চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

আত্মকর্মসংস্থান ও অর্থনীতিতে ভরসা ফ্রিল্যান্সিং

১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ | ৩:৩১ অপরাহ্ণ

ডা. তানজিবা রহমান

 

একটি দেশের অর্থনৈতিক ডিজিটাইজেশন শুধু পণ্য ও সেবার উদ্ভাবনই বাড়ায় না, সেই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ বাজারে বিপুল কর্মসংস্থান তৈরি করে ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে জোরালো করে। কম খরচ ও ঝুঁকি বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়াসহ উন্নত বিশ্বের অনেক বড় বড় কোম্পানি এখন বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে আইটি আউটসোর্সিং করছে। এতে বাংলাদেশ হয়ে উঠছে ফ্রিল্যান্সিং কর্মসংস্থানের একটি বড় উৎস। এ কথাগুলো উল্লেখ করা হয়েছিল ২০১৯ সালে জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাডের ‘ডিজিটাল ইকোনমি রিপোর্ট-২০১৯’ শীর্ষ প্রতিবেদনে।

আঙ্কটাডের সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১১ সালে বাংলাদেশে ফ্রিল্যান্সিং খাতে মাত্র ১০ হাজার ফ্রিল্যান্সার কাজ করতো। ২০১৩ সালে তা বেড়ে ৩০ হাজারে দাঁড়ায়। ডিজিটাইজেশন ও প্রযুক্তিগণ উন্নয়নের ফলে ২০১৭ সালে তা ৫ লাখে দাঁড়ায়। এ ছাড়া বাংলাদেশের আইটি খাতে ৩ লাখের বেশি পেশাজীবী কাজ করছে।

আঙ্কটাড প্রতি দুই বছর পর পর ‘ডিজিটাল ইকোনমি রিপোর্ট’ প্রকাশ করলেও ২০১৯ সালের পর ২০২১ সালে যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল তাতে ফ্রিল্যান্সেংয়ের বিষয়ে কোন পরিসংখ্যানগণ তথ্য উল্লেখ করেনি। তবে বাংলাদেশের আইটি খাত যেভাবে এগিয়েছে তাতে ধারণা করা যায় ফ্রিল্যান্সিং খাতের আয় কয়েকগুণ বেড়েছে।

ফ্রিল্যান্সিংয়ে ভারতের ঠিক পেছনেই রয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাপী ফ্রিল্যান্সারের জনসংখ্যার ১৬ শতাংশ আমাদের দেশের। আমাদের বাংলাদেশ যে উন্নত দেশের তালিকায় স্থান করে নেবে, তা খুব বেশি দূরে নয়। হ্যাঁ, এটা সম্ভব।

বাণিজ্যবিষয়ক পত্রিকা ফোর্বস এর তথ্যমতে ফ্রিল্যান্সিং থেকে আয়ে এগিয়ে থাকা শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। ফ্রিল্যান্সিং আয়ে বাংলাদেশ এর অবস্থান অষ্টম এবং বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ২৭ শতাংশ। বিশ্বে বছরে এক ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাজার রয়েছে আউটসোর্সিংয়ে। বাংলাদেশের এই খাতে আয় ১ বিলিয়ন হলেও, সম্ভাবনা আছে ৫ বিলিয়ন ডলারের। কিন্তু এই ৫ বিলিয়ন ডলার আয় এর লক্ষ্য পূরণ করতে প্রয়োজন প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার এর সরকারি বিনিয়োগ। বিগণ বছরগুলোতে বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সিংয়ে অনেক উন্নতি করেছে যার ফলে বাংলাদেশের আয় ১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পেরেছে। ভবিষ্যতেও বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সিং খাতে বিরাট সুযোগ রয়েছে। আর এ খাতে ভালো কর‍তে হলে অবকাঠামো এবং ইন্টারনেট সুবিধা বাড়াতে হবে। বাংলাদেশের জন্য ফ্রিল্যান্সিং একটি সম্ভাবনাময় খাত। কারণ যেখানে দেশের চাকরির বাজার বেশ নাজুক, যেখানে ৪৭ শতাংশ শিক্ষিত জনগোষ্ঠী বেকার, পর্যাপ্ত চাকরির ক্ষেত্র তৈরি হয় না, সেখানে বিকল্প পেশা হিসেবে সম্মানজনক অবস্থায় আছে ফ্রিল্যান্সিং।

ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৪ কোটি ৪০ লাখ তরুণদের প্রতি ১০ জনের একজন বেকার। প্রতিবছরই বিশ্ববিদ্যালয় পেরোনো হাজার হাজার শিক্ষার্থী মনের মতো চাকরি না পেয়ে বেকার হয়ে বসে আছেন। ফলে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। কিন্তু এই বেকার জনগোষ্ঠীকে ফ্রিল্যান্সিংয়ে যুক্ত করে দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করার সুযোগ রয়েছে।

দেশে অনলাইনে আয় করছে এরকম সংখ্যা হচ্ছে সাড়ে ৬ লাখ। সূত্র হল অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি অফ ইন্টার্নেট। তবে র্বুমানে সক্রিয়ভাবে কর্মরত আছে সাড়ে তিন লাখ ফ্রিল্যান্সার। করোনাকালীন পরর্বুী থেকে বহিঃবিশ্বে ৮৫ শতাংশ কাজই হয় অনলাইনের মাধ্যমে। যার ৭৫ শতাংশ কাজ অনলাইন মার্কেটপ্লেসে উপলব্ধ থাকে। ফলে হ্যাক অনলাইন মার্কেটপ্লেসে কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা সামনে আরো বাড়বে।

অন্যদিকে, আমাদের অধিকাংশ নারীই গৃহিণী। তারা রান্নাবান্না ও সন্তান লালন-পালনের জন্য সময় পার করে। তাদের সময়ের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে কী হবে ভাবতে পারেন?

ফ্রিল্যান্সিং কাজের মধ্যে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং থেকে শুরু করে ওয়েব ডিজাইন, গ্রাফিক্স ডিজাইন, প্রোগ্রামিং, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট ও এসইওসহ অসংখ্য কাজ রয়েছে। তথ্য-প্রযুক্তিভিত্তিক এসব কাজ উদীয়মান দেশগুলোতে কর্মসংস্থানের বিপুল সুযোগ তৈরি করেছে, যা আগে ছিল না। ফলে বাকি বিশ্বকে আউটসোর্সিং সেবা দেয়ার দিক থেকে বিশ্বের শীর্ষস্থানে রয়েছে এখন এশিয়া।

ফ্রিল্যান্সিং কাজের ক্ষেত্রে একজন মানুষ প্রথাগণ চাকরির চেয়ে অনেক বেশি স্বাধীনতা ও সুবিধা পেয়ে থাকেন। যে কোনো স্থান থেকে যে কোনো সময় কাজ করা যায়, রাস্তার জ্যাম পেরিয়ে অফিসে যেতে হয় না, নিজের বাসায়ই কাজ করা যায়। ক্লায়েন্ট বা প্রকল্প নিজের পছন্দমতো নেয়া যায় এবং বৈশ্বিক বাজারে প্রবেশ করা যায়। ফলে র্বুমানে ফ্রিল্যান্সিং হয়ে উঠেছে অনেক বাংলাদেশির জন্য পছন্দের ক্যারিয়ার।

এদিকে সরকারি নানা উদ্যোগের পরেও এখনো বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে বাংলাদেশের। যার মধ্যে রয়েছে বিদ্যুৎ বিভ্রাট, ইন্টারনেট সেবার মান এবং ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের অধিক মূল্য। ফ্রিল্যান্সিংয়ের জন্য ইন্টারনেটের বিকল্প নেই। ঢাকাতে ইন্টারনেট আগের চেয়ে কিছুটা সহজলভ্য ও গতি সম্পন্ন হলেও ঢাকার বাইরে ইন্টারনেট সেবার মান আরো বাড়ানো প্রয়োজন। অন্যান্য বিভাগীয় শহরগুলোতে এখনো ইন্টারনেটের দাম অনেক বেশি। সেখানে দ্রুত গতির ইন্টারনেট সেবা পেতে অনেক টাকা ব্যয় কর‍তে হয়। এছাড়া যেসব এলাকা ব্রডব্যান্ড সংযোগ এর আওতায় নেই সেখানে টেলিকম ইন্টারনেট ব্যাবহার ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। যা অনেক ব্যয়বহুল এবং কম গতিসম্পন্ন। দেশের সর্বত্র ব্যান্ডউইথের মাত্রাও এক নয়। তাই সরকারের উচিৎ দ্রুত গতির নেটওয়ার্ক সর্বত্র বিস্তৃত এবং সহজলভ্য করা এবং ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের দাম নির্ধারণে মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করা।

ফ্রিল্যান্সিং এর আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে টাকার সহজ লেনদেনের ব্যবস্থা। বিশেষ করে বিদেশ থেকে টাকা নেওয়ার ক্ষেত্রে সহজ কোনও উপায় নেই। র্বুমানে বাংলাদেশে অনলাইন পেমেন্ট মেথড হিসেবে পেওনিয়ার, স্কিল, পেইজা, নেটেলার, জুম চালু আছে। কিন্তু উন্নত বিশ্বে অনলাইন অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় পেপাল। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো পেপাল সেবা চালু করা হয়নি ফলে ফ্রিল্যান্সারদের উপার্জিত অর্থ গ্রহণ ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্থ প্রদানের জন্য পেমেন্ট মেথড নিয়ে বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে হয়, ব্যয় হয় অতিরিক্ত অর্থ। যদিও ২০১৭ সালে বাংলাদেশ সরকার এবং পেপালের মধ্যে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে এবং কাজ চলমান আছে। পেপাল কর্তৃপক্ষ বাজার যাচাইসহ নানা পরীক্ষা চালিয়েছে। সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের কথা ভেবে বাংলাদেশে পুরোপুরি পেপাল সেবা চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। নয়টি ব্যাংকের সাথেও সরকারি উদ্যোগে আলোচনা হয়েছে। এদিকে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালোয়ও পেপালের সঙ্গে আলোচনা চলমান রেখেছে। পেপাল সেবা চালু হলে বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সাররা উপকৃত হবেন। এ ছাড়া রেমিট্যান্স আসার হার বাড়বে। ডিজিটাল ট্রানজেকশন বাড়বে। তাই সরকারের উচিত ফ্রিল্যান্সিং মাধ্যমে প্রচুর রেমিটেন্স পেতে দেশে দ্রুত পেপাল সেবা চালু করা জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া।

লেখক:  চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সিং ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি (বিএফডিসি)

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট