চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

আটকে গেল প্রত্যাবাসন

রোহিঙ্গাদের অনাগ্রহ

হাফেজ মুহাম্মদ কাশেম , টেকনাফ

২৩ আগস্ট, ২০১৯ | ১:৫৩ পূর্বাহ্ণ

 

হ স্থানীয় লোকজনের ক্ষোভ
হ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী ও কতিপয়
এনজিওর মাঝে স্বস্তির ভাব

রোহিঙ্গাদের দেয়া শর্ত পূরণ না হওয়ায় তালিকাভুক্ত কোন রোহিঙ্গাই স্বদেশে ফিরতে রাজি হননি। ফলে বাংলাদেশ সকল প্রস্ততি সম্পন্ন করার পরও পূর্ব নির্ধারিত গতকাল ২২ আগস্ট বহুল প্রত্যাশিত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হয়নি। এ নিয়ে পর পর দু’ বার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ভেস্তে গেল। গতকাল (বৃহস্পতিবার) টেকনাফের কেরুনতলী এবং বালুখালীর তুমব্রু পয়েন্ট দিয়ে মিয়ানমারের অনুমোদিত ৯৩৩ পরিবারের ৩ হাজার ৪৫০ রোহিঙ্গাদের মধ্যে ১ম দফায় ৩০০ জন ফেরত যাওয়ার কথা ছিল।
জানা যায়, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হলেও রোহিঙ্গাদের দেয়া শর্ত পূরণ না হওয়ায় তালিকাভুক্ত কোন রোহিঙ্গাই স্বদেশে ফিরতে রাজি হয়নি। গতকাল (বৃহস্পতিবার) দুপুর সাড়ে ১২ টার দিকে কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. আবুল কালাম রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন স্থগিত করেন। সংক্ষিপ্ত ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে নয়াপাড়া-২৬ নং ক্যাম্পে উপস্থিত হয়ে তিনি গতকালের প্রত্যাশিত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন স্থগিতের ঘোষণা দেন। এ খবরে স্থানীয় লোকজনকে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেলেও ওই এলাকার রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী ও কতিপয় এনজিওর মাঝে কিছুটা স্বস্তির আভাস পাওয়া গেছে।

গতকাল (বৃহস্পতিবার) সরেজমিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত টেকনাফ জাদিমোরা শালবাগান রোহিঙ্গা শিবিরে দেখা যায়, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের শালবাগান ২৬ নম্বর রোহিঙ্গা শিবিরের সামনে টেকনাফ-কক্সবাজার আঞ্চলিক সড়কের পশ্চিম পাশে প্রত্যাবাসন প্রত্যাশী রোহিঙ্গাদের বহন করার জন্য প্রধান সড়কের পাশে ৫টি মাইক্রোবাস, ৩টি বাস ও ২টি ট্রাক ও লেদা ক্যাম্পের পাশে আরও দুটি বাস প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। এছাড়া টেকনাফ সদর ইউনিয়নের কেরুণতলী রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ঘাটেও আনসার বাহিনীর সদস্যদের ডিউটি করতে দেখা গেছে। পুরো টেকনাফে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নিরাপত্তা বলয় স্থাপন করা হয়েছিল।
গতকাল (বৃহস্পতিবার) ৩য় দিনের মতো জাদিমোরা শালবাগান ক্যাম্প ইনর্চাজের অফিসে স্থাপিত সাক্ষাৎকার কেন্দ্রে হাতে ফাইল নিয়ে বিভিন্ন বয়সের নারী পুরুষেরা সাক্ষাৎকার দিতে আসেন। তবে অন্য দিনের তুলনায় গতকালকের চিত্র ছিল ভিন্ন।
ক্যাম্প ইনর্চাজের পাশে কয়েকটি ব্লকে গিয়ে দেখা যায়, রোহিঙ্গারা প্রত্যাবাসন নিয়ে কানাঘুষা করছে। আবার কোন কোন ঘরের দরজায় তালাও দেখা যায়। পাশে থাকা লায়লা ও রশিদা বেগম নামের দুই রোহিঙ্গা নারীর কাছে ঘরে তালা দেওয়ার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তারা জানান, আজ (গতকাল বৃহস্পতিবার) রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কথা আছে, যাদের নাম তালিকায় আছে তাদের অনেকে জোর করে পাঠানোর ভয়ে ঘরে তালা দিয়ে পালিয়ে গেছে।

এদিকে টেকনাফের শালবাগান ২৬ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ২০ আগস্ট থেকে ২২ আগস্ট পর্যন্ত মোট ৩৩৯ পরিবারের সাক্ষাৎকার সম্পন্ন হয়েছে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) এবং রোহিঙ্গা ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) কার্যালয়ের সমন্বয়ে ১০টি দল শালবাগানের বিভিন্ন ব্লকের ঘরে ঘরে প্রত্যাবাসন তালিকায় নাম থাকা রোহিঙ্গাদের সিআইসি কার্যালয়ে আসার জন্য বলা হয়। ইউএনএইচসিআর এবং শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) কার্যালয়ের প্রতিনিধিরা সাক্ষাৎকার দিতে রোহিঙ্গাদের ঘরে ঘরে গিয়ে উৎসাহিত করছেন। তবে সাক্ষাৎকার দেয়া রোহিঙ্গা পরিবারের প্রধানগণ শর্ত পূরণ ছাড়া স্বদেশে ফিরতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেছেন। শর্তগুলো হচ্ছে এনভিসি কার্ড নয় সরাসরি নাগরিকত্ব প্রদান, ভিটে-বাড়ি ও জমি-জমা ফেরত, আকিয়াব জেলায় আশ্রয় শিবিরে থাকা রোহিঙ্গাদের নিজ বাড়িতে ফেরত, মিয়ানমারের মাব্রাই দীর্ঘদিন ধরে বন্দি এক লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাদের মুক্তি, হত্যা, ধর্ষণের বিচার, অবাধ চলাফেরা করার সুযোগ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে এগিয়ে নিতে জাতিসংঘ উদ্বাস্ত বিষয়ক হাইকমিশন (ইউএনএইচসিআর) ও সরকারের পক্ষ থেকে ক্যাম্পের অভ্যন্তরে রোহিঙ্গাদের কাছে লিফলেট বিতরণ করা হয়। লিফলেটে স্বদেশ ফিরে গিয়ে কোথায়, কিভাবে রাখা হবে এবং পরবর্তীতে কি কি করণীয় সে সম্পর্কে ধারণা রয়েছে।

বেলা সাড়ে ১১টায় শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মো. আবুল কালাম, চীনা প্রতিনিধিদলের ২ জন, মিয়ানমার প্রতিনিধিদলের ১ জন ও বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ১ জনসহ সরকারি বিভিন্ন কর্মকর্র্তারা জাদিমোরা শালবাগান রোহিঙ্গা শিবিরে ক্যাম্প ইনচার্জের কার্যালয়ে আসেন। এসময় তাঁরা ক্যাম্পে স্থাপিত সাক্ষাৎকার কেন্দ্র পরিদর্শন করেন। এরপর প্রত্যাবাসন তালিকাভুক্ত কয়েকজন নারী পুরুষের সঙ্গে কথা বলেন। রোহিঙ্গারা তাদেরকে শর্তজুড়ে দিয়ে মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার ব্যাপারে আশ্বস্ত করেন।

দুপুর ১২ টায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে কক্সবাজারের ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের দেওয়া শর্ত পূরণ না হলে তাদের একজনও স্বদেশে ফিরতে চান না। বৃহস্পতিবার (গতকাল) রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা থাকলেও শর্তবিহীনভাবে ফেরত যাওয়ার মতো একজন রোহিঙ্গাকেও পাওয়া যায়নি। শর্ত পূরণ না হলে রোহিঙ্গাদের একজনও স্বদেশে ফিরতে চান না। প্রত্যাবাসনের তৎপরতা শুরু হলে মিয়ানমারে নাগরিকত্ব, স্বাধীনভাবে চলার নিরাপত্তা, ফেলে আসা সম্পত্তি ফেরত ও নিরাপত্তা নজরদারির শর্ত দিয়েছিলেন বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা। মিয়ানমার থেকে পাঠানো তালিকায় ৩ হাজার ৪৫০ জন রোহিঙ্গার নামের তালিকা বাংলাদেশ সরকারকে দেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ সরকার প্রথম থেকে বলে আসছিল কোনো রোহিঙ্গা নাগরিককে জোর করে মিয়ানমারে পাঠানো হবে না। তাই বৃহস্পতিবারও (গতকাল) তাদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার জন্য গতকাল যে নির্ধারিত সময় ছিল, তার জন্য সরকার যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করে।
রোহিঙ্গাদের সংবাদ সম্মেলন :
গতকাল (বৃহস্পতিবার) দুপুর দেড়টার দিকে জাদিমোরা শালবাগান রোহিঙ্গা শিবিরে ই-ব্লকের রোহিঙ্গা আরাকান সোসাইটি নামে কিছু রোহিঙ্গা নেতা ৪ দফা দাবি দিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন।
এতে লেদা, নয়াপাড়া, শালবাগান রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের ব্লকের দল নেতা (মাঝি), ইমাম ও আরাকান সোসাইটি সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ উল্লাহ, ইমাম মোহাম্মদ ইব্রাহীম চার দফা দাবি তুলে ধরে বক্তব্য রাখেন। দাবিগুলো হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে হবে, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, জমি-জমা ফেরত দিতে হবে । এছাড়া মিয়ানমারে রোহিঙ্গা শিবিরে থাকা ১ লাখ ২৮ হাজার রোহিঙ্গাদের মুক্ত করে স্ব স্ব গ্রামে বসবাসের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির পাশাপাশি রোহিঙ্গাদেরও চলাফেরার স্বাধীনতা দিতে হবে।

শেয়ার করুন