চট্টগ্রাম বুধবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৪

আইটি প্রশিক্ষণে পিছিয়ে নেই চট্টগ্রাম

১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ | ৩:৪৮ অপরাহ্ণ

আনিছ আহমদ

 

বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে চট্টগ্রামের গুরুত্ব বরাবরই অনেক বেশি। দেশের অন্যান্য জেলার চেয়ে বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণে চট্টগ্রাম সব সময়ই অন্যান্য জেলার চেয়ে আলাদা। কিন্তু এই আধুনিক যুগে সারা বিশ্বে যেখানে তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে পড়েছে সেখানে বাংদেশের তথা চট্টগ্রামের অবস্থান কোথায় সেটি ভাবার সময় এসেছে। তবে অত্যন্ত আনন্দের বিষয় হলো চট্টগ্রাম তথ্য প্রযুক্তি খাতেও কোনভাবে পিছিয়ে নেই।

প্রযুক্তি পণ্যের নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি হয়েছে চট্টগ্রামে। প্রযুক্তি পণ্য মেলে হাতের নাগালেই। এর বাইরে ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার কারণে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার। প্রযুক্তি পণ্য ও সহজলভ্য ইন্টারনেট সেবার কারণে মানুষ এখন ঘরে ঘরে নিজেই উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করার সুযোগ পাচ্ছে।

কিন্তু প্রশ্ন জাগে চট্টগ্রামের মানুষ বাস্তবে কতটা কম্পিউটার প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত? তারা কতটা দক্ষতা অর্জন করতে পেরেছে? এমন প্রশ্নের উত্তরেও মুহূর্তেই মনের আড়ালে ভেসে ওঠে চট্টগ্রাম প্রযুক্তি ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। যেখানে থেকে দেশের সেরা অনেক কম্পিউটার প্রকৌশলী তৈরি হচ্ছে। এর বাইরে চট্টগ্রামের ৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও রয়েছে কম্পিউটার প্রকৌশলী বিভাগ। এগুলো উচ্চ শিক্ষার পর্যয়ে পরে। এর বাইরে চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট, সরকারি মহিলা পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট ও অসংখ্য বেসরকারি পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটও কম্পিউটার প্রকৌশলী গড়ার কাজ করে যাচ্ছে।

আছে নানা সরকারি বেসরকারি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। মূলু এসব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রই কম্পিউটারের হাতেখড়ি মূল জায়গা। নব্বইয়ের দশক থেকে চট্টগ্রামে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো ও নিটা কম্পিউটার প্রশিক্ষণে ব্যাপক অবদার রাখে। সাথে রয়েছে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল। যা এখনো ধরে রেখেছে। সেসময় খুব একটা বেসকরকারি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের নাম শোনা যেু না। ওই সময় নিউ হরিজন ও এপটেকের প্রচুর নামডাক ছিল। এরপর ধারাবাহিকভাবে অসংখ্য বেসরকারি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চট্টগ্রামে গড়ে ওঠে। অন্যদিকে ওই সময় থেকে বাংলাদেশ কোরিয়া টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউটও সমান তালে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছিল। সময়ের সাথে সাথে চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠা হয় বেসিস এর বিআইটিএম প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। সেখানেও সরকারি বৃত্তিতে অনেক শিক্ষার্থী প্রশিক্ষণ নিয়েছে। এছাড়া সমজ সেবা অধিদপ্তরও কম্পিউটার প্রশিক্ষণে এগিয়ে আসে।

তথ্য প্রযুক্তি ব্যাপক প্রসার ও সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার বিনির্মার্ণের সহায়তার প্রদানের নিমিত্তে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন উদ্যেগ গ্রহণ করে কম্পিউটার প্রশিক্ষণের। প্রয়াত মেয়র এ.বি.এম মহিউদ্দিন চৌধুরী নগরের বিভিন্ন প্রান্তে ১৯৯৭ সালে গড়ে তুলেছিলেন বেশ কিছু কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ক্যাম্পাস। পরবুীতে ২০০৪ সালে তিনি বৃহৎ আঙ্গিকে প্রতিষ্ঠা করেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন কম্পিউটার ইন্সটিটিউট। প্রতিষ্ঠানগুলো হতে এযাবু প্রায় ২০ হাজারের অধিক শিক্ষার্থীকে কম্পিউটারের বিভিন্ন সেক্টরে মান সম্মত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তৈরি হয়েছে এক ঝাঁক দক্ষ জনবল যারা দেশের উন্নয়নে অবদান রাখছেন।

তবে প্রযুক্তির সহজলভ্যতায় এখন ঘরে বসেই কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নেওয়া যায়। কোভিড পরিস্থিতিতে স্কুল কলেজের মতো কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোও ভার্চুয়াল ক্লাস পরিচালনার মাধ্যমে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ অব্যাহত রাখে। এছাড়া র্বুমানে ইন্টারনেটেই কম্পিউটারের বিশেষ প্রশিক্ষণের অনেক রিসোর্স সহজেই পাওয়া যায়। অসংখ্য ভিডিও টিউটোরিয়ার নেটেই পাওয়া যায়। ফলে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই তাদের পছন্দ মতো প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেকে উদ্যোক্তায় পরিনত করতে পারছে। তারা ফ্রিল্যান্সার হয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করছে।

বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৫০টিরও বেশি দেশে সফটওয়্যার ও আইটি সংক্রান্ত পণ্য রপ্তানি করছে। তাছাড়া বাংলাদেশ থেকে আইটি সেবা গ্রহণকারী দেশের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। বেসিসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালে আইসিটি পণ্য ও সেবা রপ্তানি করে বাংলাদেশ ৮০ কোটি ডলার আয় করেছে। আইসিটি সেক্টর থেকে রপ্তানি আয় বৃদ্ধির সাথে সাথে বাংলাদেশ আইটি আউটসোর্সিংয়ের জন্য একটি দুর্দান্ত আবাসে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং (বিপিও) ইন্ডাস্ট্রি একটি ভয়ঙ্কর গতিতে বাড়ছে। বাংলাদেশের দ্রুত ডিজিটালাইজেশন, যার মধ্যে রয়েছে শহরাঞ্চলে সহজ ইন্টারনেট এক্সেস এবং ফ্রিল্যান্সিংকে উন্নীত করার জন্য কিছু অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ। যা দেশে ফ্রিল্যান্সিং কার্যক্রম বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে। ফলস্বরূপ, অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিটিউট (ওআইআই) অনুসারে, বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই অনলাইন শ্রম সরবরাহে দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের আইসিটি বিভাগ অনুসারে, প্রায় ৫ লাখ সক্রিয় ফ্রিল্যান্সার দেশের সাড়ে ৬ লাখ নিবন্ধিত ফ্রিল্যান্সারদের মধ্যে নিয়মিু কাজ করছে। যা বছরে ১০০ মিলিয়ন টাকা উপার্জন করছে। আইসিটি সেক্টরে এই অসাধারণ সাফল্য র্বুমান সরকার প্রগতিশীল পদক্ষেপের মাধ্যমে সম্ভব হয়েছে।

র্বুমান তথ্য অনুসারে, ভারত অনলাইন শ্রমের বৃহত্তম সরবরাহকারী যা মোট ফ্রিল্যান্সিং কর্মীদের ২৪% এর কাছাকাছি, বাংলাদেশ (১৬%) এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (১২%) এর পরে। বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন ধরনের ফ্রিল্যান্সিং সেবা প্রদান করে থাকে।

সুলভ ইন্টারনেট কানেক্টিভিটি এবং ডিজিটালভাবে সচেতন গ্রাহকরা সস্তা স্মার্টফোনের প্রাপ্যতা, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং-এর দ্রুত বৃদ্ধি (২৩ মিলিয়নের বেশি ফেসবুক ব্যবহারকারী), এবং দেশে ডিজিটাল-সচেতন ভোক্তাদের ক্রমবর্ধমান উত্থানের ফলে, বাংলাদেশ আইসিটি সেক্টরে অসাধারণ প্রবৃদ্ধির সম্মুখীন হচ্ছে। ইন্টারনেট সংযোগ, মোবাইল ফোন ব্যবহার এবং আইসিটি শিক্ষার ক্ষেত্রে দেশের ব্যাপক অগ্রগতির জন্য এটি মূল কারণ বলা যেতে পারে।

ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার দেশের তরুণদের জন্য অগণিত সুযোগ সৃষ্টি করছে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সামাজিক কল্যাণকে ত্বরান্বিত করছে। আইসিটি সেক্টরে ১৬০ মিলিয়ন-এর বেশি লোকের বাজার রয়েছে, যেখানে ভোক্তাদের খরচ প্রায় ১৩০ বিলিয়ন-এর বেশি মার্কিন ডলার এবং বার্ষিক ৬ শতাংশ হারে বাড়ছে। তাই আইসিটি শিল্পে বাংলাদেশের একটি বড় সম্ভাবনা রয়েছে।

ভারত, চীন এবং মালয়েশিয়া সহ অন্যান্য উদীয়মান এশীয় দেশগুলির মতো, বাংলাদেশ ডিজিটাল যুগের দেওয়া সুযোগগুলি কাজে লাগাতে এবং প্রযুক্তিগণভাবে উন্নত দেশগুলির সাথে যোগাযোগ করতে প্রস্তুত। বাংলাদেশ এখন তথ্যপ্রযুক্তি খাতে প্রচুর বিনিয়োগ করছে এবং উচ্চতর কর্মসংস্থান/আয় এবং প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সুবিধা অর্জন করে তার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া উচিত। আইসিটি সেক্টরের ক্রমাগণ বৃদ্ধি এবং অসংখ্য নতুন আইটি কোম্পানির সাথে, বাংলাদেশ সরকার দেশের বেকারত্ব সমস্যা দূর করে, বাংলাদেশি যুবকদের জন্য হাজার হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে। আইটি পার্কে বিনিয়োগের মাধ্যমে সরকার বিদেশি কোম্পানিগুলোকে বাংলাদেশে তাদের কোম্পানি স্থাপনের জন্য আকৃষ্ট করছে, বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ এনেছে এবং অনেক নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে। এই খাতে সাম্প্রতিক উত্থান, তাই ইঙ্গিত দেয় যে বাংলাদেশ ডিজিটাল প্রযুক্তির পূর্ণ বৃদ্ধির সুযোগ কাজে লাগাতে চলেছে এবং উচ্চ আয়ের দেশগুলির সাথে দ্রুত এগিয়ে যেতে চলেছে।

লেখক: পরিচালক, সিটি কর্পোরেশন কম্পিউটার ইন্সটিটিউট

 

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট