চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

বাসযোগ্য পৃথিবী গড়তেই হবে

ডা. আফতাবুজ্জামান

২৪ জানুয়ারি, ২০২২ | ৪:২৭ পূর্বাহ্ণ

আমরা সবাই গ্রিনহাউস দেখেছি। গ্রিনহাউসে সূর্যের যেটুকু তাপ ঢুকে তার সবটুকু বের হয়ে যেতে পারে না। এই কারণে গ্রিনহাউস চারপাশের চেয়ে উষ্ণ থাকে। আমাদের পৃথিবী ঘিরেও আছে গ্রিনহাউসের মতো আবরণ। এই আবরণের কারণে পৃথিবীতে আসা সূর্যের সব তাপ পৃথিবীর পরিমন্ডল ছেড়ে যেতে পারে না। এই আবরণের চারটা প্রধান উপাদান হলো- কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড, জলীয় বাষ্প। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, কার্বন ডাইঅক্সাইড। পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিজ্ঞানীরা মনে করেন যদি কার্বন ডাইঅক্সাইড না থাকতো তবে পৃথিবী ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস ঠান্ডা হতো। পৃথিবীজুড়ে থাকতো শুধু বরফ আর বরফ। অতএব পৃথিবী ঘিরে গ্রিনহাউসের মতো আবরণ থাকাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীতে প্রাকৃতিক কারণে কার্বন ডাইঅক্সাইড তৈরি হয়। এর বড় একটা অংশ গাছ শোষণ করে। এর ফলে প্রকৃতিতে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ তেমন কমবেশি হয় না। কিন্তু এমন যদি হয় যে প্রাকৃতিক উৎসের বাইরেও মানুষ অতিরিক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড বানাতে থাকে বা অধিক হারে গাছ কাটতে থাকে কিংবা দুটোই করে? এর ফলে যেটা হবে, তাহলো- কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাবে। মানে গ্রিনহাউসের আবরণের ঘনত্ব বেড়ে যাবে। এর প্রভাবে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাবে। ঠিক এই ব্যাপারটাই ঘটছে দেড়শ বছর ধরে, শিল্প বিপ্লবের শুরু থেকে। এই প্রক্রিয়া তরান্বিত হয়েছে কয়েক দশক ধরে।

 

আমরা কিভাবে অতিরিক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড বানাই?
মূলত ফসিল ফুয়েল ব্যবহার করে। ফসিল ফুয়েল বলতে আমরা তিনটা জিনিস বুঝি। তা হলো- কয়লা, পেট্রোল জাতীয় পদার্থ, প্রাকৃতিক গ্যাস। তিনটি প্রধান কাজে আমরা ফসিল ফুয়েল ব্যবহার করি। আর তা হচ্ছে- বিদ্যুৎ উৎপাদন, পরিবহণ, শিল্প বা ইন্ডাস্ট্রি।
পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে গেলে সমস্যা কী?
১। অনেক অনেক বরফ গলে যাবে। বরফগলা পানি সাগরে এসে জমা হবে।
২। সাগরের পানি উষ্ণ হবে, ফলে আয়তনে বাড়বে।
৩। ১ ও ২ নম্বর কারণে সাগরের উচ্চতা বাড়বে। বেশকিছু দ্বীপ ও উপকূলবর্তী এলাকা পানির নিচে তলিয়ে যাবে। যেমন চীনের সাংহাই ও বাংলাদেশের উপকূলবর্তী এলাকা। ধারণা করা হয় বাংলাদেশে প্রায় দুই কোটি মানুষকে ঘরবাড়ি ছেড়ে উঁচু এলাকায় যেতে হবে।
৪। অনেক শুষ্ক এলাকা আরো শুষ্ক হয়ে মরুভূমিতে পরিণত হবে।
৫। পৃথিবীর কিছু অঞ্চলের তাপমাত্রা এতো বাড়বে যে সেসব বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে যাবে। যেমন সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক অঞ্চল। মুসলমানদের জন্য হজ করা অসম্ভব বা খুব কঠিন হয়ে যেতে পারে। আমাদের ঢাকাও এই অবস্থার বাইরে নয়।
৬। ৩, ৪ ও ৫ নম্বর কারণে লক্ষ কোটি মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে শরণার্থী হবে। এর ফলে বিশ্বজুড়ে সৃষ্টি হবে চরম সংকট। ভেঙ্গে পড়বে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থ ব্যবস্থা। হানাহানি বাড়বে, বাড়বে যুদ্ধ। অনেক মানুষের মৃত্যু হবে।
৭। সাইক্লোন, হারিকেন ইত্যাদির সংখ্যা ও ভয়াবহতা অনেক বাড়বে। অন্যদিকে কোন কোন অঞ্চলে ঠা-া, তুষার ঝড় ইত্যাদি বেড়ে যাবে।
৮। অনেক প্রাণী পৃথিবী থেকে চিরতরে হারিয়ে যাবে।
৯। খাদ্য উৎপাদন ও বিশুদ্ধ পানি কমে যাবে। অনাহার, দুর্ভিক্ষ বেড়ে যাবে।
১০। কোভিডের মতো বা তারচেয়ে ভয়াবহ মহামারীর আশংকা বাড়বে।
১১। এই তালিকা অনেক লম্বা। সংক্ষেপে, মানব সভ্যতার ইতিহাসে এতো বড় চ্যালেঞ্জ আর আসেনি। কেউ রক্ষা পাবে না এর ছোবল থেকে।
যদি আমরা কার্বন ডাই অক্সাইড বানানো বন্ধ না করি, মানে ফসিল ফুয়েল ব্যবহার বন্ধ না করি, তবে উপরের সবকিছু ঘটবে আগামী ৩০-৪০ বছরের মধ্যে।
উপরের চিত্র ভয়াবহ। তারচেয়ে ভয়াবহ হল, অধিকাংশ মানুষ এসব জানেন না এবং জানলেও তেমন কিছু করে না। রাজনীতিকরা চার বছর পর নির্বাচনে কী হবে তা নিয়ে ভাবেন। ব্যবসায়ীরা ভাবেন লাভের কথা। বিজ্ঞানীরা এবং অল্প কিছু মানুষ এটা নিয়ে কথা বলছেন।

 

আমরা কী করতে পারি ?
জনসংখ্যা অনুপাতে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের ভূমিকা খুবই কম। তবুও কিছু কাজ আমরা ব্যক্তিগতভাবে করতে পারি।
১। গাছ কাটা বন্ধ করতে পারি এবং গাছ লাগাতে পারি। গাছ লাগানোতে উৎসাহ দিতে পারি। গাছ কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে, তাপমাত্রা কমাতে সাহায্য করে।
২। লাইট, ফ্যান, এসি ইত্যাদি দরকার না হলে অফ করে দিতে পারি। মনে রাখতে হবে বিদ্যুৎ তৈরির কাজে সবচেয়ে বেশি ফসিল ফুয়েল ব্যবহার করা হয়।
৩। পানির অপচয় বন্ধ করতে পারি। আমরা প্রায় সবাই বুঝে না বুঝে অনেক পানি নষ্ট করি। সাধারণত মুখ ধোয়া বা অজু করার সময় মাঝে মাঝে কল অফ করে দিলে পানি অনেক কম খরচ হবে। বাসায় সহজেই পানির ব্যবহার অনেক কমানো যায়। পানির কথা বলছি এই কারণে যে পানির পিছনে বিদ্যুৎ/ফসিল ফুয়েল খরচ হয়।
৪। আমরা যা কিছু ব্যবহার করি প্রায় সবকিছুর পিছনে আছে বিদ্যুৎ বা ফসিল ফুয়েল। যেমন- জামা কাপড়, সেলফোন, খাতা- কলম, কাগজ, এমনকি খাবার দাবার। আমরা অতিরিক্ত শার্ট, প্যান্ট, শাড়ি, সেলফোন, বাচ্চাদের খেলনা না কিনলেও পারি। আমাদের অপচয় পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়াতে ভূমিকা রাখে।
৫। যতোটা সম্ভব দুই পা, সাইকেল, রিকশা ইত্যাদি ব্যবহার করতে পারি গাড়ি বা অন্য ফসিল ফুয়েল চালিত যানের বদলে।
৬। স্থানীয় পণ্য কিনতে পারি যতোটা সম্ভব। পণ্য পরিবহনে প্রচুর ফসিল ফুয়েল ব্যবহার করা হয়।
৭। আমরা বাসা-বাড়ি, অফিস বিল্ডিং, মসজিদ মন্দির ইত্যাদি পরিবেশ বান্ধব করতে পারি।
৮। সচেতন করতে পারি সবাইকে।

ফসিল ফুয়েল আমাদের জীবনের অংশ। বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন ফসিল ফুয়েল বাদ দিয়ে অন্য উপায়ে সভ্যতা এগিয়ে নেয়ার। আমাদের চেষ্টার উপর নির্ভর করছে আমাদের সন্তানরা এবং তাদের সন্তানরা একটা বাসযোগ্য পৃথিবী পাবে কিনা। আমাদের একার চেষ্টায় যদি কিছু নাও হয় আমরা আমাদের বিবেককে বলতে পারবো, চেষ্টা করেছি আপনজনের জন্য, অনাগত আপনজনের জন্য, সব মানুষের জন্য, সব প্রাণীর জন্য।

লেখক : নিউজিল্যান্ড প্রবাসী চিকিৎসক

শেয়ার করুন