চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

স্বাধীনতার নায়ক থেকে স্বৈরশাসক

পূর্বকোণ ডেস্ক

৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ২:২২ পূর্বাহ্ণ

প্রায় তিন দশক জিম্বাবুয়ের ক্ষমতায় ছিলেন রবার্ট মুগাবে। স্বাধীন জিম্বাবুয়ের প্রথম প্রধানমন্ত্রী এবং পরবর্তীতে দেশটির প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবে জিম্বাবুয়েতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও দেশের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের অবসানের আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৮০ সালে স্বাধীনতার সাথে সাথে যে স্বপ্ন অর্জিত হয়েছিল, তা ধূলিস্যাৎ হয়ে যায় অর্থনৈতিক মন্দা, দুর্নীতি ও সহিংসতার প্রকোপে। পশ্চিমা নীতির, বিশেষ করে যুক্তরাজ্যের কড়া সমালোচক ছিলেন প্রেসিডেন্ট মুগাবে। যুক্তরাজ্যকে ‘শত্রু দেশ’ হিসেবেও ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি।

রাজনৈতিকভাবে বিরোধীদের ওপর নির্মম অত্যাচার করা বা অব্যবস্থাপনার কারণে একসময়কার সমৃদ্ধিশালী দেশকে দুর্দশার মুখে ঠেলে দিলেও তার জন্য আফ্রিকার অন্যান্য দেশের নেতাদের সমর্থনের কমতি ছিল না কখনো।

১৯২৪ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি তৎকালীন রোডেশিয়ায় জন্ম নেন রবার্ট গ্যাব্রিয়েল মুগাবে। তার বাবা ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ ‘শোনা’ ভাষাভাষী গোষ্ঠীর সদস্য এবং পেশায় একজন কাঠমিস্ত্রী। মুগাবে রোমান ক্যাথলিক মিশন স্কুলে পড়ালেখা শেষ করে শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পান। ঘানায় শিক্ষক হিসেবে পেশাগত জীবন শুরু করার আগে দক্ষিণ আফ্রিকার ফোর্ট হেয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপ পান মুগাবে, তার সাতটি একাডেমিক ডিগ্রির প্রথমটি এই ফোর্ট হেয়ার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নেয়া। ঘানায় কাজ করার সময় সেখানকার স্বাধীনতা পরবর্তী নেতা কোয়ামে এনক্রুমাহ’র আফ্রিকান একত্ববাদের আদর্শ তাকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে।
১৯৬৪ সালে এক ভাষণে রোডেশিয়ার প্রেসিডেন্ট ও তার সমর্থকদের ‘কাউবয়’ বা মেষপালক বলার পর মুগাবেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর প্রায় এক দশক কোন বিচার ছাড়াই তাকে আটকে রাখা হয়। তিনি কারাগারে থাকাকালীন সময়ই তার শিশু সন্তান মারা যায়। তাকে ছেলের শেষকৃত্যে উপস্থিত হওয়ারও অনুমতি দেয়নি কারা কর্তৃপক্ষ। ১৯৭৩ সালে আটক থাকা অবস্থাতেই জানু’র প্রেসিডেন্ট হন তিনি।

কারামুক্তির পর তিনি মোজাম্বিকে যান এবং রোডেশিয়ায় গেরিলা আক্রমণ পরিচালনা করেন। তার সংস্থা জানু সেসময় জিম্বাবুয়ে আফ্রিকান পিপলস ইউনিয়নের (জাপু) সাথে দুর্বল একটি জোট গঠন করে। রোডেশিয়ার স্বাধীনতার দাবিতে হওয়া রক্তক্ষয়ী আলোচনা চলাকালীন সময় আফ্রিকান নেতাদের মধ্যে মুগাবেই ছিলেন সবচেয়ে আগ্রাসী, এবং দাবি আদায়ে সেসময় তার ভূমিকাই ছিল সর্বাপেক্ষা আপোষহীন। ১৯৭৬ সালে লন্ডন সফরের সময় তিনি মন্তব্য করেন যে, রোডেশিয়া সমস্যার একমাত্র সমাধান আসতে পারে বন্দুকের নল থেকে।

বন্ধুত্বপূর্ণ নীতি : আগ্রাসী মনোভাবের জন্য খ্যাতি থাকলেও আলোচনার ক্ষেত্রে মুগাবের দক্ষতার কারণে সাবেক সমালোচকরা পরে যথেষ্ট প্রশংসা করেছেন তার। সংবাদমাধ্যম তাকে ‘চিন্তাশীলের গেরিলা’ উপাধিতে ভূষিত করেছিল।
১৯৭৯ সালে ল্যানসাস্টার হাউজ চুক্তি অনুযায়ী ‘জিম্বাবুয়ে প্রজাতন্ত্রী’র জন্য নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা হয়, যে সংবিধান মোতাবেক রোডেশিয়ার নতুন নাম ঠিক করা হয় জিম্বাবুয়ে। জিম্বাবুয়ের প্রথম সরকার গঠনের উদ্দেশ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয় ১৯৮০’র ফেব্রুয়ারিতে।
সেবারের নির্বাচনে ‘স্বঘোষিত মার্ক্সবাদী’ মুগাবে যখন জয়লাভ করেন তখন অনেক শ্বেতাঙ্গই রোডেশিয়া ত্যাগ করার প্রস্তুতি নিতে থাকেন।

মুগাবে ধীরে ধীরে তার রাজনৈতিক বিরোধীদের কন্ঠরোধ করেছিলেন। ৮০’র দশকের মাঝামাঝি সময়ে হাজার হাজার এনডেবেলেস গোষ্ঠীর মানুষের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়, যারা এনকোমোর আদি বাসস্থান মাতাবেলেল্যান্ডের অধিবাসী ছিল এবং যাদেরকে এনকোমোর সমর্থক হিসেবে মনে করা হতো।
ভূমি পুনর্বিন্যাসের আইন করার পর জানু-পিএফ সমর্থকরা কৃষি খামার দখল করে নেয়
প্রধানমন্ত্রীর অফিস বিলুপ্ত ঘোষণা করার পর ১৯৮৭ সালে জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট হন মুগাবে। ১৯৯৬ সালে তৃতীয় দফায় নির্বাচিত হন তিনি। সেবছরই গ্রেস মারুফুকে বিয়ে করেন তিনি। মুগাবের চেয়ে ৪০ বছরের ছোট মারুফুর সাথে তৎকালীন প্রেসিডেন্টের সেসময় দু’জন সন্তান ছিল। তৃতীয় সন্তানের জন্ম হয় মুগাবের বয়স যখন ৭৩।
বৈষম্যমুক্ত সমাজ তৈরিতে তার কিছু সাফল্য থাকলেও ১৯৯২ সালে ভূমি অধিগ্রহণ আইন প্রণয়ন করে কোন আবেদন ছাড়াই ভূমি অধিগ্রহণের নিয়ম তৈরি করেন। জিম্বাবুয়ের উৎকৃষ্ট মানের ভূমির দখল রাখা সাড়ে ৪ হাজার শ্বেতাঙ্গ কৃষকের হাত থেকে জমির মালিকানা পুনর্বিন্যাস করাই ছিল তার এই নীতির প্রধান লক্ষ্য।
বিদেশি বিনিয়োগ : জিম্বাবুয়ের কৃষিখাত প্রায় ধ্বংসের মুখে যাওয়ার কারণে মুগাবের সমালোচকরা তাকে দোষারোপ করেন। সমালোচকদের দাবি ছিল, জমির মালিকানা পুনর্বিন্যাস করার পর গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে তা হস্তান্তর করার বদলে নিজের পছন্দের ব্যক্তিদের সেসবের দায়িত্ব দেন তিনি।
আফ্রিকার সবচেয়ে বেশি খাদ্য উৎপাদন করা দেশগুলোর একটি থেকে দ্রুত বিদেশি বিনিয়োগ নির্ভর দেশে পরিণত হয় জিম্বাবুয়ে।

২০০২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিরোধী দল মুগাবে প্রায় ৫৭% ভোট পান এবং তার বিরোধী দল এমডিসি পায় প্রায় ৪২% ভোট।

ঐ নির্বাচনে মুগাবের বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ভয়ভীতি দেখানো এবং অনেক গ্রামে ভোটারদের ভোট দেয়া থেকে রুখতে ভোটকেন্দ্র বন্ধ করে দেয়ার অভিযোগ উঠেছিল।
সহিংসতা এবং জালিয়াতির অভিযোগ থাকায় সেসময় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ঐ নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্যতা দেয়নি। তারপর থেকেই মুগাবে এবং জিম্বাবুয়ে বাকি বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে শুরু করে। দেশের গণতন্ত্র পরিস্থিতি উন্নয়নের আগ পর্যন্ত কমনওয়েলথের বৈঠক থেকেও জিম্বাবুয়েকে নিষিদ্ধ করা হয়।
২০০৫ সালে জিম্বাবুয়েতে কালোবাজারি বন্ধ করার লক্ষ্যে অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত দেন মুগাবে, যার ফলশ্রুতিতে রাস্তায় ব্যবসা করা ৩০ হাজার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী গ্রেপ্তার হন এবং আনুমানিক সাত লক্ষ জিম্বাবুইয়ান গৃহহীন হয়ে পড়েন।
রাজনৈতিক বিরোধীদের সাথে দ্বন্দ্ব : ২০০৮ এর মার্চে প্রথম দফা নির্বাচনে হারলেও জুনে দ্বিতীয় দফায় তার প্রতিদ্বন্দ্বী মি. স্ভাঙ্গিরাই প্রার্থিতা প্রত্যাহার করলে আবারো নির্বাচিত হন তিনি।
মি. স্ভাঙ্গিরাইয়ের সমর্থকদের ওপর হামলা নির্যাতন অব্যাহত থাকায় কোনোভাবেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় বলে দাবি করে আসছিলেন তিনি। ফেব্রুয়ারি ২০০৯ এ মি. স্ভাঙ্গিরাইকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করান মুগাবে। তবে মি. স্ভাঙ্গিরাইয়ের সমর্থকরা তখনও নির্যাতন এবং হয়রানির শিকার হচ্ছিলেন। ২০০৯ সালে মরগ্যান সভাঙ্গিরাইয়ের সাথে জোট বাঁধেন মুগাবে
২০১৩ সালে আবারো ৬১% ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন মুগাবে, যার ফলে আবারো এককভাবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন তিনি। সেবারের নির্বাচনেও কারচুপির অভিযোগ ওঠে তবে সেসময় আগের নির্বাচনগুলোর মত সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি।
এরপর ধীরে ধীরে মুগাবের শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। ধারণা করা হতে থাকে যে তার মৃত্যুর পর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবেন তার স্ত্রী গ্রেস মুগাবে।
২০১৫ সালে রবার্ট মুগাবে ঘোষণা করেন যে, ২০১৮ সালের নির্বাচনেও তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন, যখন তার বয়স হওয়ার কথা ৯৪।

জিম্বাবুয়ের একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন মুগাবে, যিনি ২০১৬ এ বলেছিলেন শুধুমাত্র ঈশ্বর তাকে ক্ষমতা থেকে সরাতে পারবে
ফেব্রুয়ারি ২০১৬’তে তার উত্তরসূরি কে হবেন – এমন আলোচনা চলাকালীন সময় এক পর্যায়ে তিনি বলেছিলেন, ‘ঈশ্বর তুলে নেয়ার আগ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবো।’

তবে ঈশ্বর নয়, জিম্বাবুয়ের সেনাবাহিনীর জন্য ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন মুগাবে। ২০১৭’র ১৫ই নভেম্বর গৃহবন্দী হন মুগাবে এবং তার চারদিন পর তার রাজনৈতিক দল জানু-পিএফ পার্টির শীর্ষ নেতার পদ থেকে প্রতিস্থাপিত হন।
পদত্যাগে বাধ্য হওয়ার আগে তিনি এবং তার পরিবার ভবিষ্যতে যাতে বিচারের সম্মুখীন না হন – সেজন্য একটি চুক্তিও করেন। এর ফলে তার কিছু ব্যবসায়িক স্বার্থও রক্ষা হয়েছিল। তিনি কূটনৈতিক মর্যাদাসহ গাড়ি-বাড়িরও সুবিধা ভোগ করতে ছিলেন।
আফ্রিকা থেকে ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা দূর করতে মুগাবে বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন বলে মনে করা হতো, যার জন্য তিনি পুরো আফ্রিকায় নায়কের সম্মান পেতেন -সেই মুগাবেই পরিণত হয়েছিলেন স্বৈরশাসকে। ক্রমাগত মানবাধিকার লঙ্ঘন করে একসময়কার সমৃদ্ধশালী জিম্বাবুয়েকে তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত করেছিলেন তিনি।-তথ্যসূত্র বিবিসি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট