চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

‘পারসিভারেন্স রোভার’-এর সফল অবতরণ মঙ্গলগ্রহে

সেভেন মিনিটস অব টেরর

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ | ৩:২৬ পূর্বাহ্ণ

প্রায় ৩০ কোটি মাইল পথ পাড়ি দিয়ে সাত মাসের মতো ভ্রমণ শেষে শেষ পর্যন্ত মঙ্গলের বায়ুম-লে সফলভাবে অবতরণ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় মহাকাশ সংস্থা নাসার মার্স রোভার ‘পারসিভারেন্স’, সাথে মিনি কপ্টার ‘ইনজেনুইটি’। এরই সাথে শেষ হলো নাসার বিজ্ঞানীদের রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষার পালা। তাদের সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তটা এলো বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) দিবাগত রাত ২টা ৫৫ মিনিটে। সঙ্গে সঙ্গে লস এঞ্জেলেসের জেট প্রপালসন ল্যাবরেটরিতে (জেপিএল) বিজ্ঞানীরা উল্লাসে মেতে ওঠেন।

এটির অবতরণের শেষ সময়টিকে ‘সেভেন মিনিটস অব টেরর’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন বিজ্ঞানীরা। কেননা অবতরণের সময় গতি নিয়ন্ত্রণ দারুণ জটিল এক কাজ। শেষ সময়ের এই গতি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে দ্রুত বেগে আছড়ে পড়ার কারণে এসব যান ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। তাই এই সময়টিকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। নাসার গত ১৪টি উদ্যোগের ৬টি-ই ঠিক এ কারণেই ভেস্তে গিয়েছিল।

বিজ্ঞানীদের আতঙ্ক ছিল, মঙ্গলের মাটিতে প্রচ- গতিতে আছড়ে পড়ার সময়ে ছয় চাকার যে যানটি আছে এর যাতে কোনো ক্ষতি না হয়, এজন্য যানটিকে একটি ক্যাপসুলের মধ্যে ঢুকিয়ে মঙ্গলযানের সঙ্গে পাঠানো হয়েছিল। শেষ ৭ মিনিটের মধ্যে ওই যানসহ ক্যাপসুলটি ধীরে ধীরে আছড়ে পড়ে এক জায়গায় থেমে যাওয়ার কথা। এই ঘটনাটাই ঠিকভাবে হবে কি-না, এই নিয়ে উদ্বেগ ছিলেন বিজ্ঞানীদের।

এখন ল্যান্ডিং হয়ে যাওয়ার পরে প্রাথমিকভাবে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, কোনো ক্ষতি হয়নি পারসিভারেন্সের। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, খুব শিগগিরই এটি মঙ্গলের মাটিতে অভিযানও শুরু করবে। ছয় চাকার ওই অনুসন্ধানযান মঙ্গলপৃষ্ঠের ছবি তুলবে, মাটির প্রকৃতি বিশ্লেষণ করবে এবং সেই সব ছবি ও তথ্য পাঠাতে থাকবে।

নাসার জেট প্রপালসন ল্যাবরেটরির পরিচালক মাইক ওয়াটকিনস পারসেভারেন্স টিমের এই সাফল্যকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘এই সাফল্য ভবিষ্যতে লাল গ্রহে (মঙ্গলে) মানুষের যাত্রার পথ তৈরি করবে।’ তিনি বলেন, ‘মঙ্গলে নভোচারী পাঠানোর জন্য আমরা এখনও প্রস্তুত নই, তবে আমরা রোবট পাঠিয়েছি।’

নাসা জানিয়েছে, প্রায় ২০ হাজার কিলোমিটার বেগে মঙ্গলের কক্ষপথে ঢুকে পড়ে রোভার পারসিভারেন্স। এরপর একটি বিশাল প্যারাশুটের সাহায্যে তার গতিবেগ কমিয়ে তিন কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায় নামিয়ে আনা হয়। মঙ্গলের মাটি ছোঁয়ার সময় ব্যবহার করা হয় এক অতিকায় ক্রেন। তার সাহায্যেই রোভারের মাটি ছোঁয় রোভারের চাকা। যে প্যারাশুটের সাহায্যে রোভারের গতিবেগ কমানো হয়েছে, তাও ঐতিহাসিক। এর আগে এত বড় প্যারাশুট মহাকাশে ব্যবহার করা হয়নি। মঙ্গলের উত্তরে জেজেরো ক্রেটারে অবতরণ করেছে রোভার পারসিভারেন্স। ঠিক এ জায়গাটিতেই রোভার পারসিভারেন্সকে ল্যান্ড করাতে চেয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। তারা সফল হয়েছেন। তবে আমেরিকার ‘রোভার কিউরিওসিটি’ (২০১১’র ২৬ নভেম্বর লঞ্চ হয়ে ২০১২’র ৬ আগস্ট মঙ্গলে ল্যান্ড করে) এই অঞ্চলের ছবি আগেই পাঠিয়েছিল নাসাকে। তবে রোভার পারসিভারেন্স এই অঞ্চলে আরো অনেক বেশি কাজ করবে। এই মুহূর্তে রোভারের থেকে কিউরিওসিটির দূরত্ব প্রায় তিন হাজার ৭০০ কিলোমিটার। ‘গেল ক্রেটারে’ অবস্থান করছে মার্কিন মহাকাশযানটি। নাসা জানিয়েছে, শুধু ভূপৃষ্ঠের উপরে নয়, ভূপৃষ্ঠের তলার উপাদানও সংগ্রহ করবে পারসিভারেন্স। এই যানটির মূল কাজ হবে মঙ্গলে পানির সন্ধান করা এবং প্রাণের খোঁজ চালানো।

মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থাটি এর আগেও সোজৌনোর, স্পিরিট, অপারচুনিটি এবং কিউরিওসিটি নামক রোভারগুলিকে লাল গ্রহের মাটিতে সফল ভাবে নামিয়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। পূর্বের এই সাফল্যেতেই থেমে না থেকে প্রতিবেশী গ্রহকে আরও পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের তাগিদে ২০২০ সালে নাসা লঞ্চ করে ‘মার্স ২০২০ মিশন’। যা অতীতের অভিযানগুলির তুলনায় অনেকটাই আলাদা। ২৩০০ পাউ- ওজন বিশিষ্ট এই রোভারটির পাশাপাশি ‘ইনজেনিউটি’ নামক একটি হেলিকাপ্টারও পাঠানো হয়েছে এই মিশনের মাধ্যমে। মঙ্গলের মাটিতে রোভারের বিচরণ করানোর সাথে সাথে এবার আকাশ পথে হেলিকাপ্টার উড়িয়ে গবেষণা চালাবেন বিজ্ঞানীরা।

২০২০ সালের ৩০ জুলাই আমেরিকার কেপ ক্যানাভেরাল স্পেস সেন্টার থেকে অ্যাটলাস ৫ রকেটে চেপে সফলভাবে মঙ্গলগ্রহের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছিল ‘পারসিভারেন্স’ রোভার। ১৯৩০০ কিমি/ঘণ্টা বেগে প্রায় ৩০ কোটি মাইল পথ পাড়ি দিয়ে মঙ্গলের কক্ষপথে পৌছাতে সময় লেগেছে প্রায় সাত মাস।

কক্ষপথ থকে মাত্র সাত মিনিটে নিজের গতিকে কমিয়ে মঙ্গলের মাটিতে নেমেছে রোভারটি। সেক্ষেত্রে একাধিক ধাপ অনুসরন করে নিজে নিজেই ল্যান্ডিং প্রক্রিয়া চালাতে হয়েছে এটাকে। কেননা এ ৭ মিনিট সময়কালে যন্ত্রযানটি বিজ্ঞানীদের ঠিক নিয়ন্ত্রণে থাকেনা। রোভারটিতে বিজ্ঞানীদের ‘ঠিক এ সময়ের’ কাজের ‘প্রোগ্রামিং’ দারুণভাবে সফল হয়েছে। তাই মাটিতে ল্যান্ড করার কিছু সময় পরেই প্রথম সিগন্যাল পাঠিয়ে তাদের উদ্বেগ দূর করতে দেরি করেনি ‘পারসিভারেন্স’।

এর আগে এত উন্নত যন্ত্রপাতি নিয়ে কোন গ্রহে বৈজ্ঞানিক মিশন পাঠানো হয়নি এবং এত সম্ভাবনাময় একটা স্থানকে টার্গেট করে কোন রোবটও এর আগে কখনও নামানো হয়নি। রোবটের মঙ্গলপৃষ্ঠ স্পর্শ করার সেই স্থানটি- জেযেরো ক্রেটার-এর স্থানটিতে একসময় বিশাল একটি হ্রদ থাকার লক্ষণ উপগ্রহে পাওয়া ছবি থেকে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেছেন। তাদের ধারণা এই হ্রদটিতে প্রচুর পানি ছিল এবং সম্ভবত সেখানে জীবনও ছিল।

পারসিভেয়ারেন্স এই জেযেরো গহ্বরের ধুলাবালুর মধ্যে থেকে নমুনা সংগ্রহ করবে, যা বিশ্লেষণ করে দেখা হবে গ্রহটিতে অতীতে জৈব কোন কর্মকা-ের হদিস ছিল কিনা। সবচেয়ে লক্ষণযুক্ত ও সম্ভাবনাময় নমুনা পৃথিবীতে পাঠানো হবে ভবিষ্যত মিশনের প্রস্তুতির জন্য। ২০৩০ সাল নাগাদ সংগৃহীত নমুনাদি পৃথিবীতে পাঠানোর কথা ‘পারসিভারেন্স’র।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট