চট্টগ্রাম বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

কুর্দিরা আসলে কারা?

১০ অক্টোবর, ২০১৯ | ২:৩১ পূর্বাহ্ণ

মধ্যপ্রাচ্যের চার-পাঁচটি দেশের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কুর্দি জাতিগোষ্ঠীর মানুষরা। মধ্যপ্রাচ্যের চতুর্থ বৃহত্তম এই জাতিগোষ্ঠী পায়নি কোনো স্বাধীন দেশ গঠনের সুযোগ। চার-পাঁচটি জাতিরাষ্ট্রের মধ্যেই তারা গণ্য হচ্ছে সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী হিসেবে। কখনো কখনো হচ্ছে চরম নির্যাতনের শিকার।

এই কুর্দি জাতি এক ইসলামী সুন্নি গোষ্ঠী যারা আজ অবধি স্বীকৃতি পায়নি জাতি হিসেবে। আর্মেনিয়া, সিরিয়া, ইরান, ইরাক ও তুরষ্কের পার্বত্য এলাকাগুলোতে সব মিলিয়ে বর্তমানে ২.৫ থেকে ৩.৫ কোটি কুর্দি জাতিগোষ্ঠীর মানুষের বসবাস রয়েছে। কিন্তু তাদের সম্পর্কে আমরা কতখানি জানি? কি তাদের উৎপত্তির ইতিহাস?
কুর্দিরা মূলত মেসোপটেমিয়ার সমতলভূমিতে (বর্তমানে যেগুলো দক্ষিণ-পূর্ব তুরস্ক, উত্তর-পূর্ব সিরিয়া, ইরাকের উত্তরাঞ্চল, ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও আর্মেনিয়ার দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চল) বসবাসকারী এক আদিবাসী গোষ্ঠী।

বর্তমানে বেশ কয়েকটি দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও কুর্দিরা মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের আলাদা পরিচয় তৈরি করেছে নিজেদের স্বতন্ত্র ভাষা-সংস্কৃতি দিয়ে। কুর্দিদের মধ্যে বর্তমানে বেশ কয়েক ধর্মের মানুষই আছে। তবে অধিকাংশই সুন্নি মুসলমান।
২০ শতকের শুরুর দিকে, অনেক কুর্দিরা চেয়েছিল কুর্দিস্তান নামে নিজেদের এক সার্বভৌম রাষ্ট্র গড়ে তুলতে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অটোমান সা¤্রাজ্যের পতনের পর পশ্চিমা মিত্ররা কুর্দি রাষ্ট্র গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল। এই সিদ্ধান্ত হয়েছিল ‘ট্রিটি অফ সেভরাস’ নামে পরিচিত এক চুক্তির দ্বারা।

কিন্তু এর তিন বছরের মাথায়ই সেই স্বপ্নে জল ঢেলে দেওয়া হয়েছিল। লাওসেন চুক্তির দ্বারা যখন তুরস্কের সীমানা নির্ধারন করা হয়েছিল, তখন কুর্দি রাষ্ট্রের জন্য কোন ব্যবস্থা রাখা হলো না। সমগ্র কুর্দি জাতি বিভাজিত অবস্থায় বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী হিসেবে রয়ে গেল। আর তারপরে ৮০ বছর ধরে তারা কোন ধরনের স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের পায়তারা করলে তা নির্মমভাবে দমিয়ে দেওয়া হয়েছে।
২০১৩ সালের মাঝামাঝি উত্তর সিরিয়ায় নিজেদের দখলে থাকা এলাকার মধ্যে থাকা তিনটি কুর্দি ছিটমহলের দিকে চোখ পড়ে জিহাদী সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) এর। কিন্তু ক্রমাগত আক্রমণের মাধ্যমে আইএস-কে সেখান থেকে বিতাড়িত করতে সক্ষম হয় সিরিয়ান কুর্দিশ ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন পার্টি। ২০১৪ সালের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে আইএস ঐ স্থান ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।

২০১৪ সালের জুন মাসে ইরাকের উত্তরাঞ্চলে আইএস-এর এক অভিযানকালেও তাদেরে প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়িয়ে যায় কুর্দি বাহিনী। ইরাকের স্বশাসিত কুর্দিস্তান প্রদেশের সরকার তাদের ‘পেশমের্গা’ বাহিনীর সদস্যদের বিভিন্ন স্থানে মোতায়েন করে দিয়েছিল তখন। সেসব এলাকায় ইরাকি সেনারা থাকলেও তারা কুর্দিস্থান প্রদেশ ছেড়ে চলে যায়।
ঐ বছরের আগস্ট মাসে জিহাদীদের কিছু আচমকা আক্রমণে পেশমের্গা সেনারা কয়েকটি এলাকা থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়। সে ঘটনায় ধর্মীয় ক্ষুদ্র গোষ্ঠীদের দখলে থাকা অনেক ছোট শহরের দখল চলে যায় আইএস-এর হাতে। এর মধ্যে উল্লেখ্য সিনজার নামের এলাকাটি। আইএস সেনারা সেখানকার প্রচুর মানুষকে হত্যা করেছিলো অথবা বন্দি করে রেখেছিলো নিজেদের কাছে।

এর জবাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে কয়েকটি দেশের সম্মিলিত এক বিমান হামলার ঘটনা ঘটে ইরাকের উত্তরাঞ্চলে। তারা পেসমের্গাদের সহায়তায় প্রচুর সেনা উপদেষ্টাও পাঠায়। তাদের সাহায্যার্থে আরো এগিয়ে আসে পিপলস প্রোটেকশন ইউনিট এবং কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি।

২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলের কুর্দি শহর কোবেন-এ এক আক্রমণের মাধ্যমে আইএস প্রচুর মানুষকে নিকটস্থ তুরস্ক সীমান্ত দিয়ে পালাতে বাধ্য করে। যুদ্ধ অতি নিকটে থাকা সত্ত্বেও তুরস্ক আইএস-কে আক্রমণ করেনি এবং তাদের দেশে থাকা কুর্দিদের সেই এলাকা রক্ষার্থে যাবার অনুমতিও দেয়নি।
২০১৫ সালের জানুয়ারিতে এক যুদ্ধে ১,৬০০ মানুষের প্রাণ এবং ৩,২০০ টি ভবন ধ্বসের মূল্যে কুর্দিরা পুনরায় কোবেন-এর দখল ফিরে পায়।
তখন থেকেই কুর্দিরা সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্স-এর অধীনে থেকে বিভিন্ন আরব সেনাদের সাথে মিলে যুক্তরাষ্ট্রের জঙ্গিদমন অভিযানগুলোতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে আসছে। তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সিরিয়া ও তুরস্ক থেকে আইএস-কে বহুদূরে বিতাড়িত করে দেওয়া সম্ভব হয়েছে।

কেন তুরস্ক কুর্দিদের যুদ্ধে সাহায্য করতে অনিচ্ছুক?
তুর্কি রাষ্ট্র এবং সেখানে বসবাসকারী কুর্দিদের মাঝে রয়েছে এক গভীর শত্রুতা। তুরষ্কের মোট জনসংখ্যার ১৫% থেকে ২০% মানুষই কুর্দি জনগোষ্ঠীর। অতীতে তুরস্কের শাসকদের কাছ থেকে খারাপ ব্যবহারই পেয়ে এসেছে কুর্দিরা। ১৯২০ এবং ১৯৩০ সালের গণজাগরনের সময়ে অনেক কুর্দিকে পুনর্বাসিত করেছে তুরস্ক কর্তৃপক্ষ। কুর্দি নাম এবং সংস্কৃতিতেও আনা হয়েছিলো নিষেধাজ্ঞা, কুর্দিদের ভাষা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল এবং কুর্দিদের কুর্দি নামে না ডেকে ডাকা হতো পার্বত্য তুর্কির মানুষ বলে।
১৯৭৮ সালে আব্দুল্লাহ ওকালান প্রতিষ্ঠা করেন পিকেকে নামের একটি পার্টি। যারা তুরস্কের অভ্যন্তরেই এক স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে তোলার ডাক দেয়। এর ছয় বছর পরে এই দলটি এক সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করে। সে সময় থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় এই সশস্ত্র সংগ্রামে নিহত হয়েছেন ৪০ হাজার মানুষ। আরো কয়েকশত মানুষকে স্থানান্তর করে দেওয়া হয়েছে।

সিরিয়ার কুর্দিরা কি চায়?
সিরিয়ার জনসংখ্যার ৭% থেকে ১০% কুর্দি। ২০১১ সালে দেশটির প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ এর বিরুদ্ধে গনজাগরন শুরুর আগ পর্যন্ত তারা দামাস্কাস, আলেপ্পো, কোবেন, আফরিন এবং কামিশলি শহরের উত্তর-পূর্ব অংশে বসবাস করত। সিরিয়ান কুর্দিদের বহুকাল ধরে মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। ১৯৬০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩ লাখ কুর্দিকে সে দেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়নি, তাদের অনেক জমি জোরপূর্বক দখলও করা হয়েছে।

সেই গণজাগরণ থেকে যখন গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়, প্রধান কুর্দি দল কোন পক্ষের সমর্থন করেনি। ২০১২ সালের মধ্যবর্তী সময়ে সরকারী বাহিনী যুদ্ধে কিছুটা হাল ছাড়ে এবং কুর্দি দলগুলো পুনরায় নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিয়ে নেয়। ২০১৪ সালে ডমিন্যান্ট ইউনিয়ন পার্টিসহ কয়েকটি কুর্দি দল ঘোষণা দেয় যে তারা আফরিন, কোবেন এবং জাজিরায় স্বায়ত্বশাসন চালু করতে চায়। ২০১৬ সালের মার্চে তারা ঘোষণা করে যে, আরব ও তুরস্কের যে অঞ্চলগুলো আইএস-এর হাত থেকে ছিনিয়ে আনা হয়েছে সেখানে নিজেদের সরকার ব্যবস্থা চালু করবে তারা।
এই দুটি ঘোষণাই সিরিয়ার সরকার, বিরোধীদল, তুরস্ক এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথ্যাখ্যান করেছিল।

শেয়ার করুন