চট্টগ্রাম বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

দৈনিক পূর্বকোণকে একান্ত সাক্ষাৎকারে মুনীর চৌধুরী

জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের মাধ্যমে ক্ষুদে বিজ্ঞানী সৃষ্টি করা হবে

মোহাম্মদ আলী

৪ মে, ২০১৯ | ২:১৭ অপরাহ্ণ

জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী বলেন, ‘জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের কর্মকা- সীমাবদ্ধ না রেখে, এর কর্মপরিধি বাড়িয়ে নবীন ও ক্ষুদে বিজ্ঞানী সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়া হবে। যাতে ক্ষুদে বিজ্ঞানীরা নতুন নতুন এ্যাপস ও ডিভাইস তৈরি করতে পারবে যা দিয়ে সরকারি দপ্তর ও সেবা খাতে বিভিন্ন সমস্যা মোকাবেলা করা সম্ভব হবে। কাগজ দিয়ে, ফাইল নথিপত্র দিয়ে মানুষের যে হয়রানি হয় নতুন নতুন উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে সেটা হ্রাস করা যাবে। গত বৃহস্পতিবার দৈনিক পূর্বকোণকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি একথা বলেন।
জীবনভর দুর্নীতি ও অপরাধবিরোধী অভিযানে বাংলাদেশের পরিবেশ, ভূমি, বন্দর, নৌ, খাদ্য এবং বিদ্যুৎসহ বহু সেক্টরের চিত্র বদলে ফেলা প্রশাসনের নির্ভীক ব্যক্তিত্ব মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী। ম্যাজিস্ট্রেসিকে যিনি তুলেছেন অনন্য উচ্চতায় এবং অগনিত মানুষকে মুক্ত করেছেন দুর্নীতি ও হয়রানির শেকল থেকে। তাদের মুখে হাসি ফুটিয়েছেন তিনি। প্রশাসনের এ কর্মঠ ব্যক্তি মাসখানেক আগে বদলি হন জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরে।
তিনি বলেন, ‘খাদ্যে ভেজালের অপরাধ, বিশাল বিশাল ফ্যাক্টরিতে বিদ্যুৎ চুরি, গ্যাস চুরি কিংবা পানি চুরি সহজে ধরা সম্ভব নয়, তা সেন্সরিং ডিভাইস দিয়ে চিহ্নিত করা হবে। আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ল্যাব টেস্ট রিপোর্ট পাঠিয়ে ফল পাওয়ার যে দীর্ঘসূত্রিতা, তাতে দুর্নীতি করার যে ব্যাপক সুযোগ তা প্রযুক্তি ব্যবহারে কমে আসবে। তাৎক্ষণিক ফল পাওয়া যাবে খাদ্যে ভেজাল কিনা, ওষুধ মানসম্মত কিনা, ওষুধের কাঁচামাল ভাল কিনা। এরজন্য প্রয়োজন সব থেকে আধুনিক বিজ্ঞান, আধুনিক কলাকৌশল। সরকারি একটা ডিপার্টমেন্ট বা এজেন্সি দিয়ে খাদ্যমান বা ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না। এর জন্য প্রয়োজন ডিজিটাল ডিভাইস।’
প্রসঙ্গত, মুনীর চৌধুরী দায়িত্ব পালনে থাকেন অবিচল ও অনঢ়। কোনো চাপ, প্রলোভন ও হুমকি তাঁর অবস্থান থেকে টলাতে পারেনি। সময়ের সাথে মানুষ বদলে যায়, আমলাদের কেউ কেউ বদলে যান। বৈষয়িকতার কাছে আত্মসমর্পণ করেন। পদ, পদবি বা চেয়ার রক্ষার জন্য আপস করে বসেন। কিন্তু এসবের সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী। সাদামাটা এই মানুষটি অসম্ভব স্বাধীনচেতা, প্রতিবাদী ও কর্মচঞ্চল।
হাটহাজারীতে রেলের ব্রিজ ভেঙে তেল ভর্তি ওয়াগন পড়ে সৃষ্ট দূষণ প্রসঙ্গে মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী বলেন, ওয়াগনের তেল ছড়িয়ে যে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে তা হালদা নদীর জন্য বড় বিপদ ডেকে আনার আশঙ্কা ছিল। যদিও প্রশাসনের তাৎক্ষণিক পদক্ষেপে হুমকি কিছুটা হলেও এড়ানো গেছে বলে মনে করি। তবে এ ধরনের বিপদসমূহের আশঙ্কায় আগে থেকে পরিবেশ ও মৎস্য অধিপ্তদরসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর প্রস্তুতি থাকা দরকার ছিল। এ ক্ষেত্রে ফিল্টার, ওয়েল ক্লিনার, চাকার ইত্যাদি মজুদ রাখা উচিত।
তিনি বলেন, যে ওয়াগনটা পড়ে গেছে তা তো এয়ার টাইট থাকার কথা ছিল। কিন্তু তা কেন ম্যানহোলের ঢাকনার মতো খোলা থাকবে ? ওয়াগনগুলো ডাবল হাল থাকবে, এয়ার টাইট সফিস্টিকেশন থাকবে যেনো পরে গেলেও তেল না বের হয়। এটিই হলো উন্নতি, উন্নত প্রযুক্তি। অথচ সেই সনাতন পদ্ধতিতে রেল ওয়াগন চলছে, যেখানে হঠাৎ করে ঢাকনা খুলে যে কোন বড় দুর্ঘটনায় সব তেল পড়ে যায়। ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন হলো তেল ওয়াগনগুলোকে ডাবল হাল করা। তাহলে যে কোন দুর্ঘটনায় পরে গেলে, ডুবে গেলে, সংঘর্ষ হলে তা ফেটে যাবে না, ভেতরেই তেল সুরক্ষিত থেকে যাবে। এটা যেমন রেলের ব্যর্থতা, তেমনি মৎস্য ও পরিবেশ অধিদপ্তরের উচিত এমন কিছু বিকল্প ব্যবস্থা রাখা। যাতে ফোম দিয়ে, ক্লিনার দিয়ে তেলগুলোকে তাৎক্ষণিক শুষে ফেলা যায়। বে ক্লিনার ছাড়া তেল দূষণ বন্ধ করতে পারবেন না। চট্টগ্রাম বন্দরে বে ক্লিনার জাহাজ আছে। বন্দরকে বলে এটি এ ধরনের সমস্যায় ব্যবহার করা দরকার। তাহলে নদীর পানি দূষণ থেকে রক্ষা পাবে।’
নতুন প্রজন্মেকে মোবাইল আসক্তি ও অশ্লীলতা থেকে বাঁচাতে বিজ্ঞানের দিকে তাদের আকর্ষণ বাড়ানোর কথা উল্লেখ তিনি বলেন, বিজ্ঞান মেলা এবং নতুন নতুন উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে এ তরুণরা এগিয়ে নিবে দেশকে। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো বিজ্ঞানের উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদেরও বিজ্ঞান ও সততা দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। মুখস্থ বিদ্যায় কখনো সফলতা আসে না। গবেষণা করতে হবে। সৃষ্টির প্রতি আকর্ষণ বাড়াতে হবে।’
মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী বলেন, নতুন প্রজন্মকে ইয়াবা, মাদক, ধূমপান, মোবাইল আসক্তি থেকে বাঁচাতে, অনৈতিক আড্ডা যেখানে তারা অশ্লীলতার মধ্যে ডুবে যাচ্ছে। তাদের বাঁচাতে বিজ্ঞানের জগতে ফিরিয়ে আনতে বিজ্ঞান মেলা ও বিজ্ঞান ক্লাব আয়োজন করা। এছাড়াও সেমিনারের আয়োজন করা, ল্যাব দেওয়া, আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া, পুরস্কার দেওয়ার ব্যবস্থা করলে ওরা এগিয়ে আসবে। এটা দিয়ে ভারতের বিজ্ঞানীরা পুরো বিশ্বে নেতৃত্ব দিচ্ছে। তাই জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরে উদ্যোগে প্রতিটি জেলায় সায়েন্স হাব, সায়েন্স সিটি গড়ে তোলা এবং নবীণ ও প্রবীণ বিজ্ঞানীদের ডোমিনেট করা হবে। বর্তমান প্রজন্ম সীমাবদ্ধ জীবনযাপন করছে। তাতে ওরা স্থূল হয়ে যাচ্ছে। ওরা নদীতে যাচ্ছে না, গ্রাম ও বায়ু দূষণ দেখছে না। এমন কি মাটি দূষণ দেখছে না। তাই আমি চাই ওরা মাঠে যাক, কাছ থেকে সমস্যাগুলো দেখুক। তাতে সামাজিক একটি বিপ্লব সৃষ্টি হবে।’
প্লাস্টিকের মারাত্মক দূষণ হচ্ছে উল্লেখ করে মুনীর চৌধুরী বলে, ‘প্লাস্টিক দূষণের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম থেকে কার্যক্রম শুরু করতে চাই। প্রত্যেক স্কুলের অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের যেন প্লাস্টিকের বোতলে পানি না দেয়। একটু বেশি খরচ হলেও যাতে কাচের বোতলে পানি দেয়। প্লাস্টিকের বোতলে দূষণ হচ্ছে। প্লাস্টিকের বোতল স্বাস্থ্য সম্মত না। যে উপাদান ও নি¤œমানের প্লাস্টিক দিয়ে প্লাস্টিকের বোতল তৈরি হচ্ছে, সেই বোতলে খাবার পানি নিরাপদ না। বোতলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পানি থাকছে। বোতল গরম হচ্ছে। তাতে রাসায়নিক বিক্রিয়া হচ্ছে। এটাতে তাদের রোগ ব্যাধি হচ্ছে। এমন কি ছাত্রদের ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা থাকছে। একটা পর্যায়ে ছাত্রদের মেধা ও সৃজনশীলতা নষ্ট করে দিবে। বর্তমানে বিশ্বে প্লাস্টিকের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে। কাজেই প্লাস্টিকের বোতল যেন তারা পরিহার করে। বিকল্প হিসেবে কাচের বোতল ব্যবহার করে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট