চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

চ্যাট জিপিটি (পর্ব দুই)

আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স’র অঙ্গীকার এবং বিপদ

১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ | ৪:৩১ পূর্বাহ্ণ

আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) নিয়ে কথা বলা আজকাল রাজনীতি আর পরিবেশ নিয়ে কথা বলার মতোই ‘নিত্য-কথন’র ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বোঝা কঠিন, শক্তিশালী আবেগ বাড়াতে সক্ষম এবং প্রায়শই আমাদের কেমন যেন একটা ‘ডুবে যাওয়া’ অনুভূতি দেয় এটা। তারপরও কেমন একটা সহজ-সরল ব্যাপার আছে এতে যা প্রায়শই আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়। তাই আমাকে বিষয়টির এই রহস্য-উন্মোচন করার চেষ্টা করতে দিন এআই-এর প্রতিশ্রুতি এবং বিপদ- এই উভয় দিক নিয়ে সরাসরি কথা বলতে দিন। এআই বা আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স হলো এমন এক রোমাঞ্চকর প্রযুক্তি, মানুষই যার অন্তর্গত সরঞ্জাম এবং কৌশলগুলি তৈরি করে দিয়েছে। এআই-এর কেন্দ্রস্থলে, আমরা খুঁজে পাই অ্যালগরিদম (এক ধরণের অ-প্রাযুক্তিক ভাষা)। এগুলো হলো ‘কীভাবে কী করতে হয়’ তার নির্দেশাবলীর একটি সেট যার বেশিরভাগই কম্পিউটার কোড হিসাবে উল্লেখ করা থাকে। উদাহরণস্বরূপ, গুগল সার্চের কেন্দ্রবিন্দু হল এক ধরণের ‘পেজ র‌্যাঙ্ক অ্যালগরিদম’ (কোড-এর সেট) যা সাইটের লিঙ্কের সংখ্যা অনুসারে ওয়েব সাইটগুলিকে ক্রমান্বয়ে সাজিয়ে তোলে। এভাবে সার্চ বারে লিখিত শব্দ বা বাক্যের সাথে ‘প্রাসঙ্গিক’ এবং ‘গুরুত্ব’ বিবেচনা করে এটি কাজ করে।
একইভাবে, অন্যান্য প্রযুক্তিগুলোও অ্যালগরিদম ব্যবহার করে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, আপনার অবস্থান নির্ধারণ করতে আপনার সেলফোন সংকেতের সাহায্য নেয়া হয়। গুগল ম্যাপ এভাবেই কাজ করে। আপনি যখন টাইপ করেন ‘আমি আমার বাড়ির কাছাকাছি কোথা থেকে জুতো কিনতে পারি?’ ইন্টারনেট জুড়ে অ্যালগরিদমের বেশ কয়েকটি সেট আপনার স্মার্ট ফোন সিগন্যাল এবং একটি কম্পিউটারাইজড ম্যাপ দিয়ে আপনার অবস্থানের সবচেয়ে কাছের জুতোর দোকানগুলি কোথায় রয়েছে, সেইসাথে আপনি কোথায় তা কিনতে পারবেন সেই সাইটগুলিও আপনাকে বলে দেবে। অ্যালগরিদম (যা মানুষের দ্বারা লিখিত) প্রচুর তথ্য ভিত্তিক ডাটার (এগুলোও মানুষের দ্বারা তৈরি) উপর কাজ করে। অনুবাদ সফ্টওয়্যারকে শক্তি দেয় অমন একটি প্রযুক্তি হলো- মেশিন লার্নিং প্রযুক্তি। এর সাহায্যে স্প্যানিশ থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করা যায় রীতিমতো জাদুকরিভাবে। মেশিন লার্নিং প্রযুক্তিও বিশাল ডাটা-ভা-ারের (একটি অনুবাদ সফটওয়্যার লক্ষ লক্ষ বই ও নিবন্ধের ওপর উভয় ভাষায় কাজ করার ক্ষমতা ধরে) ওপর কাজ করা অ্যালগরিদমের একটি সেট।
আমার গত নিবন্ধে উল্লেখিত চ্যাট জিপিটি হলো একটি ‘জেনারেটিভ এআই’ প্রযুক্তি যা ডাটার বিশাল সেট নিয়ে কাজ করে। আবার এটিও অ্যালগরিদমের একটি সেটে তৈরি করা প্রযুক্তি যা মেশিন লার্নিং সেট থেকেই আসে।
এটি বোঝাও গুরুত্বপূর্ণ যে, যে ‘ডাটা অ্যালগরিদমগুলি’ ইনপুট হিসাবে ব্যবহার করা হয় তাও সাধারণত মানুষের দ্বারাই তৈরি হয়। আর এআই-এর অত্যাবশ্যকীয় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত এই ডাটা আমাদের কাছ থেকেই আসে। আর এভাবেই আমরা একটি লিঙ্কে প্রবেশ করে হয়তো কোনোও একটি পোস্ট পছন্দ করি- এবং ওই ডাটা-সমুদ্র থেকে এভাবেই আমরা অনুসন্ধানাদি চালাই।
যাহোক, ডাটা-নির্ভর এই এআই টুলগুলোর রায় অনেক সময়েই ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ প্রমাণিত হতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক একটি উদাহরণ এর জ্বলন্ত প্রমাণ। এআই টুল দিয়ে আবেদনকারীদের জীবনবৃত্তান্ত স্ক্যান করতে গিয়ে দেখা যায়, এটি মহিলাদের তুলনায় পুরুষদের বেশি ‘ফেভার’ করেছে। এতে আসলে বিস্মিত হবার কিছু নেই। পুরুষ-শাসিত অতীত কর্মক্ষেত্রগুলোয় স্বাভাবিকভাবেই সাফল্যগাথা পুরুষকে নিয়েই রচিত হয়েছে। আর ওই তথ্যই ডাটার মাধ্যমে পেয়েছে এআই অ্যালগরিদমগুলো। বলাইবাহুল্য ফলস্বরূপ ওই ‘পক্ষপাতিত্ব’।
এআই এর আরেকটি সুপরিচিত উদাহরণ যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব ফেলে তা হল সোশ্যাল মিডিয়া। আমাদের Facebook, Instagram এবং YouTube ফিডগুলি আমাদেরকে এমন বিষয়বস্তুগুলোই দেখায় যা অ্যালগরিদম আমাদের প্রোফাইল কিংবা ব্রাউজিং হিস্টরির উপর ভিত্তি করে আমরা কী দেখতে চাই তা সাজেস্ট করে। ইন্টারনেটের সুবিশাল সাগর থেকে আমাদের সাধারণ আগ্রহের বিষয়গুলোকে দৃষ্টির সামনে নিয়ে আসার এ কাজটি নিশ্চিতভাবেই আমাদের বেশ কাজে লাগে।
একইভাবে, অ্যালগরিদম দ্বারা চালিত ই-কমার্স (যা লক্ষ লক্ষ ব্যবহারকারীদের দ্বারা উৎপন্ন ডাটার উপর নির্ভর করে) আমাদের অনলাইন কেনাকাটায় সহায়তা করে।
এআই-এর প্রচুর সুবিধা যেমন রয়েছে, তেমনি একই সাথে এর বিশাল চ্যালেঞ্জও রয়েছে, অর্থাৎ এর অসুবিধাও নিশ্চিতভাবে রয়েছে। এআই অ্যালগরিদমগুলি এমন কিছু বিষয়ের পূর্বাভাস দিয়ে থাকতে পারে (ভুল তথ্য পরিবেশন) যেগুলো আমাদের নিকৃষ্ট মানবিক আবেগগুলোকে (ভয়, উদ্বেগ, লোভ, লালসা) উসকে দিয়ে নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের ক্রোধ, উষ্মা কিংবা উদ্বেগ বাড়িয়ে সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। কোভিড বিষয়ে ভুল তথ্যের ‘নাটক’ আমরা সম্প্রতি দেখেছি।
আমাদের সকলকে মনে রাখতে হবে যে, শেষ পর্যন্ত আমরা, মানুষ। এআই এর অন্তর্গত কার্যকর অ্যালগরিদমগুলির আমরাই লেখক এবং আমরাই এগুলো নিয়ন্ত্রণ করি। এআই তার উপসংহারে আসার জন্য যে সমস্ত ডাটা ব্যবহার করে, সচেতনভাবে বা অচেতনভাবে এই মানুষই তার উৎস।
আমাদের সর্বদা মনে রাখতে হবে যে, অ্যালগরিদমগুলি প্রেম, সুখ বা ভয় এবং রাগ অনুভব করতে পারে না। একটি অ্যালগরিদমের জন্য কোন বস্তুনিষ্ঠ সত্য বা মিথ্যা নেই, কম্পিউটার কোডের লাইনের একটি সিরিজ থেকে কেবল একটি গাণিতিক ফলাফল বের করা পর্যন্তই এর দৌড়।
তাহলে এআই সম্পর্কিত প্রযুক্তিকে সঠিকভাবে বুঝতে এবং ব্যবহার করার জন্য- যাতে সুবিধা এবং চ্যালেঞ্জগুলির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা যায়, আমরা কী করতে পারি?
প্রথমত, ভয় ছাড়াই এআই সরঞ্জামগুলি ব্যবহার করুন এবং পরীক্ষা করুন। সাধারণত তরুণ প্রজন্ম জানবে কীভাবে এই টুলগুলিকে স্বাভাবিকভাবে ব্যবহার করতে হয়, তাই তাদের জিজ্ঞাসা করুন কীভাবে প্রতিদিন এই টুলগুলি ব্যবহার করতে হয়।
দ্বিতীয়ত, মনে রাখবেন যে এআই টুলগুলি থেকে আপনি যে ফলাফল পাচ্ছেন তা সবসময় ‘সত্য’ নয়; সংশয় দূর করার জন্য আরো উত্তর দেখুন ও যাচাই করুন।
তৃতীয়ত, সফ্টওয়্যার কোম্পানি এবং যারা এআই ব্যবহার করে এমন সফ্টওয়্যার বা পরিষেবা বিক্রি করে তাদের কাছ থেকে পক্ষপাত, প্রাসঙ্গিকতা এবং নির্ভুলতা সম্পর্কে আপনার প্রশ্নের সহজ উত্তর দাবি করুন। পরিশেষে, বিশ্বাস রাখুন যে কোনোও প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য কোনও না কোন মানুষ আছেনই।
নৈতিক বিবেচনা জড়িত এমন সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে সবসময় চূড়ান্ত বিচারক এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী হবে একজন মানুষ, অ্যালগরিদম নয়।
[অনূদিত]

লেখক : সিইও, ডব্লিউএন্ডএ কনসাল্টিং : প্রাক্তন প্রধান কৌশলী ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা হারশে (Hershey),ফার্মার ব্রাদার্স’র পরিচালনা পরিষদের সদস্য। এছাড়াও ‘ফরচুন ফাইভ হানড্রেড’ কোম্পানির বেশ ক’টি প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। বর্তমানে উদ্যোক্তাদের পরামর্শ আর সিনিয়র এক্সিকিউটিভদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট