চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

সংবাদ ভাষ্য

মার্কিন নির্বাচনেও অস্থিরতার আভাস!

ডা. ম. রমিজউদ্দিন চৌধুরী

৩ নভেম্বর, ২০২০ | ৮:৩১ পূর্বাহ্ণ

স্বপ্নের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এমন স্বপ্নভঙ্গের ঘটনার ঘোর আলামত দেখে সবাই শঙ্কিত। দরিদ্র, অনগ্রসর দেশগুলোর চিত্রই যেন ফুটে উঠেছে দেশজুড়ে নেয়া নজিরবিহীন নিরাপত্তাব্যবস্থা দেখে। নির্বাচনের দিন ও নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে সহিংসতা ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে। নিউইয়র্কসহ অন্যান্য শহরের ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রগুলোতে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সহিংসতা ছড়িয়ে পড়লে সেনাও মোতায়েন করা হতে পারে। সেজন্যে প্রস্তুত রাখা হয়েছে তাদের।
আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর এতসব প্রস্তুতির কারণ হল, শুক্রবার (৩০ অক্টোবর) টেক্সাসে জো বাইডেনের প্রচারাভিযানের একটি বাসকে ট্রাম্প সমর্থকরা রাস্তায় আটকে দেবার চেষ্টা করে। অন্যদিকে, এ ঘটনার একদিন পর রবিবার (১ নভেম্বর) ট্রাম্প সমর্থকরা শত শত গাড়ি নিয়ে নিউইয়র্ক থেকে নিউ জার্সিতে যাওয়ার সময় একটি ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে বেশ কিছু সময় বাইডেন সমর্থকদের রাস্তায় অবরোধ করে রাখে।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম ইউএস টুডে এবং সাফোক ইউনিভার্সিটির যৌথভাবে চালানো অতি সাম্প্রতিক এই জরিপে এই তথ্য উঠে এসেছে যে- নির্বাচনের পর সহিংসতা ছড়িয়ে পড়তে পারে। জরিপের ফলাফল অনুযায়ী, দেশটির প্রতি চারজনের মধ্যে তিনজনই মনে করছেন, নির্বাচনের পর সহিংসতা ছড়িয়ে পড়বে। আর প্রতি চারজনের মধ্যে একজন বেশ আস্থার সঙ্গেই বলেছেন, নির্বাচনের পর শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হবে। তারা বলছেন, ডেমোক্রেট প্রার্থী জো বাইডেনের কাছে হেরে গেলেও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শান্তিপূর্ণভাবে ট্রাম্প ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন। জরিপের ফলাফলে আরো বলা হয়, মার্কিন নির্বাচনে চূড়ান্ত বিজয়ীকে নির্বাচন পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। অনেকেই আবার সামরিক ক্যু’র আশংকাও করছেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্প নানা সময়ে বেশ ক’বারই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বলেছেন যে, তিনি নির্বাচনে হেরে গেলে ক্ষমতা ছাড়বেন না। বস্তুত এ বক্তব্যে রিপাবলিকান সমর্থকরা দারুণভাবে প্রভাবিত হয়েছেন দেখা গেছে তার সমাবেশগুলোয়। উস্কানিমূলক শ্লোগানে প্রায়ই মুখর ছিল তারা।
এমন অবস্থায় গুরুতর শঙ্কা রয়েছে এ সময়ের মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে নাগরিক অস্থিরতা। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দুই পক্ষ থেকেই নিজেকে বিজয়ী দাবি করে বসার হুমকিও রয়েছে। ভুল তথ্যে সয়লাব হয়ে উঠতে পারে সামাজিক মাধ্যম। এমনকি ভুল তথ্যের মাসুল গুণতে হতে পারে মার্কিন নাগরিকদের প্রাণ হারানোর মধ্য দিয়ে। সমস্যা সমাধানে কিছু সময়ের জন্য বন্ধ করে দেওয়া যেতে পারে সামাজিক মাধ্যমের সেবা। কিন্তু সেটির শেষ পরিণতিও ভালো ফলাফল বয়ে আনবে কি না, তা নিয়ে রয়েছে সন্দেহ। বিবিসি এক নিবন্ধে জানিয়েছে, হট্টগোল সামাল দিতে এরই মধ্যে প্রস্তুতি নিয়েছে সামাজিক মাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো।
এবারের নির্বাচনে লক্ষ্যনীয় যে, ডোনাল্ড ট্রাম্প আর জো বাইডেনের ব্যাপারে ইতোমধ্যেই দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে দেশটি। ঠিক এ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে শতবছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্য সমস্যা। এর বাইরে গিয়ে দেশটি বর্ণবৈষম্য আর পুলিশি বর্বরতার বিরুদ্ধে রীতিমতো উত্তপ্ত হয়ে আছে। ‘ব্ল্যাক লাইফ ম্যাটারস’ আন্দোলন এখনো সজীব। এ আগুনে কেবল ‘ঘি’ ঢালাটাই বাকি। আর এ চেষ্টাটির কোনও কসুর ছাড়ছেন না ট্রাম্প। জয়ের স্বপ বাস্তবায়নে নিরন্তর নানা কৌশল অবলম্বন করে চলেছেন তিনি। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় কৌশল প্রতিপক্ষের প্রতি দায় চাপানো। নিউজ উইকের খবরে বলা হয়েছে নির্বাচনে জালিয়াতি হবে বলে বার বারই দাবি করে আসছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। একই সঙ্গে তিনি নির্বাচনের ফলাফল মানবেন না বলেও জানিয়ে দিয়েছেন। এমনকি চূড়ান্ত ফল সুপ্রিম কোর্ট থেকেই আসবে বলেও দাবি তার। বিষয়টা নিয়ে ভোটের আগেই নানা হিসাব নিকাষ শুরু হয়ে গেছে ভোটাররা।
প্রায় সবগুলো সংবাদমাধ্যমেই এ ব্যাপারটিকে ‘সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগ’ নাটকের সাথে সম্পর্কিত বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ নাটক শুরু হয়েছিল মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের জনপ্রিয় ও প্রগতিশীলতার প্রতিভূ বিচারপতি রুথ বেডার গিন্সবার্গের মৃত্যুর কারণে সৃষ্ট শূন্য পদে নিয়োগ নিয়ে। এর প্রভাব রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে সেটা সকলেই বলছেন। ইতিমধ্যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ফেডারেল আপিল কোর্টের বিচারক চরম রক্ষণশীল এমি ক্লোনি ব্যারেটকে মনোনয়ন দিয়ে সিনেটে রিপাবলিকানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে তার নিয়োগ নিশ্চিত করতে পেরেছেন। তাই ধারণা করা হচ্ছে, ব্যারেটকে নিয়োগ দিতে পারায়, নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে বিরোধ যদি সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়, তাহলে আদালতের রায় তাঁর পক্ষে যাবে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে। বস্তুত এ নিয়োগ এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে, বিপর্যস্ত মার্কিন অর্থনীতিকে চাঙা করার জন্য জরুরি প্রণোদনা প্যাকেজ নিয়ে ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে আলোচনা বাতিল করে ৩ নভেম্বরের আগে ব্যারেটের নিয়োগ নিশ্চিত করার ওপর ট্রাম্প অগ্রাধিকার দিয়ে আসছিলেন।
বিচারক নিয়োগের বিষয়টি আরেকটি কারণেও গুরুত্ব পেয়ে এসেছে। মিশিগান অঙ্গরাজ্যকে ‘লিবারেট’ করার ট্রাম্পের উস্কানির কারণে মিশিগানের ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে নির্বাচিত গভর্নরকে অপহরণ করার অভিযোগে তাঁর শ্বেতাঙ্গ উগ্রবাদী অনুসারীদের ১৩ জন সম্প্রতি গ্রেপ্তার হয়েছে। ভোটে হেরে গেলে জালিয়াতির এবং তাঁর সমর্থকদের হয়রানির অভিযোগ তুলে তিনি সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ব্যাটল গ্রাউন্ডের ছয়টি অঙ্গরাজ্যের আইনসভাকে (যেগুলোতে রিপাবলিকান পার্টি বর্তমানে সংখ্যাগরিষ্ঠ) তাঁর সমর্থকদের মধ্য থেকে ইলেকটরাল কলেজের সদস্যদের মনোনীত করতে এবং তাদের প্রেসিডেন্ট পদে ভোট প্রদানের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা প্রদানের অনুরোধ করতে পারেন।
আরেকটি ব্যাপারও এখানে লক্ষ্যণীয়- এবারই প্রথম যে, যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট আগাম অভিযোগ জানিয়েছেন। এটিকেও দারুণ উস্কানিমূলক বলেছে সংবাদমাধ্যমগুলো। তারপর থেকেই প্রথমবারের মতো এবারই কোনো নির্বাচনের ফলাফল জানার আগে ওয়াশিংটন ডিসি থেকে শুরু করে বড় বড় নগরীতে বিক্ষোভ-সহিংসতার আশঙ্কা করা হচ্ছে। আর এই আশঙ্কায় নির্বাচনের আগে এবারই প্রথম বড় বড় নগরীর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা থেকে প্রতিষ্ঠানকে রক্ষার জন্য কাঠের বেষ্টনী বসিয়েছে।
দেখা দিয়েছে নজিরবিহীন সহিংসতা, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও লুটপাটের আশঙ্কা। ইতোমধ্যে কয়েকটি শহরে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সমর্থক ও বিরোধীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ভোটের দিন ও পরবর্তী দিনগুলোয় জ্বালাও-পোড়াও ও ভাঙচুরের ভয়ে ঘরবাড়ি ছাড়ছে সাধারণ মার্কিনিরা। ওয়ালমার্ট’র মতো স্টোরগুলো থেকে আগ্নেয়াস্ত্র সরিয়ে নেয়া হয়েছে। অথচ দু’দিন আগে পর্যন্ত আগ্নেয়াস্ত্র বিক্রির বর্ধিত হার পৌঁছে গিয়েছিল ৭৫ শতাংশে। এএফপি জানিয়েছে, বিশেষ করে হোয়াইট হাউস ও এর আশপাশের এলাকাগুলোতে সহিংসতা ও ভাংচুর থেকে নিজেদের সম্পদ সুরক্ষার জন্য এখনো দিনরাত কাজ করছেন ব্যবসায়ীরা।
আমরা দেখেছি, প্রতিপক্ষের পোস্টার ছেঁড়া, বিকৃত করা, চুরি করা স্বল্পোন্নত কিংবা অনগ্রসর দেশের নির্বাচনী সংস্কৃতি। রাতের অন্ধকারে ঘটে যাওয়া এসব কুকীর্তি দমনের জন্য প্রার্থীদের প্রস্তুতি থাকে, পাহারাদার থাকে। মজার বিষয় হচ্ছে, এবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রচার-প্রচারণায়ও পোস্টার রাজনীতি দারুণভাবে স্থান করে নিয়েছে। কোটি কোটি পোস্টার ছেঁড়া হয়েছে। কালি দিয়ে বিকৃত করা হয়েছে। এ কাজ যেমন করেছে রিপাবলিকান সমর্থকরা, তেমনি থেমে ছিল না ডেমোক্র্যাটরাও। যেন পাল্লা দিয়ে পোস্টার নষ্টের উৎসব চলেছে। বিষয়টি নিয়ে বহু সমর্থকই পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছেন। কিন্তু কাজ হয়নি। পুলিশ অভিযোগ গ্রহণ করে, কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে নির্বাচনের এই ভরা মৌসুমে পোস্টার ছেঁড়ার দায়ে কোনো দলের সমর্থককে আটক করে পক্ষপাতদুষ্টতার দায় নিতে তারা চাচ্ছে না।
বহু জাতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র। যাকে বলা হয় ল্যান্ড অফ ড্রিমস, অপরচুনিটি, অর্থাৎ যেখানে গেলে সকল স্বপ্ন পূরণ হয় বলেই ধারণা। যে স্বপ্নে বিভোর হয়ে সারা পৃথিবী থেকে মানুষ সেখানে ছোটেন। মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের প্রশ্নে যে দেশটি পুরো বিশ্বকে প্রতিনিয়ত তিরস্কার করে সেখানকার রাজনীতির এমন বহিঃপ্রকাশ দেশটির সমাজ সম্পর্কে কি মনোভাব তৈরি করে? এমন অবস্থা হবে স্বপ্নের দেশটির ক’দিন আগেও কী কেউ কল্পনা করেছিল?

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট