চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

kidney

দেশে কিডনি রোগী বাড়ছে, চিকিৎসা ব্যবস্থা সেভাবে নেই

অনলাইন ডেস্ক

১৮ মে, ২০১৯ | ৮:০৬ অপরাহ্ণ

বাংলাদেশ কিডনি ফাউন্ডেশনের জরিপ বলছে, কিডনি রোগে প্রতি বছর ৪০ হাজারের বেশি কিডনি পুরোপুরি অকেজো হয়ে যাচ্ছে দেশে। প্রায় দুই কোটি মানুষ কোনো না কোনোভাবে কিডনি রোগে ভুগছে। এ ধরনের রোগীর জন্য মাত্র দু’ রকম চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে। হয় ডায়ালাইসিস অর্থাৎ যন্ত্রের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে কিডনির কাজ করানো, না হয় কিডনি প্রতিস্থাপন। কিন্তু এই দু’ ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতিই অত্যন্ত ব্যয়বহুল।
ডায়ালাইসিসের ব্যয় সরকারিভাবে নির্ধারিত হয় না। কিডনি অকেজো হওয়া একজন রোগীকে সপ্তাহে দুই বা তিনবার পর্যন্ত ডায়ালাইসিস করাতে হয়। সরকারি হাসপাতালগুলোতে একবার ডায়ালাইসিস করাতে আড়াই হাজার টাকা থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ পড়ে। আর বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে এই ব্যয় সাড়ে তিন হাজার টাকা থেকে আট হাজার টাকা পর্যন্ত। হাসপাতালগুলো নিজেদের মতো করে তা নির্ধারণ করে থাকে।
বারডেম হাসপাতালের কিডনি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সারোয়ার ইকবাল বলেন, রোগীদের পরিবারগুলোকে এই ব্যয় বহন করতে হিমশিম খেতে হয়। শেষপর্যায়ে কিডনি বিকল হওয়ার কারণে যত রোগীর ডায়ালাইসিস প্রয়োজন হয়, তার ৯০ ভাগ রোগীই এক বা দুইবার ডায়ালাইসিস করার পর আর এটা করাতে পারে না। ১০ শতাংশের কম লোক এটার ব্যয়ভার বহন করতে পারে। এছাড়া কিডনি প্রতিস্থাপন করার ব্যয় কিছুটা কম হলেও এর ডোনার পাওয়া যায় না। এখন দেশে কিডনি প্রতিস্থাপনে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় হয়। তবে সমস্যা হচ্ছে কিডনি পাওয়াটা বেশ কঠিন।
কিডনি ফাউন্ডেশনের প্রধান অধ্যাপক হারুন আর রশিদ বলেন, ব্যয়ের বিষয়টা যেমন আছে, তেমনি কিডনি রোগের শেষ অবস্থায় রোগীদের জন্য দেশে ডায়ালাইসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপনের সুবিধা এখনও সেভাবে গড়ে ওঠেনি। তিনি বলেন, আমাদের যে সুযোগ-সুবিধা আছে, তাতে আমরা ৪০ হাজার রোগীর মাত্র ২০ ভাগকে ডায়ালাইসিস বা প্রতিস্থাপন করে দিতে পারি। ৮০ ভাগ রোগীই চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুবরণ করেন। নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে নতুন ৪০ হাজার রোগীকে ডায়ালাইসিস সেবা দেয়া এবং প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হয় না।
কিডনি প্রতিস্থাপন আইন কিছুটা শিথিল করে একজন রোগীর বাবা-মা ভাই-বোনের পাশাপাশি চাচাতো ভাইবোনের কিডনি দেয়ার ব্যবস্থা আনা হয়েছে। একইসাথে হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায় থাকা ব্যক্তির কিডনি নেয়ার বিধানও করা হয়েছে।
পরিবারের সহযোগিতার অভাবে নারীদের একটা বড় অংশ চিকিৎসক পর্যন্তই যেতে পারেন না। বারডেম হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. মেহরুবা আলম জানান, মেয়েদের কিডনির সমস্যা একটা পর্যায়ে তাদের সন্তান ধারণের ক্ষেত্রেও বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তিনি বলেন, ডাক্তারের কাছে মেয়েদের পৌঁছানোর হার এখনও পুরুষের তুলনায় কম। মেয়েরা চিকিৎসকের কতটা সাহায্য পেলো, তার অর্থ কতটা আছে বা পরিবার তার চিকিৎসার জন্য কতটা অর্থ বরাদ্দ রাখছে, এসব বিষয় মেয়েদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসকরা বিশেষভাবে উল্লেখ করছেন যে, পুরুষ রোগীর চাইতে নারী রোগীর জন্য কিডনি পাওয়া অনেক সময় বেশি কঠিন সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।
ডা. মেহরুবা আলম তাদের হাসপাতালে কিডনি প্রতিস্থাপন কর্মকাণ্ড নিয়ে বলেন, আমাদের হাসপাতালে যতজনের কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে, তাতে একজন স্বামী তার স্ত্রীর জন্য কিডনি দিয়েছেন, এমন কোন রেকর্ড নেই। কিন্তু স্ত্রী স্বামীর জন্য কিডনি দিয়েছেন, এ রকম ১০/১২টা ঘটনা আছে। প্রথম তো কাছের মানুষের কাছ থেকেই কিডনি দেয়ার কথা আসে। সেখানেই মেয়েরা স্বামীর সহযোগিতা পায় না।
চিকিৎসকরা বলছেন, কিডনির অনেকটা ক্ষতি না হওয়া পর্যন্ত কোন উপসর্গ দেখা দেয় না। তবে এই রোগের অন্যতম কারণগুলো হচ্ছে, নেফ্রাইটিস বা প্রস্রাবের প্রদাহ, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ বা অতিমাত্রায় ব্যথানাশক ঔষধ প্রয়োগ করা এবং খাদ্যাভ্যাস। বংশগত বিষয়ও এই রোগের একটা কারণ হতে পারে।
বেসরকারি সংস্থা কিডনি প্রতিস্থাপন ফাউন্ডেশনের প্রধান অধ্যাপক মো. আব্দুস সালাম বলেন, আইনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনা হলেও বাংলাদেশে এখনও মৃত্যুশয্যায় থাকা ব্যক্তির কিডনি পাওয়ার মতো পরিবেশ হয়নি। মৃত ব্যক্তির কিডনি নেয়ার কথা আইনে থাকলেও আমরা এখনও এটা করতে পারিনি। আমাদের দেশের মানুষ এখনও এটার জন্য প্রস্তুত নন। তিনি আরো বলেন, কয়েক মাস আগে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটা সেন্টারে বিদেশি টিমসহ আমরা চেষ্টা করেছিলাম যে, কোন একটা ব্রেন ডেড রোগীর আত্মীয়-স্বজন যদি রাজি হয় কিডনি দিতে। কিন্তু কেউই রাজি হননি। ভবিষ্যতে এটা হলে হয়তো কিডনি পাওয়ার সমস্যা কিছুটা কমতে পারে।
অধ্যাপক হারুন আর রশিদ বলেন, কোনোমতেই বাংলাদেশে আগামী ২০ বছরে সব কিডনি রোগীকে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হবে না। তবে একটা অবকাঠামো আছে, সেটা হচ্ছে কমিউনিটি ক্লিনিক। কিডনির চিকিৎসা বিস্তারে কমিউনিটি হাসপাতালগুলোকে কাজে লাগানো যেতে পারে। চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা- এমন সাত-আটটা শহরে কিছু কিছু ডায়ালাইসিসের ব্যবস্থা আছে এবং সেটা একেবারে নগণ্য। গ্রামপর্যায়ে এখন এটা চিন্তা করা খুব দুস্কর। এই কমিউনিটি ক্লিনিকে যদি উদ্যোগ নেয়া যায়, তাহলে আমরা কিডনি রোগ, ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপ-এসব রোগ প্রতিরোধ করতে পারি।
কিডনি রোগের চিকিৎসাব্যয় এবং সুযোগ-সুবিধা কোনোটাই পর্যাপ্ত নয়। ঢাকায় সরকারি হাসপাতাল ছাড়াও ব্যক্তি মালিকানায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কিছু ডায়ালাইসিস সেন্টার গড়ে উঠেছে। ঢাকার বাইরে বড় কয়েকটি শহরে সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে সীমিত পর্যায়ে এই চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু বেশিরভাগ জেলায় কিডনি রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থা সেভাবে নেই।
রাজধানীর বিশেষায়িত ডায়াবেটিক হাসপাতাল বারডেমে কিডনি রোগীর অনেক ভিড়। ডায়াবেটিস থাকলে সেটিও একটা পর্যায়ে গিয়ে কিডনি রোগে আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম কারণ হয়ে উঠতে পারে। তাই এই হাসপাতালে কিডনি রোগের চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত ইউনিট রয়েছে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট