চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

গণতন্ত্রের ‘মডেল’ যুক্তরাষ্ট্রই এখন গণতন্ত্রের সংকটে

ইন্টারন্যাশনাল ডেস্ক

৭ নভেম্বর, ২০২২ | ১১:২৯ পূর্বাহ্ণ

[দেশের অর্থনীতি এখনও প্রাণবন্ত, জনসংখ্যাগত দিক থেকে স্থিতিশীল পরিস্থিতিতে থাকার পাশাপাশি দেশটি বিশ্বের নেতৃস্থানীয় সামরিক শক্তিগুলির অন্যতম। কিন্তু দেশটির কূটনৈতিক ক্ষমতা অভ্যন্তরীণ ঘটনাবলি এবং বিশ্বব্যাপী দেশটির অসামঞ্জস্যপূর্ণ আচরণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এক্ষণে নানা জরিপে দেখা যাচ্ছে ডেমোক্র্যাটদের জনপ্রিয়তা পড়তির দিকে।

 

আর এই সুযোগে, বিশেষ করে এই মধ্যবর্তী নির্বাচনকে সামনে রেখে রিপাবলিকানরা যেন গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে চাইছে। তবে দুই দলের জয়-পরাজয়ের হিসেবের বাইরে সাধারণ মানুষ ভাবছে নির্বাচনী সহিংসতা নিয়ে। সন্দেহ নেই মার্কিন রাজনীতিতে এই ‘আশঙ্কা’টি উসকে দিয়েছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।]

 

 

মার্কিন গণতন্ত্রের ভিত সত্যিই হয়তো তেমন নড়বড়ে হয়ে ওঠেনি। কিন্তু ওই দেশটিরই বিভিন্ন টিভি চ্যাট শোতে শোনা যাচ্ছে, ‘পরবর্তী রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হতে পারে মার্কিন ইতিহাসের শেষ গণতান্ত্রিক নির্বাচন’। তাদের ভাষায়, আমেরিকান গণতন্ত্র এখন দারুণ সমস্যায় জর্জরিত হয়ে আছে। অথচ ক’বছর আগেও এটা কল্পনা করা কঠিন ছিল যে কেউ মূলধারার টেলিভিশনে পরামর্শ দিচ্ছে যে, আমেরিকার নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস হতে পারে। তবে গত ক’টি বছরে ‘আমেরিকান গণতন্ত্র’র মৃত্যুর পূর্বাভাস দেয়া প্রায় স্বাভাবিক হয়ে গেছে। এর প্রাথমিক কারণ অবশ্যই একজন প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, যিনি ২০২০’র নির্বাচন সম্পর্কে কেবলি মিথ্যা তথ্য ছড়িয়েছেন।

 

সবচেয়ে আশঙ্কার কথাটি হলো- তার কথাগুলো রিপাবলিকানদের একটা বিরাট অংশ প্রায় অন্ধের মতোই বিশ্বাস করে বসেছে। ৬ জানুয়ারি ২০২১’র ইউএস ক্যাপিটলে সহিংস হামলা, জো বাইডেনের বিজয়ের সার্টিফিকেশন রোধ- এসব-ই গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হয়েছে। সৌভাগ্যক্রমে, তাদের সে ইচ্ছা পূরণ হয়নি। কিন্তু এখন অনেকেই বিশ্বাস করেন যে ট্রাম্প পরের বার রিপাবলিকান মনোনয়ন পেতে চলেছেন এবং সত্যিই যদি তা ঘটে তবে তিনি ২০২৪ সালে জিততেও পারেন।

 

আর যদি তারা (রিপাবলিকানরা) অফিসে ফিরে আসেন, তবে তারা নিশ্চিত ‘প্রতিশোধ’ নেওয়ার চেষ্টা করবেন। তারা সিভিল সার্ভিস থেকে তাদের প্রতিপক্ষকে বিতাড়িত করার জন্য ‘সিডিউল এফ’ নামের একটি স্বল্প পরিচিত আইনি ধারা ব্যবহার করার পরিকল্পনা করছেন। অর্থাৎ যেসব আমলা ট্রাম্প প্রশাসনের ‘সবচেয়ে খারাপ বাড়াবাড়ি’গুলো আটকাতে কাজ করেছিলেন, তারাই পড়তে চলেছেন ওই রোষানলে।

 

এ-ই যদি হয় অবস্থা, তাহলে ২০২৪-এ দেশটি পড়তে চলেছে ‘প্রতিশোধের রাজনীতি’র ঘেরাটোপে। এ শঙ্কাতেই ডেমোক্র্যাটরা গণতন্ত্রের মৃত্যু নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন। তবে সমানভাবে লক্ষণীয় যে রিপাবলিকানদের অনেকেও এই একই শঙ্কা প্রকাশ করছে। কুইনিপিয়াক ইউনিভার্সিটির সা¤প্রতিক একটি জরিপ দেখা যায়, ৬৯ শতাংশ রিপাবলিকান মনে করেন যে গণতন্ত্র হুমকির মধ্যে রয়েছে। ঠিক একই অনুপাতে ডেমোক্র্যাটদের মধ্যেও।

 

লক্ষণীয় যে, রিপাবলিকানরা এর জন্য ট্রাম্পকে দায়ী করেন না। তারা হয় ট্রাম্পের মিথ্যার সাথে একমত যে ২০২০ নির্বাচনের ফলাফল মিথ্যা ছিল, অথবা তারা বলে যে ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে ‘উগ্র চরমপন্থা’ আমেরিকান মূল্যবোধকে ক্ষুণ্ন করছে। ভোটাররা এই ধারণা থেকে বিশ্বাস হারাচ্ছেন যে, বিভিন্ন মতামতকে বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনী উপায়ে বা নিয়মিত ফোরামে বিতর্কের মাধ্যমে মধ্যস্থতা করা যেতে পারে। ভুল তথ্য ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে কিছু ব্যক্তি মৌলবাদী হয়ে উঠছে। ন্যান্সি পেলোসির স্বামীর ওপর সাম্প্রতিক ভয়াবহ হামলা সামনে আরও সহিংসতার উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে।

 

যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ৮ নভেম্বর। নির্বাচনকে ঘিরে বিরাজ করছে চরম উত্তেজনা আর উৎকণ্ঠা। নির্বাচনের দিন ব্যাপক সহিংসতার আশঙ্কায় সারা দেশে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে সর্বোচ্চ সতর্কতায় থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ২৮ অক্টোবর স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির স্বামীর উপর সন্ত্রাসী হামলার পর পুলিশসহ সকল গোয়েন্দা বাহিনীর কাছে সরকারের ‘রেড এলার্ট’ নোটিস পাঠানো হয়। ওই বার্তায় সারা দেশে সহিংসতার ঘটনা মোকাবেলায় আগাম প্রস্তুতি এবং সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে নির্দেশ দেয়া হয়। সাধারণ ভোটাররাও উগ্রপন্থিদের সশস্ত্র সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কা করছে। অনেকে মনে করছেন নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প পরাজিত হবার পর গত বছর ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে হামলার পুনরাবৃত্তি হতে পারে।

 

সাম্প্রতিক রয়টার্স/ইপসোস জরিপ বলছে যে ৪০ শতাংশ ভোটার এখন নির্বাচনের সময় ভোটারদের ভয় দেখানোর বিষয়ে চিন্তিত। গত আগস্টে পিউ সমীক্ষায় দেখা গেছে যে ৭২ শতাংশ রিপাবলিকান ডেমোক্র্যাটদের অনৈতিক এবং অসৎ মানুষ হিসাবে দেখেন, যেটা ২০১৬ সালে ছিল ৪৭ শতাংশের মতো। প্রায় একই অবস্থা রিপাবলিকানদের ব্যাপারে ডেমোক্র্যাটদের মতামতেও। গত ৬ বছরে মার্কিন সমাজ ও রাজনীতিতে এমনি একটা নাটকীয় ‘পরিবর্তন’ ঘটে গেছে। এরই নাম বুঝি ‘গোত্রবাদ’। এর মানে কি তবে গণতন্ত্রের সম্ভাব্য পতন সম্পর্কে করা ভবিষ্যদ্বাণীগুলো সঠিক?

 

মনে হয় না। মূলত প্রথম থেকেই মেরুকরণ এবং রাজনৈতিক সহিংসতা আমেরিকান গণতন্ত্রের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল। সেসব কাটিয়ে উঠে যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতন্ত্র বরং আরো শক্ত ভিত্তি পেয়েছিল। কিন্তু নিরাপদে ভোটদানের বিষয়ে সারা বিশ্বের মডেল ছিল যে দেশ, সেই যুক্তরাষ্ট্রেই এখন নির্বাচনী সহিংসতার আশঙ্কায় ‘রেড এলার্ট’ জারি হয়েছে- সেটা মানতে কষ্ট হচ্ছে সাধারণ আমেরিকানদের।
[গত ৫ নভেম্বরের ফিনানসিয়াল টাইমস, ইউএস এডিশন থেকে অনূদিত]

 

পূর্বকোণ/আর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট