুরু। এরিমধ্যে ১৪০টিরও বেশি বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। সম্প্রতি কানাডার আন্তঃস্কুল প্রতিযোগিতায় জাতীয় পর্যায়ে তৃতীয় হতে পেরে খুব ভাল লাগছে আমার। এভাবেই বিতার্কিক হওয়ার স্বপ্ন ও এগিয়ে যাওয়ার গল্প প্রায় এক নিঃশ্বাসে বলে গেলেন কানাডাপ্রবাসী চট্টগ্রামের ছেলে রিয়াজ মাহমুদ চৌধুরী। কানাডার হ্যামিল্টনের ম্যাগমাস্টার ইউনিভার্সিটির লাইফ সায়েন্সের ছাত্র রিয়াজ রাউজান পৌরসভার ঢেউয়া হাজীপাড়ার হাজিবাড়ির সন্তান। বৃহস্পতিবার দৈনিক পূর্বকোণ কার্যালয়ের স্টুডিওতে একান্ত আড্ডায় তিনি বলেন, তার ভবিষ্যত স্বপ্ন জাতিসংঘে কাজ করা। তাদের হয়ে বাংলাদেশের জন্য কাজ করতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করবেন। আড্ডায় তার সঙ্গে আলোচনার উল্লেখযোগ্য অংশ প্রশ্নোত্তর আকারে নিচে দেয়া হলো।
পূর্বকোণ : বিতার্কিক হবার পেছনে কার কার অনুপ্রেরণা ছিল?
রিয়াজ : সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা ছিল স্কুলের সিনিয়ররা, যারা পাবলিক স্পিকিংয়ে খুব ভাল। তাদের দেখেই মূলত বিতার্কিক হবার স্বপ্নটা মনে মনে লালন করেছিলাম।
পূর্বকোণ : পরিবার কতটা সহায়তা করেছে এক্ষেত্রে?
রিয়াজ : সত্যি বলতে প্রথম দিকে বাবা-মা অতটা সাপোর্ট না দিলেও তারা যখন বিতর্কের প্রতি আমার ভালোবাসাটা বুঝতে পারে তখন যথেষ্ট সাহায্য করেন। একজন বিতার্কিক হয়ে ওঠার জন্য আমাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। সময়ও লেগেছে কয়েক বছর। সে সময়টায় বাবা-মাকে পাশে পেয়েছি।
পূর্বকোণ : ভালো বিতার্কিক হতে কী কী গুণাবলী থাকতে হয়?
রিয়াজ : সবার আগে থাকতে হবে শার্প মাইন্ড। সে সাথে জানতে হবে কীভাবে নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা যায়। একজন ভাল বিতার্কিক হতে হলে নিয়মিত বিতর্ক অনুশীলনের কোনো বিকল্প নেই।
পূর্বকোণ : সম্প্রতি কানাডার একটি জাতীয় প্রতিযোগিতায় আপনার দল তৃতীয় হয়েছে। সে সম্পর্কে কিছু বলুন।
রিয়াজ : আসলে এই অবস্থানে আসতে আমাকে এবং আমার দলকে বেশকিছু ধাপ পার করতে হয়েছে। তার জন্য দীর্ঘ চার বছর প্র্যাকটিস করেছি। এরপরেই জাতীয় পর্যায়ে বিতর্ক করার সুযোগ পাই। এছাড়াও আমি বেশ কিছু ইউনিভার্সিটির বিতর্ক প্রতিযোগিতায়ও অংশগ্রহণ করেছি। তবে বিভিন্ন ধরনের টুর্নামেন্টে গিয়েই আমি নিজেকে জাতীয় পর্যায়ে বিতর্ক করার জন্য প্রস্তুত করে তুলি।
পূর্বকোণ : কানাডায় যেসব বাংলাদেশি রয়েছেন তাদের অনুভূতিটা কেমন হয় যখন তারা নিজের দেশের কাউকে এভাবে সফলতা লাভ করতে দেখে?
রিয়াজ : অবশ্যই তাদের অনুভূতিটা খুব ভালো হয় যখন তারা দেখে বাংলাদেশি কেউ কানাডার জাতীয় পর্যায়ে গিয়ে নিজের দেশকে রিপ্রেজেন্ট করছে। এমনকি আমার নিজেরও খুব ভালো লাগে যখন দেখি আমার দেশের কেউ কোনো কাজে সফলতা লাভ করছে। এটা অবশ্যই খুব গর্বের বিষয়।
পূর্বকোণ : বাংলাদেশের যেসব বিতার্কিক আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গিয়ে বিতর্ক করতে চান তারা কীভাবে নিজেকে প্রস্তুত করবে?
রিয়াজ : কোনো বিষয়ে সফল হতে চাইলে টাকার দরকার নেই। যদি আপনার ভালো কিছু করার লক্ষ্য থাকে এবং যদি আপনি পরিশ্রমী হন, তাহলে যেকোন কিছুই করা সম্ভব। আমি এবং আমার বন্ধু কোনো উইকেন্ডেই ঘরে বসে থাকিনি। আমরা নানান ধরনের প্র্যাকটিসের মাধ্যমে নিজেদের দক্ষতা বাড়িয়েছি। তাই আমি বলতে চাই, নিজেকে প্রস্তুত করতে গেলে পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই। সেই সাথে ইচ্ছাশক্তি থাকাটাও খুব দরকার।
পূর্বকোণ : বিতর্কে ফ্রেমিংয়ের বা কাঠামোর একটা ব্যাপার থাকে। সেটা কীভাবে সাজান?
রিয়াজ : একটি বিতর্ক প্রতিযোগিতায় নির্ধারিত সময় বেঁধে দেয়া থাকে। সে নির্দিষ্ট সময় মনে করুন ১৫ মিনিট। এই ১৫ মিনিটেই আপনাকে বিষয়বস্তু অনুসারে স্ক্রিপ্ট সাজাতে হবে। তখন একজন বিতার্কিককে শান্ত এবং ধীরস্থিরভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এত অল্প সময়ে কীভাবে সব প্রস্তুত করবেন বা কীভাবে বক্তব্য রাখবেন তা ভেবে ঘাবড়ে গেলে চলবে না।
পূর্বকোণ : একজন ভালো বিতার্কিক হতে গেলে একজন ভালো শ্রোতাও হতে হয়-কথাটি কতখানি ঠিক?
রিয়াজ : কথাটি সম্পূর্ণ সত্যি । প্রতিপক্ষের বক্তব্য খুব ভালোভাবে না শুনলে তার পাল্টা জবাব তৈরি করা যাবে না। তাই ভালো শ্রোতা হবার কোনো বিকল্প নেই। আরেকটা ব্যাপার আমি বলতে চাই তা হলো, বিতর্ক প্রতিযোগিতায় নোট লিখে রাখাটা খুব জরুরি। যে যত ভালো নোট লিখবে সে তত ভালো বিতার্কিক হয়ে উঠবে।
পূর্বকোণ : সুন্দরভাবে নিজেকে উপস্থাপন করাটা কতটা জরুরি? অনেকের কছে লজিক থাকলেও ভালোভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে পারে না । সেক্ষেত্রে তাদের করণীয় কী?
রিয়াজ : এক্ষেত্রে আমি বলবো প্র্যাকটিসের বিকল্প নেই। বাবা-মা-বন্ধু সবার সামনে কথা বলার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। স্কুল-কলেজেও নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করার নানান সুযোগ তৈরি করে দেয়। উপস্থাপনে ভালো না হলে পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো লজিকটা থাকলেও মানুষ সেটা বুঝতে পারবে না ।
পূর্বকোণ : যদি বিতার্কিক না হতেন ,তাহলে কী হতেন?
রিয়াজ : বিতার্কিক না হলে আমি হয়ত আমার দ্বিতীয় শখ সাঁতারটাই বেছে নিতাম। কানাডায় আমি আমার কলেজের সুইমিং টিমে চার বছর মেম্বার ছিলাম। প্রতিদিন ছয় ঘণ্টা করে সেখানে প্র্যাকটিস করতাম।
পূর্বকোণ : বিতর্কের কারণে পড়াশোনায় কী কোনো ক্ষতি হচ্ছে? কীভাবে সামলান দুটো একসাথে?
রিয়াজ : এখানে যে ব্যাপারটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো ব্যালেন্সিং। আসলে বাবা- মা এ ব্যপারে খুব সাহায্য করেন, বাবা আমাকে ফিজিক্স পড়ান, আমাকে ডিসিশন নিতেও সাহায্য করেন সেই সাথে টিচাররাও। কোনো টুর্নামেন্ট থাকলে টিচারদের আগেই জানিয়ে রাখি। তারাও আমাকে যথেষ্ট সহযোগিতা করেন। এমনকি আমাকে এক্সট্রা সময়ও দিয়েছেন এসাইনমেন্টের জন্য।
পূর্বকোণ : চট্টগ্রামের যেসব ছেলেমেয়ে বিতার্কিক হতে চায় তাদের জন্য কি কিছু বলার আছে?
রিয়াজ : বিতর্ক এমন একটা বিষয় যা থেকে অনেক কিছুই শেখা যায়। চট্টগ্রামের যারা ভালো বিতার্কিক হতে চান তাদের ইচ্ছাশক্তিটা যেন খুব বেশি থাকে। বিতর্কে আগ্রহ থাকলে সেটার পেছনে সময় দিলে অবশ্যই ভালো কিছু হবে।
ছেলের কথা মনযোগ দিয়ে শুনছিলেন বাবা হাছান তারিক চৌধুরী। ছেলের কথার সূত্র ধরেই তিনি বললেন তার বিতার্কিক ছেলের সাফল্যের কথা।
আমার বাড়ি রাউজান পৌরসভার ঢেউয়া হাজীপাড়ার হাজিবাড়িতে। আমি একসময় চিটাগাং গ্রামার স্কুলের সায়েন্সের সিনিয়র টিচার ছিলাম। ২০০৬ সালে আমি আমার পরিবারসহ কানাডায় চলে যাই। রিয়াজ তখন কিন্ডারগার্টেনের ছাত্র। বর্তমানে আমি অন্টারিওতে ম্যাথ আর ফিজিক্সের টিচার হিসেবে কর্মরত আছি। রিয়াজের মাথায় সবসময় একটা ব্যাপার থাকে। সেটি হচ্ছে লিডারশিপ। গ্রেড সেভেনে উঠে আমার ছেলে ডিবেট ক্লাবের সাথে জড়িয়ে পড়ে। এরপরের চার বছর সে নিজেকে প্রস্তুত করে জাতীয় পর্যায়ের জন্য। এরপর সে আন্তঃস্কুল বিতর্ক প্রতিযোগিতায় সমগ্র কানাডাতে তৃতীয় হয়।
পূর্বকোণ : বাংলাদেশে বিতর্ক নিয়ে কাজ করার কোনো পরিকল্পনা আছে?
রিয়াজ : অবশ্যই পরিকল্পনা আছে। ভবিষ্যতে যেহেতু ইউনাইটেড নেশনে কাজ করার ইচ্ছে আছে, তাই তাদের সাথে বাংলাদেশে এসে কোনো প্রজেক্ট করার খুব ইচ্ছে আমার।
পূর্বকোণ : বাংলাদেশের বিতার্কিকরা আপনার কাছে কোনো সাহায্য চাইলে যোগাযোগ করবে কীভাবে?
রিয়াজ : বাংলাদেশের বিতার্কিকদের বিতর্কের ব্যাপারে যেকোন সাহায্য করতে চাই আমি। এক্ষেত্রে তারা আমাকে সোশ্যাল মিডিয়াতে নক দিতে পারে। আমার ইন্সটাগ্রাম আইডি রঃং.ৎরধুসধযসঁফ।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট