চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

প্রতিকূলতায়ও এগুচ্ছে আইটি খাত

১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ | ১২:৩৬ অপরাহ্ণ

সারোয়ার আহমদ 

তথ্যপ্রযুক্তির এই বিশ্বে আইটি খাতে উন্নয়ন ছাড়া উল্টো পথে চলার কোন সুযোগ নেই। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও তার আপন গতিতে আইটি খাত নিয়ে এগুচ্ছে। সরকারি-বেসরকারিসহ সবখাতে তথ্য প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে। এর প্রত্যক্ষ ফলাফল এসেছে করোনা মহামারীর লকডাউনে। এই প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে বাণিজ্যিক প্রসার যেমন হয়েছে তেমনি শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগও সৃষ্টি হয়েছে। তবে আইটির উন্নয়নের এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে বাংলাদেশে। যা উৎরানো গেলে অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশকে বিশ্বের অন্যভাবে পরিচিতি করা সম্ভব।

 

ই-কমার্স ও ব্যাংকিং লেনদেন কতটুকু নিরাপদ :

তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে বৈশ্বির বাণিজ্য যেমন সহজ হয়েছে, তেমনি দেশে গড়ে উঠেছে নানা প্রযুক্তি নির্ভর প্রতিষ্ঠান। গত কয়েক বছরে দেশে শত শত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানকে আলোড়ন ফেলতে দেখা গেছে। যার মধ্যে অন্যতম ছিল ইভ্যালি। আইন শৃঙ্খলাবাহিনী র‌্যাবের তথ্য মতে, ইভ্যালির কাছে গ্রাহকদের পাওনা রয়েছে ১ হাজার কোটি টাকার বেশি। তবে প্রতিষ্ঠানটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছিল গ্রাহক ও সাপ্লাইয়ারদের কাছে তাদের দেনা আছে ৫৪৩ কোটি টাকা। প্রযুক্তি নির্ভর করে এমন অনেক ই-কমার্স সাইট এসেছে যারা আদতে প্রযুক্তিকে পুঁজি করে প্রতারণার ফাঁদ পেতে বসেছিল। লাখ লাখ মানুষ প্রতারিত হওয়ার পরেই দেখা গেছে ই-কমার্স নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। অর্থাৎ যা সর্বনাশ হওয়ার তা আগেই হয়ে গেছে।

ই-কমার্সের পাশাপাশি বর্তমানে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে অনলাইন ভিত্তিক ব্যাংকিং আর্থিক লেনদেন। এই ব্যবস্থায়ও বাংলাদেশের রয়েছে তিক্ত অভিজ্ঞতা। এর অনন্য উদাহরণ বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি। ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে (ফেড) রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়। পাঁচটি সুইফট বার্তার মাধ্যমে চুরি হওয়া এ অর্থের মধ্যে শ্রীলংকায় যাওয়া দুই কোটি ডলার ফেরত আসে। তবে ফিলিপাইনে যাওয়া আট কোটি ১০ লাখ ডলার জুয়ার টেবিল ঘুরে হাতবদল হয়। খোয়া যাওয়া রিজার্ভের অর্থের দেড় কোটি ডলার ফেরত এলেও বাকি অর্থ উদ্ধারে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তৎপরতা চালানো হলেও এখনও তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। এমন সব তিক্ত অভিজ্ঞতায় প্রশ্ন এসে দাঁড়ায় আদতে দেশের ই-কমার্স ও ব্যাংকিং লেনদেন কতটুকু নিরাপদ! প্রযুক্তি খাতে আমরা কতটুকু নিরাপত্তা জোরদার করতে পেরেছি!

 

বিদ্যুতের খুঁটিতে ইন্টারনেটের তারের জঞ্জাল আর কত :

দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ব্যবহৃত সব ধরনের ইন্টারনেট সংযোগই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অপটিক্যাল ফাইবারের তারের উপর নির্ভরশীল। তবে এই তারের ইন্টারনেটের সংযোগেও মানা হয় না কোন নিয়মনীতি। বিদ্যুতের খুঁটিতে পেঁচিয়ে অপটিক্যাল ফাইবারের জঞ্জাল তৈরি করে চলছে চট্টগ্রাম নগরীসহ দেশের সব অঞ্চলের ইন্টারনেট সেবা। এতে দুর্ঘটনা ঘটলেই কাটা পরে তার। বিচ্ছিন্ন হয় সরকারি, ব্যাংক-আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ গুরুত্বপূর্ণ কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের ইন্টারনেট সংযোগ। অথচ শুধু চট্টগ্রাম শহরেই সব গুরুত্বপূর্ণ সড়কের নিচে স্থাপন করা আছে ভূগর্ভস্থ অপটিক্যাল ফাইবার।

সরকারি প্রতিষ্ঠান বিটিসিএল বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সামিট কমিউনিকেশন, ফাইবার এট হোম এবং বাহন নামের চারটি প্রতিষ্ঠান মাটির নিচেই তার টেনে রেখেছে। নিয়ম করা হয়েছিল মাটির নিচের ফাইবার ব্যবহার করেই ইন্টারনেট সংযোগ নিতে হবে। কিন্তু এ নিয়ম প্রায় ৯৫ ভাগ প্রতিষ্ঠানই মানেনি। উচ্চ মূল্যের দোহাই দিয়ে এই নিরাপদ তার ব্যবহার করছে না কেউ। বিদুতের খুঁটিকেই তারের জঞ্জালে পরিণত করা হয়েছে। ফলে অব্যবহৃত রয়ে গেছে ভূগর্ভস্থ তিন চতুর্থাংশ ফাইবার। এদিকে, বিদ্যুতের খুঁটির ফাইবার সরাতেও কোন সরকারি বেসরকারি সংস্থার তৎপরতাও নেই।

 

আইটি প্রশিক্ষণে আর আঞ্চলিকতার গণ্ডি নেই :

তথ্যপ্রযুক্তির সহজলভ্যতার ফলে আইটি প্রশিক্ষণে এখন আর আঞ্চলিকতার কোন ব্যাপার নেই। আগে যেখানে কোন এক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকেই ট্রেনিং নিতে হতো তা এখন ঘুচে গেছে। যে কোন বিষয়ের উপর এখন ইন্টারনেটেই ভিডিও টিউটোরিয়াল পাওয়া যায়। ভিডিও কনফারেন্সিয়ংয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ের উপর অভিজ্ঞদের কাছ থেকে ট্রেনিং নেওয়া যায় অনলাইনেই। এসব উন্নতির ফলে কম্পিউটার প্রশিক্ষণের আর কোন গণ্ডি না থাকায় ফ্রিল্যান্সিং পেশারও ব্যাপক প্রসার হয়েছে।

 

অধরাই থেকে গেল আন্তর্জাতিক পেমেন্ট গেটওয়ে পেপাল :

বৈশ্বিক ফ্রিল্যান্সিং খাতে বাংলাদেশের প্রায় সাড়ে ৬ লাখ ফ্রিল্যান্সার কাজ করছেন, যাদের মাধ্যমে প্রতিবছর দেশে ১০ কোটি ডলারের বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আসছে। তবে এই অর্থ এখনো সরাসরি বাংলাদেশে আসে না। তৃতীয় পক্ষ হয়ে কিছু প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এই অর্থ আসে বাংলাদেশে। যেখানে পেওনিয়ার উল্লেখযোগ্য। তবে এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অর্থ লেনদেনে বাংলাদেশ হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকা। ফ্রিল্যান্সিং পেশায় আন্তার্জাতিক প্রচলিত পেমেন্ট গেটওয়ে পেপাল বাংলাদেশে এখনো আনা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশের চেয়ে অনেক অনুন্নত দেশে পেপাল চালু থাকলেও তালিকায় বাংলাদেশ নেই। অনেক ঘটা করে পেপালের বিকল্প জুম সার্ভিস চালু করলেও আলোর মুখ দেখেনি এই পেমেন্ট গেটওয়ে।

 

ফ্রিল্যান্সিং পেশার সামাজিক স্বীকৃতি কোথায় :

বাসায় বসে বিদেশি ক্লায়েন্টের কাজ করে দিয়ে দেশের ফ্রিল্যান্সাররা বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে। শুধু তাই নয়, তারা আত্মনির্ভরশীল হয়েছেন। চাকরির বাজারের উপর চাপ কমিয়েছেন। তবে এসব ফ্রিল্যান্সাররা বিপুল অর্থ উপার্জন করলেও তাদের সামাজিক স্বীকৃতি দিতে এখনো কটু দৃষ্টিতে দেখেন সমাজের অনেকেই। ফ্রিল্যান্সিংকে এখনো সমাজের অনেক মানুষ পেশা হিসেবে মেনে নিতে পারেনি। ফলে সামাজিকভাবে অনেক ফ্রিল্যান্সারকে কটু কথাও শুনতে হয়। কিন্তু তারাও রেমিটেন্স যোদ্ধা।

 

প্রযুক্তি পণ্য ব্যবহারে আসক্তি :

প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে যেমন উন্নয়ন হচ্ছে, তেমনি এর খারাপ দিক বেছে নিয়েছে অনেক তরুণ-তরুণী। যেমন টিকটক আসক্তি। টিকটক মূলত একটি সংক্ষিপ্ত ভিডিও তৈরির এপ্লিকেশন, যেখানে ৩ থেকে ১৫ সেকেন্ডের ছোট মিউজিক ভিডিও, ডায়ালগ ও কমেডি ভিডিও তৈরি করে থাকেন এর ব্যবহারকারীরা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় বিনোদনের নামে আসলে টিকটক জুড়ে চলছে অশ্লীলতা ও ভিনদেশি সংস্কৃতির সাথে চরম বেহায়াপনা। আমাদের দেশের তরুণদের মাঝে অ্যাপটি ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। গড়ে উঠেছে টিকটক ভিত্তিক বিভিন্ন গ্রুপ। আর এসব গ্রুপ নিয়মিতই একসাথে বিভিন্ন জায়গায় ট্যুর ও পার্টি প্লান করছে। ঘটছে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। সম্প্রতি ধর্ষণ ও নারী পাচারের মতো কার্যক্রমে টিকটিকারদের নাম আসায় সাধারণ মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে টিকটক বন্ধের দাবি জানায়। প্রযুক্তির এমন নেতিবাচক প্রভাবও পড়েছে দেশের মানুষের মাঝে।

 

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট