চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

দরকার বলিষ্ঠ সচেতনতা কর্মসূচি নিপাহ ভাইরাসে মৃত্যু

৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ৫:১৩ পূর্বাহ্ণ

প্রতি বছরই দেশে শীতকালে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মানুষের মৃত্যু ঘটে। সাধারণত জনঅসচেতনতার কারণেই এমন দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। এবারও কয়েকজনের মৃত্যুর খবর এসেছে গণমাধ্যমে। কোনো উপযুক্ত চিকিৎসা ও প্রতিষেধক টিকা না থাকায় এই ভাইরাসে কেউ আক্রান্ত হলে তার মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে ৮৯ শতাংশ। ফলে নিপা ভাইরাসের আক্রমণ ঠেকাতে সচেতনতা ছাড়া আপাতত আর কোনো রক্ষাকবচ মানুষের হাতে নেই। একমাত্র বলিষ্ঠ জনসচেতনতা কর্মসূচিই পারে নিপা ভাইরাসের বিস্তার ও মানবমৃত্যু ঠেকাতে।

নিপা একটি ভাইরাসজনিত মারাত্মক রোগ, যা বাদুড় থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়। আবার আক্রান্ত মানুষ থেকে মানুষেও সংক্রমিত হতে পারে। বাংলাদেশে সাধারণত ডিসেম্বর থেকে এপ্রিলের মধ্যে নিপা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এই সময়টাতেই খেজুরের রস সংগ্রহ করা হয়। আর বাদুড় গাছে বাঁধা হাড়ি থেকে রস খাওয়ার চেষ্টা করে বলে ওই রসের সঙ্গে তাদের লালা মিশে যায়। আর সেই বাদুড় নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকলে এবং সেই রস খেলে মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়তে পারে এ ভাইরাস। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে, বাদুরের পান করা খেঁজুরের কাঁচা রসে বা আংশিক আহার করার ফলে বাদুরের লালা বা মলমূত্র মিশে থাকে। বাদুরের পান করা খেঁজুরের রস পান করলে বা আংশিক আহার করা বা কামড়ানো ফল খেলে নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বাদুরের আংশিক আহার করা ফল অথবা ঘাস গরু, ছাগল, শূকর খেলে তাদের শরীরে নিপা ভাইরাস প্রবেশ করতে পারে। বাদুরের লালা মলমূত্র মিশ্রিত কাঁচা খেঁজুরের রস পানে বাংলাদেশের কোন কোন জেলায় নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। এদের মধ্যে কোন কোন অঞ্চলে নিপা সংক্রমিত রোগীর সংস্পর্শে আসা ব্যক্তি নিপা আক্রান্ত হয়েছে। সংক্রমিত রোগীর হাঁচি-কাশি-কফ-থুথু অর্থাৎ শ্বাসতন্ত্র এবং শরীরের সংক্রমিত নিঃসরণের মাধ্যমে নিপা একজন থেকে অন্যজনে সংক্রমিত হতে পারে। তবে সাবধানতা অবলম্বন করলে নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। এ জন্যে কাঁচা খেজুরের রস এবং বাদুড় খাওয়া ফলমূলের অংশ বিশেষ না খাওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়ে থাকেন বিশেষজ্ঞরা। যারা সাবধান থাকেন তারা সুস্থ থাকেন, যারা অসাবধান-অসতর্ক থাকেন তারা নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হন। এ রোগে আক্রান্তদের মস্তিষ্কে ভয়াবহ প্রদাহ দেখা দেয়। এর প্রধান লক্ষ্মণগুলো হচ্ছে- জ্বরসহ মাথাব্যথা, খিঁচুনি, প্রলাপ বকা, অজ্ঞান হওয়াসহ কোন কোন ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্ট। জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার পর রোগীরা এক পর্যায়ে সংজ্ঞা হারান এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের মৃত্যু হয়েছে।

উল্লেখ্য, বিশ্বে ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে মালয়েশিয়ায় সর্বপ্রথম নিপা ভাইরাস শনাক্ত হয়। সেই সময় ২৫৭ জন আক্রান্ত হয়ে ১০৫ জন মারা যায়। মালয়েশিয়ার কেমপুং নিপাহ শহরে এই ভাইরাস প্রথম সংক্রমিত হয়েছিলো বলেই এর নামানুসারে ভাইরাসটিকে নিপাহ ভাইরাস নামে নামাঙ্কিত করা হয়। নিপাহ ভাইরাস হেনিপাহ ভাইরাস গোত্রের। এই গোত্রের আর একটি ভাইরাস হলো ‘হেনড্রা ভাইরাস। ১৯৯৪ সালে হেনড্রা ভাইরাস অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনে সনাক্ত হয়। সেই সময় ভাইরাস সংক্রমণে ৩০টি ঘোড়া মারা যায়। এই ভাইরাস ঘোড়াকে সংক্রমিত করলেও তা মানুষকে সংক্রমিত করার নজির পাওয়া যায় নি। তবে বর্তমানে বাংলাদেশকে নিপা ভাইরাসের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বিবেচনা করা হয়। ২০০১ খ্রিস্টাব্দ থেকে এ পর্যন্ত মেহেরপুর, নওগাঁ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, ঠাকুরগাঁও, কুষ্টিয়া, মানিকগঞ্জ ও রংপুরে মানবদেহে নিপা ভাইরাস সংক্রমণের খবর পাওয়া গেছে। ২০০১ খ্রিস্টাব্দে উত্তর জনপদের সীমান্ত এলাকায় প্রথমবারের মতো নিপা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা যাওয়ার পর এ পর্যন্ত এই ভাইরাসে আক্রান্ত ১৫৪ জনের মধ্যে ১১৫ জনেরই মৃত্যু হয়েছে। নিপা ভাইরাস এতটাই সংক্রামক যে, ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে ফরিদপুরে এক পরিবারের একজন আক্রান্ত হওয়ার পর ওই পরিবারের চারজনের মৃত্যু হয়। এক রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর তার রিক্সাচালকও নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হন। ২০১২ খ্রিস্টাব্দে এ রোগে ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছিল। আর ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে দেশের পঞ্চগড়, নীলফামারী, ফরিদপুর, মাগুরা, নওগাঁ ও রাজবাড়ীতে আক্রান্ত ৯ জনের মধ্যে ৬ জনেরই মৃত্যু ঘটে। এ বছর ৩ জনের মৃত্যুর খবর এসেছে গণমাধ্যমে। মানবমৃত্যুর এ পরিসংখ্যান বলে দিচ্ছে নিপাহ ভাইরাস মানব-হন্তারক। তাই প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত সচেতনতাই এর আক্রমণ তেকে বাঁচার একমাত্র উপায়। সরকারের স্বাস্থ্যবিভাগের উচিত হবে, নিপা ভাইরাস কি, কেনো হয়, পরিণাম ও বাঁচার উপায় প্রভৃতি তথ্য বহুমাত্রিক উদ্যোগে একেবারে তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট