চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

ইউক্রেন যুদ্ধের বর্তমান অবস্থা

আফতাবুজ্জামান

৬ আগস্ট, ২০২২ | ৩:১০ পূর্বাহ্ণ

২০১৪ সালে পশ্চিমা মদদে অভ্যুত্থান করে রাশিয়ার সাথে বন্ধু ভাবাপন্ন নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। ইউক্রেনের কিছু অঞ্চলে রাশিয়া ভাষাভাষীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। তারা এই অভ্যুত্থান মেনে নেয়নি। এই অঞ্চলগুলো ছিল ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চল এবং পূর্বাঞ্চল থেকে কিছুটা দূরে দক্ষিণে ক্রাইমিয়া। বাংলাদেশে পটুয়াখালী যেমন কুমিল্লা, নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম থেকে কিছুটা দূরে। অভ্যুত্থানের পর রাশিয়া বিনা রক্তপাতে ক্রাইমিয়া দখল করে নেয় এবং পূর্বাঞ্চল (লুহানস্ক ও ডনেস্ক) স্বায়ত্তশাসন ঘোষণা করে। এরপর ইউক্রেনের সরকারি বাহিনী পূর্বাঞ্চলের অধিকাংশ এলাকা নিজেদের দখলে এনে কিয়েভের শাসন বজায় রাখে।
তারমানে, যুদ্ধের শুরুতে রাশিয়া ও রাশিয়া সমর্থিত বাহিনীর দখলে ছিল রাশিয়ার সীমান্ত ঘেঁষা পূর্বের অল্প কিছু এলাকা এবং রাশিয়ার সীমান্ত থেকে বিচ্ছিন্ন ক্রাইমিয়া। প্রথমে রাশিয়া উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্ব দিক থেকে একসাথে আক্রমণ করে। উত্তরে রাশিয়া বেশ কিছু এলাকা দখল করে কিয়েভের কাছে চলে আসে। পরে তারা এসব এলাকা থেকে সৈন্য সরিয়ে নেয়, তবে খার্খিভের আশেপাশের অংশ দখলে রাখে। দক্ষিণে রাশিয়ার সীমান্ত থেকে ক্রাইমিয়া পর্যন্ত এলাকা রাশিয়া দখল করে- এর ফলে রাশিয়ার সাথে ক্রাইমিয়ার সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হয়। ক্রাইমিয়া আর বিচ্ছিন্ন থাকে না। দখলকৃত এই এলাকাকে বলা হয় স্থল সেতু বা ল্যান্ড ব্রিজ। এখানে রাশিয়ার দখলকৃত একটা এলাকার নাম খার্সন।
বর্তমানে মূল যুদ্ধ হচ্ছে পূর্বে – লুহানস্ক ও ডনেস্কে। এই অঞ্চলে ছিল ৮ বছর ধরে গড়ে তোলা ইউক্রেনের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা। যেমন, শক্ত কনক্রিটের তৈরি শতশত বাংকার ও ট্রেঞ্চ। এখন পর্যন্ত যুদ্ধে সম্পূর্ণ লুহানস্ক এবং অধিকাংশ ডনেস্ক রাশিয়া দখল করে নিয়েছে। ডনেস্কের যে অংশ এখনো ইউক্রেনের দখলে আছে সেখানে ইউক্রেনের দুটো শক্তিশালী প্রতিরক্ষা লাইন বা ডিফেন্স লাইন আছে।
ধারণা করা হয়, এই মাস শেষ হওয়ার আগে রাশিয়া এই দুই লাইন ভেঙে দেবে। এরপর আর কোথাও ইউক্রেনের শক্ত প্রতিরক্ষা ব্যুহ নেই।

যুদ্ধে ধীর গতি কেন?
১. ইউক্রেনের শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। এমন প্রতিরক্ষার বিরুদ্ধে দুইভাবে আক্রমণ করা যায়। এক- তিন থেকে পাঁচ গুণ বেশি সৈন্য দিয়ে আক্রমণ করে দখলের চেষ্টা। (frontal assault)। এতে দুই পক্ষের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। দুই- দখলের আগে আর্টিলারির গোলা ও বিমান আক্রমণ করে প্রতিরক্ষা দুর্বল করা এবং তারপর দখলের চেষ্টা। এই কৌশলে কম সৈন্য নিয়ে আক্রমণ করা যায়। নিজেদের ক্ষয়ক্ষতি অনেক কম হয়। কিন্তু সময় বেশি লাগে। রাশিয়া এই দ্বিতীয় কৌশলে যুদ্ধ করছে। ২. রাশিয়া চাইছে সাধারণ মানুষের জানমালের ক্ষতি সীমিত রাখতে। তাই অনেক হিসাব নিকাশ করে আক্রমণ ও অগ্রসর হতে হচ্ছে।

বিজয়ের জন্য কিয়েভের উপর চাপ
কয়েকটা কারণে ইউক্রেনের একটা বিজয় দরকার। ১. পশ্চিমা প্রচার মাধ্যমে ইউক্রেন জিতেই চলেছে। কিন্তু আসল যুদ্ধক্ষেত্রে তারা হেরেই চলেছে। ছোটোখাটো কিছু এলাকা ইউক্রেন দখল করেছে এবং আবার হারিয়েছে। ২. সঠিক হিসাব পাওয়া কঠিন, কিন্তু অনেকের মতে ইউক্রেন এই পর্যন্ত ৭৫ হাজার সৈন্য হারিয়েছে আর হারিয়েছে সমরাস্ত্রের ৮০%। ৩. এসব কারণে ইউক্রেনের সৈন্যদের মনোবল ভেঙে পড়েছে। অনেকেই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাচ্ছে বা আত্মসমর্পণ করছে। ৪. মুদ্রাস্ফীতি ও অর্থনৈতিক সংকটের কারণে ইউরোপে যুদ্ধ প্রলম্বিত করার বিপক্ষে জনমত বাড়ছে। ৫. ইউক্রেনকে দেয়া আধুনিক অস্ত্র- যেমন হাইমার্স, যুদ্ধের ধারা পরিবর্তনে তেমন কোন ভূমিকা রাখেনি।
এই অবস্থায় বেশ কিছুদিন ধরে শোনা যাচ্ছে ইউক্রেন দক্ষিণে বড় ধরনের পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে খার্সন রাশিয়ার হাত থেকে মুক্ত করবে। ইউক্রেন এখানে তিনটা ব্রিজ ধংস করার চেষ্টা করছে হাইমার্স দিয়ে। যাতে করে নদীর পশ্চিম অঞ্চলের ১৫-২০ হাজার রাশিয়ান সৈন্য পূর্বের সৈন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ইউক্রেনের জেনারেলরা এই আক্রমণের বিরুদ্ধে। কারণ তারা জানে এই ফ্রন্টে রাশিয়ার বিরুদ্ধে জয়ের সামর্থ্য তাদের নেই। হাজার হাজার সৈন্য হারাবে মাত্র। কিন্তু একটা বিজয়ের জন্য কিয়েভের উপর আছে পশ্চিমা চাপ। একটা বিজয়- যা নিয়ে পশ্চিমা নেতৃত্ব ও প্রচারমাধ্যম মুখরিত হতে পারবে।

HIMARS বা হাইমার্স কী?
স্থল যুদ্ধে আক্রমণে পাঁচ ধরণের অস্ত্র/সরঞ্জাম ইউজ করা হয়।
Tank, Armored vehicle, Self-propelled artillery, Towed artillery এবং Mobile rocket projector। এরমধ্যে Towed artillery এবং Mobile rocket projector এর পার্থক্য হচ্ছে- প্রথমটায় কামানকে ট্রাক টাইপের গাড়ি দিয়ে টেনে নিতে হয় আর দ্বিতীয়টায় কামান নিজেই মুভ করতে পারে। টানতে হয় না। হাইমার্স হচ্ছে এক ধরনের Mobile rocket projector।
কোন কামান কতোটা শক্তিশালী তা নির্ভর করে মূলত তিনটা জিনিসের উপর। ১. গোলা কতো দূর যেতে পারে। ২. গোলার ধ্বংস ক্ষমতা কেমন। ৩. গোলা লক্ষ্যে কতোটা নিখুঁতভাবে আঘাত করতে পারে। হাইমার্সের মূল শক্তি তিন নম্বরে। এটা সবচেয়ে নিখুঁত কামানের একটি। ইউক্রেনকে দেওয়া হাইমার্স ৮০ কি.মি. দূরে আঘাত করতে পারে। এটার ধ্বংস ক্ষমতা কম। এ পর্যন্ত ইউক্রেনকে ১২টি হাইমার্স দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে ৬টি রাশিয়া ধ্বংস করেছে বলে দাবি করেছে। আমেরিকা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সব মিলিয়ে ৩০টি হাইমার্স দেওয়া হবে।
অন্যদিকে যুদ্ধের শুরুতে রাশিয়ার Mobile Rocket Projector এর সংখ্যা ছিল সবার চেয়ে বেশি ৩৩৯১টি। এরমধ্যে কয়েকশ’ কামান হাইমার্সের মতো নিখুঁত এবং হাইমার্সের চেয়ে অধিকতর ধ্বংসক্ষমতা সম্পন্ন। পশ্চিমা প্রচার মাধ্যম হাইমার্সকে গেম চেঞ্জার বলার চেষ্টা করছে। একথা সত্যি যে হাইমার্স রাশিয়ার কিছু ক্ষতি করছে যা ইউক্রেন আগে করতে পারেনি, কিন্তু তা গেম চেঞ্জ করার মতো নয়। গেম চেঞ্জ করার মতো কোনো অস্ত্র পশ্চিমাদের নেই।

রাশিয়ার সুবিধাজনক অবস্থানের কারণ
১. রাশিয়ার স্থলশক্তি অস্ত্রের সংখ্যা ও মানে বিশ্বে এক নম্বরে। এতো বড় দেশের প্রতিরক্ষার জন্য এটা তাদের করতে হয়েছে। ২. রাশিয়ার গোলাবারুদ উৎপাদন ক্ষমতা পশ্চিমের সম্মিলিত শক্তির চেয়ে বেশি। রাশিয়া এই উৎপাদন ক্রমাগত চালিয়ে যেতে সক্ষম। এর মানে রাশিয়া যে কৌশলে যুদ্ধ করছে এতে তাদের অস্ত্রের অভাব হবে না। ৩. রাশিয়ার হাতে এমন অস্ত্র আছে যা পশ্চিমাদের নেই। যেমন হাইপারসোনিক ক্ষেপনাস্ত্র। ৪. ক্ষেপনাস্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে রাশিয়া বিশ্বে এক নম্বরে। অল্প কিছু বাদে হাইমার্সের অধিকাংশ গোলা বা রকেট/মিসাইল তাই তারা আকাশেই ধ্বংস করে দিচ্ছে।
৫. স্থলবাহিনীকে প্রায়ই বিমানবাহিনী ও স্যাটেলাইটের সাহায্য নিয়ে যুদ্ধ করতে হয়। ইউক্রেনের বিমান শক্তির প্রায় পুরোটাই রাশিয়া ধ্বংস করে দিয়েছে। আর স্যাটেলাইটসহ সব ধরনের সিগন্যাল জ্যাম করার ক্ষেত্রে রাশিয়া এক নম্বরে। এই কারণে ইউক্রেনের স্থলবাহিনীর বিভিন্ন অংশের মধ্যে সমন্বয় কম এবং সিগন্যাল নির্ভর ড্রোন দিয়ে ইউক্রেন তেমন সুবিধা করতে পারছে না। ৬. আগেই বলেছি ইউক্রেনের অস্ত্রের অন্তত ৮০% রাশিয়া ইতোমধ্যে ধ্বংস করে দিয়েছে। পশ্চিমারা চেষ্টা করছে নতুন অস্ত্র দিয়ে এই ক্ষতিপূরণের। কিন্তু হিসাবটা হচ্ছে, পশ্চিমাদের দেওয়ার মতো অস্ত্র ফুরিয়ে যাবে কয়েক মাসে, কিন্তু রাশিয়ার শেষ হবে না।
৭. সম্প্রতি ইউক্রেন সেনাবাহিনীতে যোগদানের বয়স সীমা বাড়িয়ে ৭০ করেছে। যুদ্ধ করার মতো জনবল তাদের ক্রমেই শেষ হয়ে আসছে। ৮. ক্ষয়ক্ষতি কম রেখে এবং সুবিধাজনক অবস্থানে থেকে ক্রমাগত জয়ের কারণে রাশিয়ার সৈন্যদের মনোবল অনেক বেশি। ৯. পশ্চিমাদের মতে রাশিয়া তার শক্তির শুধু ১০%-২০% ইউজ করেছে এই পর্যন্ত। প্রয়োজনে বড় ধরনের আক্রমণ তারা করতে পারে। অনেকের মতে রাশিয়া এই মাসে তা করতে পারে। এখানে বলা দরকার যে ইউক্রেনের চেয়ে কম সংখ্যক সৈন্য নিয়ে রাশিয়া এই পর্যন্ত যুদ্ধ করেছে।

এখনো যুদ্ধ চলছে কেন?
১. ইউক্রেনের জনগোষ্ঠীকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। রাশিয়াপন্থী, নিরপেক্ষ ও রাশিয়া বিরোধী। রাশিয়া বিরোধী শক্তি যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চায়। কিন্তু পশ্চিমা সমর্থন ছাড়া ইউক্রেনের যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য ছিলো না। তারা এতদিনে রাশিয়ার সাথে সমঝোতা করতো। ২. পশ্চিমা শক্তি প্রথমে ভেবেছিল অর্থনৈতিক অবরোধে রাশিয়ার অর্থব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। এর ফলে পুতিন ক্ষমতাচ্যুত হবেন এবং রাশিয়া যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার শক্তি হারাবে। পরে অবশ্য তারা বুঝতে পারে এসবের কিছুই হবে না। কিন্তু তাও তারা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
৩. পশ্চিমাদের বর্তমান লক্ষ্য যুদ্ধ চালিয়ে রাশিয়াকে যথাসম্ভব দুর্বল করা। ৪. আমেরিকার অস্ত্র ব্যবসায়ীদের মুনাফা। ৫. প্রোপাগা-া চালিয়ে পশ্চিমারা নিজেদের এমন অবস্থায় নিয়েছে যে রাশিয়ার সাথে সম্মানজনক সমঝোতা করার অবস্থায় তারা আর নেই। যে কোন সমঝোতা তাদের জন্য পরাজয় হবে। ৬. ইউক্রেনের সৈন্য ও সাধারণ মানুষ যতো বেশি নিহত ও আহত হবে, ইউক্রেন যতো বেশি ধ্বংস হবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে জনমত ততো বাড়বে। এর ফলে যুদ্ধ শেষে অধিকৃত এলাকা রাশিয়ার পক্ষে শাসন করা কঠিন হবে।

শেষ কথা
যুদ্ধে রাশিয়া অবশ্যই জিতবে এবং খুব সম্ভবত শীতের আগেই রাশিয়া তার লক্ষ্য পূরণ করবে। শেষ পর্যন্ত রাশিয়া ইউক্রেনের কতোটুকু দখল করে সেটা বলা কঠিন। তবে এটা নিশ্চিত তা হবে রাশিয়ার প্রাথমিক লক্ষ্য লুহানস্ক, ডনেস্ক ও ক্রাইমিয়ার ল্যান্ড ব্রিজের চেয়ে অনেক বেশি। খার্সনের পশ্চিমে নিকোলায়েভ ও ওডেসা রাশিয়া দখল করবে এটা প্রায় নিশ্চিত।

দৈনিক পূর্বকোণের নিয়মিত লেখক।

শেয়ার করুন