চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

তিন কারণে এবার হালদায় প্রত্যাশিত ডিম মেলেনি

মন্তব্য প্রতিবেদন

প্রফেসর ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া প্রফেসর, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ ও সমন্বয়ক, হালদা নদী গবেষণা ল্যাবরেটরি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

২৮ মে, ২০১৯ | ২:৪১ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামের গর্ব হালদা কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণে বাংলাদেশের অদ্বিতীয় নদী। এটি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ রুই জাতীয় মাছের (রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালিগনি) প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র। এ নদী থেকে সরাসরি রুই জাতীয় মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়। যুগ যুগ ধরে স্থানীয় অধিবাসীরা বংশ পরম্পরায় রুই জাতীয় মাছের ডিম সংগ্রহ করে নিজস্ব পদ্ধতিতে রেণু উৎপাদন করে দেশের মৎস্য খাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে।
বর্ষা মৌসুমে বিশেষ করে এপ্রিল, মে, জুন এই তিন মাসে নদীর পরিবেশগত কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্যের জন্য এখানে মা মাছ ডিম ছাড়তে আসে। এ বৈশিষ্ট্যগুলো ভৌতিক, রাসায়নিক এবং জৈবিক। আমাবস্যা বা পূর্ণিমার জো বা তিথিতে বজ্রসহ প্রচুর বৃষ্টিপাত, উজানের পাহাড়ি ঢল, তীব্র স্রোত, ফেনিল ঘোলা পানিসহ নদীর ভৌত-রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যগুলোর সমন্বিত ক্রিয়ায় হালদা নদীতে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে রুই জাতীয় মাছকে বর্ষাকালে ডিম ছাড়তে উদ্বুদ্ধ করে।
বিগত কয়েক বছরের অধিকাংশ সময় এপ্রিলের প্রথম থেকে তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে ডিম ছাড়লেও এ বছর মে মাসের শেষ পূর্ণিমার জো অতিক্রম করলে স্থানীয় ডিম সংগ্রহকারীরা অনেকটা হতাশ হয়ে পড়ে। এর অন্যতম কারণ অনুকূল পরিবেশের জন্য হালদা নদীর অববাহিকায় পর্যাপ্ত পরিমাণ বৃষ্টিপাত না হওয়া। গত ২৪ মে শুক্রবার দিনগত রাত থেকে চট্টগ্রাম অঞ্চলে ভারি বৃষ্টিপাত হলে নদীতে মা মাছ ডিম ছাড়ার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। ২৫ মে সকাল বেলা নমুনা ডিম দেখা দিলে হালদা পাড়ের ডিম সংগ্রহকারীরা পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে নদীতে অবস্থান করে জোয়ার-ভাটার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। প্রতি বছরের ন্যায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির গবেষক টিম নদীতে অবস্থান করে। সন্ধ্যা পৌনে ৬টার জোয়ারের টানে বহু প্রতীক্ষিত মাছ হালদা নদীতে ডিম ছাড়ে। সন্ধ্যা ৭-৮টার সময় নমুনা ডিমের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। রাত প্রায় ১০টা থেকে ডিম আহরণ শুরু হয়। এ সময় ডিম প্রাপ্তির পরিমাণ এত কম ছিল যে নমুনা নাকি চূড়ান্ত ডিম তা নিয়ে নিজেরাই বিভ্রান্ত হয়ে যাই। রাত সাড়ে ১১টার দিকে আমরা নিশ্চিত হই যে মা মাছ নদীতে চূড়ান্ত ডিম ছেড়ে দিয়েছে। আমরা রাত প্রায় আড়াইটার পর্যন্ত নদীতে অবস্থান করে তথ্য সংগ্রহ করি।
বিগত বছরগুলোতে মৎস্য অধিদপ্তর এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পৃথকভাবে ডিম আহরণের তথ্য সংগ্রহ করার কারণে অনেক সময় তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি এবং ডিমের পরিমাণ নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হতো। তাই এ বছর মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের গঠিত কমিটি যৌথভাবে ডিমের তথ্য সংগ্রহ করি। সরকারি কিছু নিয়ম-কানুনের কারণে যৌথ ডাটা মন্ত্রণালয়ে অনুমোদন প্রয়োজন হয়। তাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি দীর্ঘদিনের প্রচলিত নিয়ম এবং জবাবদিহিতার জায়গা থেকে ডিমের একটি সম্ভাব্য পরিমাণ প্রকাশ করে।
আমাদের নিজস্ব মেথডোলজি অনুসরণ করে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এ বছর হালদা নদী থেকে প্রায় ৭০০০ কেজি ডিম সংগৃহিত হয়েছে। গত ২০১৮ সালে প্রাপ্ত ডিমের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৬৮০ কেজি। সে তুলনায় এ বছর ডিমের পরিমাণ প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কম সংগৃহিত হয়েছে। তবে এ বছর হাটহাজারী উপজেলা প্রশাসনের কড়া নজরদারি, ব্যাপক পরিমাণ জাল উদ্ধার, বেসরকারি সংস্থা আইডিএফ-পিকেএসএফে’র বাস্তবায়নাধীন কার্যক্রমসমুহ বিশেষ করে ব্রুড মাছ পাহারা, হাটহাজারী উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে সরকারি হ্যাচারিগুলোর পুনঃসংস্কার এবং হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মাদ রুহুল আমীনের আন্তরিক প্রচেষ্টায় সফলভাবে ফার্নেস অয়েল দূষণ প্রতিরোধ ইত্যাদি কার্যক্রমের ফলে মানুষের কাছে এ বছরের ডিম প্রাপ্তির প্রত্যাশা ছিল ২০১৮ সালের চেয়ে বেশি। কিন্তু ২০১৫, ২০১৬ ও ২০১৭ সালের সাথে তুলনা করলে ২০১৯ সালের প্রাপ্ত তথ্য মোটেই হতাশাব্যঞ্জক নয়। ২০০১ সাল থেকে প্রাপ্ত ডাটা বিশ্লেষণ করলে হালদা নদীর ডিম সংগ্রহের পরিমাণের ধারাবাহিকতা কখনো ছিল না। এর জন্য মানুষ সৃষ্ট এবং প্রাকৃতিক অনেকগুলো ফ্যাক্টর দায়ী।
হালদা নদী নিয়ে এ বছর সরকারি-বেসরকারি বেশকিছু ভাল উদ্যোগ থাকলেও প্রত্যাশা অনুযায়ী ডিম না পাওয়ার অনেকগুলো কারণ রয়েছে। এর মধ্যে কিছু কারণ মানুষসৃষ্ট এবং কিছু প্রাকৃতিক।
প্রাকৃতিক কারণগুলোর মধ্যে প্রথম কারণ পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হওয়া। এপ্রিল-জুন মাসের ৬টি জো’র মধ্যে এপ্রিল-মে মাসের ৪টি জো’র শেষ হয়েছে পর্যাপ্ত বৃষ্টিবাদল ছাড়া। সাধারণত এপ্রিল থেকে মাছের ডিম পরিপক্কতা লাভ করে। মার্চ মাসে কিছু অগ্রিম বৃষ্টিপাত হওয়ার কারণে অনেক হ্যাচারিতে রুই জাতীয় মাছের মধ্যে অগ্রিম পরিপক্কতা পরিলক্ষিত হয়। সে বিবেচনায় দীর্ঘ সময় পরিপক্ষ গোনাড নিয়ে মা মাছগুলো অস্বস্তিকর অবস্থায় ছিল। এপ্রিল-মে মাসের অতিরিক্ত তাপমাত্রা এতে আরো প্রভাব ফেলে। এ অবস্থায় পূর্ণিমার জো না থাকা সত্ত্বেও ২৪ মে ভারি বৃষ্টিপাতে পাহাড়ি ঢলের প্রভাবে ২৫ মে রাতে মা মাছ ডিম ছেড়ে দেয়। যা সাধারণত অস্বাভাবিক।
দ্বিতীয় কারণ; সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী মার্চের শেষ বা এপ্রিলের প্রথম দিকে কালবৈশাখীসহ প্রথম ভারি বৃষ্টিপাতের ফলে নদীর অববাহিকার শীতকালীন সময়ের দূষিত পদার্থ এবং ময়লা আবর্জনা পানির স্রোতে দুয়ে যায়। আমাবস্যা বা পূর্ণিমার সময় দ্বিতীয় ভারি বৃষ্টিপাতের সময় মা মাছ ডিম দেয়। এ বছর গত ২৪ মে’র আগে তেমন ভারি বৃষ্টিপাত না হাওয়ায় দূষিত পদার্থসমূহ ওয়াশআউট হওয়া সম্ভব হয়নি। যার ফলে ২৪ মে ভারি বৃষ্টিপাতের ফলে প্রচুর পরিমাণ দূষিত পদার্থ হালদার পানিতে মিশে একটি অস্বাভাবিক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। হালদার প্রজনন এলাকায় প্লাস্টিক বোতলসহ প্রচুর পরিমাণ বিভিন্ন ধরনের ময়লা আবর্জনা ভাসতে দেখা যায় যা বিগত বছরগুলোতে কখনো পরিলক্ষিত হয়নি। পানির পিএইচএর মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি (৮+) বর্জ্য দূষণের ইঙ্গিত বহন করে।
তৃতীয় কারণটি মানুষসৃষ্ট। হালদায় মাছের প্রজনন এলাকা হচ্ছে অনেকটা আঁতুর ঘরের মত। জৈবিক, ভৌতিক এবং রাসায়নিক অনুকূল পরিবেশ এবং নিরাপদ আবাসস্থল মাছের স্বাভাবিক প্রজননের পূর্ব শর্ত। কিন্তু ২০১৮ সালের বছরব্যাপী এবং ২০১৯ সালের এপ্রিল পর্যন্ত হালদা নদীর প্রজনন এলাকায় তা বিরাজমান ছিল না। মানুষের ভিটে বাড়ি রক্ষায় নদীর ভাঙ্গন প্রতিরোধে বাস্তবায়নাধীন একটি প্রকল্পের নির্মাণ সামগ্রী পরিবহণে বড় আকৃতির বার্জ, বোট ও ট্রলারের প্রতিনিয়ত অস্বাভাবিক ও অনিয়ন্ত্রিত চলাচলে হালদা নদীর বাস্তুতান্ত্রিক পরিবেশ, মাছ ও ডলফিনসহ জীববৈচিত্রের উপর মারাত্মক প্রভাব পরে। এছাড়া অবৈধ বালি উত্তোলনে ড্রেজার চলাচল ছিল অনিয়ন্ত্রিত। এ কারণে আঘাতজনিত কারণে প্রায় ১৯টি ডলফিন এবং ৯টি মা মাছের মৃত্যু তার প্রমাণ বহন করে। নদীতে মাছের আদর্শ আবাস ও প্রজননস্থল, যাকে স্থানীয় ভাষায় বলে ‘কুম’। প্রজনন ক্ষেত্র এলাকার ( কেরামতলি বাঁক থেকে রামদাশ মুন্সির হাট পর্যন্ত) ৯টি কুমের মধ্যে ৭টি কুম সংলগ্ন নদীর বাঁকে ভাঙ্গণ প্রতিরোধক ব্লক বসানো, জিও বেগ ডাম্পিং করার ফলে মাছের আবাসস্থল ও প্রজনন ক্ষেত্রের পরিবেশের বিঘœতা সৃষ্টি হয়। এতে ডিমপ্রাপ্তির পরিমাণকে প্রভাবিত করে।
বেশ কয়েক বছর ধরে নদীর উজান এলাকায় তামাক চাষের ব্যাপকতা বৃদ্ধি, ১৮টি শাখা খালে স্লুইসগেট নির্মাণ, মূল নদীতে ভূজপুর রাবার ড্যাম তৈরি, শিল্প বর্জ্য, মা মাছ নিধন, হাটহাজারীর খন্দকিয়া খালের মাধ্যমে ব্যাপক দূষণ বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের নজরে আনলেও আজ অবধি তেমন কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
সার্বিকভাবে আমাবস্যা পূর্ণিমার জো’বিহীন একটি অস্বাভাবিক পরিবেশে মা মাছের ডিম ছাড়ার ফলে প্রত্যাশিত পরিমাণ ডিম সংগ্রহ সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ হিসেবে হালদা আমাদের একটি মাত্র নদী যার কোন বিকল্প নেই। সুতরাং স্থানীয়দের আন্তরিক সম্পৃক্ততা, নাগরিক সচেতনতা, সরকারি-বেসরকারি যৌথভাবে সুপরিকল্পিত এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাই একমাত্র হালদা নদীকে রক্ষা করা সম্ভব।
লেখক : প্রফেসর, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ ও সমন্বয়ক, হালদা নদী গবেষণা ল্যাবরেটরি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট