চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

চ্যাট জিপিটি

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অঙ্গীকার ও বিপদ

ওয়াহিদ জামান

৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ | ৫:২৮ পূর্বাহ্ণ

গত নভেম্বরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) টুল, ‘চ্যাট জিপিটি’র আত্মপ্রকাশ এবং এর প্রাথমিক ব্যবহার বিশ্বকে দারুণভাবে আলোড়িত করেছিল।
এর সহজ ব্যবহারযোগ্যতা আর আলাপচারিতায় অবাক করা মানব-সদৃশ আচরণ- ‘কীভাবে এই প্রযুক্তি কাজ করে’, ‘চাকুরিচ্যুতি কিংবা শিক্ষার মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাধা ইত্যাদির বিরুদ্ধে এটা কী আশীর্বাদ হতে চলেছে’, অথবা ‘এটা কী মানবতার নতুন কোনোও অস্ত্র’- ইত্যকার নানা প্রশ্নের সৃষ্টি করছে।
এই নিবন্ধে আমি ‘চ্যাট জিপিটি’র ওপরই ফোকাস করব। আগামী নিবন্ধে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে সাধারণভাবে আলোচনা করব।
তো, ‘চ্যাট জিপিটি’ কী- আমি এই প্রশ্নটি ‘চ্যাট জিপিটি’ অ্যাপ্লিকেশন সফ্টওয়্যারে টাইপ করেছি এবং সেটা আমাকে এই উত্তরটা দিয়েছে :
‘চ্যাট জিপিটি’ একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক ভাষার মডেল যেটি তৈরি করেছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স রিসার্চ কোম্পানি ‘ওপেন এআই’। এটি এক ধরনের ‘চ্যাট জেনারেটিভ প্রি-ট্রেইনড ট্রান্সফরমার’ (জিপিটি)। এর রয়েছে উচ্চ-মানের টেক্সট জেনারেশন এবং এটি প্রচুর পরিমাণে টেক্সট ডেটার উপর প্রাক-প্রশিক্ষিত। ফলে এটি বিভিন্ন বিষয়ের উপর সুসংগত এবং সাবলীল পাঠ (প্রাকৃতিক) তৈরি করতে পারে। শব্দ আর বাক্যাংশের মধ্যে সম্পর্ক বুঝতে এটি উচ্চতর শিক্ষাকৌশল ব্যবহার করে এবং এই বিচারবুদ্ধিকে পুঁজি করে এটি মানুষের মতো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে সক্ষম।
হুম… খারাপ না। অর্থাৎ সহজ ভাষায়, এটি এমন একটি সফ্টওয়্যারের অংশ যেটা নানা উৎস থেকে সংগৃহীত লিখিত তথ্যাদি সংগ্রহ করে এর ভেতরকার শব্দ ও বাক্যাংশের মধ্যকার সম্পর্ক (মেশিন লার্নিং নামে একটি উন্নত কৌশল ব্যবহার করে) বুঝে সহজ প্রশ্নাদির বোধগম্য উত্তর দিয়ে থাকে। চ্যাট জিপিটি হল জেনারেটিভ এআই বিষয়ক গবেষণার সাম্প্রতিক অগ্রগতির ফল। এবং এআই বিষযক আরো অগ্রগতির ফল সম্প্রতি বের হয়েছে। ‘স্ট্যাবিলিটি ডিফিউশন’ গত গ্রীষ্মে মুক্তি পেয়েছে। এটি চ্যাট জিপিটির টেক্সট এর মতোই প্রশ্নের উপর ভিত্তি করে ইমেজ তৈরি করতে পারে। কার্যকারিতার পাশাপাশি সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও জেনারেটিভ এআই টেক্সট এবং ছবির ক্ষেত্রে যা করতে পারে তার পরিধিটা বিশাল। নিচের উদাহরণটি থেকে তার আঁচ পাওয়া যাবে।
আমি চ্যাট জিপিটি-কে ইতিহাস বিষয়ে একটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলাম : ‘হাই স্কুলের ইতিহাস ক্লাসের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর একটি এক অনুচ্ছেদের জীবনী লিখুন। উত্তরটা ছিল এরূপ-
“রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একজন বাঙালি প-িত যিনি ১৮৬১ থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। তিনি একাধারে একজন কবি, নাট্যকার, সুরকার এবং চিত্রকর এবং ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি ছিলেন প্রথম অ-ইউরোপীয় যিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার জিতেছিলেন ১৯১৩ সালে তাঁর কবিতা সংকলন ‘গীতাঞ্জলি’র জন্য। তিনি একজন শক্তিশালী বাগ্মী ছিলেন ভারতীয় স্বাধীনতার জন্য এবং আধুনিক ভারতীয় শিল্প গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। তাঁর সাহিত্য ও শৈল্পিক কৃতিত্বের পাশাপাশি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একজন স্বপ্নদর্শী ছিলেন যিনি শিক্ষার প্রচার এবং বিশ্ব শান্তির পক্ষে সোচ্চার ছিলেন। তার কাজ এখনো ব্যাপকভাবে পঠিত এবং সুপ্রসিদ্ধ এবং তিনি বাংলা ভাষা শ্রেষ্ঠ কবিদের একজন হিসাবে বিবেচিত হন।”
একজন বুদ্ধিমান মানুষের মতো উত্তরই মনে হচ্ছে। কিন্তু গভীরভাবে দেখলে দেখা যাবে, এটা মোটেই বুদ্ধিবৃত্তিক হয়নি। সফ্টওয়্যারটি সত্যিকার অর্থে প্রশ্নটিই বুঝতে পারেনি। এটি কেবল তার ডাটাবেসে আগে থেকে মজুত থাকা শব্দ এবং বাক্যাংশের মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারণ করে
মানুষের বোধগম্য উত্তরটি দিয়েছে।
যদিও এটি সত্যিই ‘বুদ্ধিমত্তা’ নয়, বিস্তৃত জ্ঞান নিয়ে কাজের উপর এর প্রভাব খুবই বাস্তব। ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রাচীন ও মর্যাদাপূর্ণ ব্যবসায়িক স্কুলগুলির মধ্যে একটির (ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার হোয়ার্টন) একজন অধ্যাপক ক্রিশ্চিয়ান টেরউইশ, চ্যাট জিপিটি- এর ক্ষমতা সম্পর্কে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগগুলি পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছেন মূল এমবিএ বিষয়ের অন্তর্গত ‘অপারেশনস ম্যানেজমেন্ট কোর্স’র কিছু ছাত্রকে এটি ছাড়িয়ে গিয়েছে।
প্রফেসর টেরউইশ জানুয়ারিতে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন যার শিরোনাম ছিল, ‘চ্যাট জিপিটি৩’ কী একটি হোয়ার্টন এমবিএ পেতে পারে?
তিনি উপসংহারে বলেছিলেন : ‘চ্যাট জিপিটি৩ পরীক্ষায় বি গ্রেড পেতে পারতো। ব্যবসায়িক স্কুল শিক্ষার ওপর এর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে।’ তিনি পরীক্ষার নীতি, পাঠ্যক্রমের নকশা এবং পাঠদানের প্রক্রিয়া পুনর্বিবেচনার প্রস্তাব রেখেছেন।
আমার উদাহরণসহ নেওয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের একটি প্রবন্ধ, ‘চ্যাট জিপিটি’র ক্ষমতা শিক্ষাবিদদের মনোযোগ সহকারে দেখতে বাধ্য করবে।
শিক্ষার বাইরে, এটা আমার কাছে স্পষ্ট যে বর্তমানে অনেক পুনরাবৃত্তিমূলক কাজ হচ্ছে। জুনিয়র আইনজীবী এবং ব্যবস্থাপনা পরামর্শদাতাদের
মতো জ্ঞান কর্মীদের কাছে চ্যাট জিপিটির মতো সফ্টওয়্যারগুলো তথ্যাদির প্রতিলিপি তৈরির ভালো হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে।
আমি সাধারণ ব্যবসায়িক সমস্যা এবং ধারণা সম্পর্কে কতক প্রশ্ন (যেমন : ‘লেটার অব ক্রেডিট কী’ কিংবা ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড’র উত্তরাধিকার নিয়ন্ত্রণকারী আইনগুলি ব্যাখ্যা করুন’ ইত্যাদি) জিজ্ঞেস করেছিলাম, এবং চ্যাটজিপিটি প্রশ্নগুলির যুক্তিসঙ্গত খসড়া উত্তর দিয়েছিল।
কম্পিউটারগুলির বিশ্বাসযোগ্য উত্তর দেয়া দেখে অন্ধভাবে সেটাকে বিশ্বাস না করার ওপর জোর দিতে হবে। তারা কেবল তাদের স্মৃতিভান্ডারে থাকা অগুণতি ডাটা বিশ্লেষণ করে তাদের দ্বারা সম্ভব সরচেয়ে ভালো ‘অনুমান’টি উল্লেখ করে। তারা এক্ষেত্রে প্রশ্নটি সঠিকভাবে বুঝতে সক্ষম নয়।
উদাহরণস্বরূপ, আমি চ্যাট জিপিটি-কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাইজেরিয়ায় সম্মানিত? উত্তরটা ছিল প্রশংসনীয়। কিন্তু আমি বিভ্রান্ত এবং একইসাথে সন্দিহান হয়ে পড়লাম এটা ভেবে যে, তারা কীভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা এবং সঙ্গীত সম্পর্কে এতো কিছু জানতে পারলো!
ইন্টারনেটে অনুৎপাদনশীল, মানহীন অনেক কিছুই বিপুল পরিমাণে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ঢুকে পড়ছে। এর বেশিরভাগেই ফ্রি অ্যাকসেস পাওয়া যায়। লাখ লাখ লোক- যারা ব্যয়বহুল বই এবং শেখার উপকরণ সংগ্রহ করতে পারে না, তারাই মুলত: এসব থেকে তাদেও ‘জ্ঞানভা-ার’ পূর্ণ করে থাকে। যাহোক শিক্ষার গণতন্ত্রীকরণ অব্যাহত থাকবে যা একটি ভাল জিনিস!
আমার পরবর্তী নিবন্ধে, আমি এআই এর উন্নয়ন সম্ভাব্যতা এবং চ্যালেঞ্জগুলির বিষয়ে আরও প্রতিফলিত করার চেষ্টা করব। ততক্ষণ পর্যন্ত, chat.openai.com.-এ ChatGPT ব্যবহার করেই দেখুন! [অনুদিত]
লেখক : সিইও, ডব্লিউএন্ডএ কনসাল্টিং : প্রাক্তন প্রধান কৌশলী ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা হারশে (Hershe),ফার্মার ব্রাদার্স’র পরিচালনা পরিষদের সদস্য। এছাড়াও ‘ফরচুন ফাইভ হানড্রেড’ কোম্পানির বেশ ক’টি প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। বর্তমানে উদ্যোক্তাদের পরামর্শ আর সিনিয়র এক্সিকিউটিভদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট