বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের মনোরোগ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডাক্তার ফাতেমা জোহরার কাছ থেকে চলুন জেনে নিই ওসিডির লক্ষণ, কারণ ও চিকিৎসার বিষয়ে।
অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজঅর্ডার (ওসিডি) বা শুচিবাই রোগ এক ধরনের মানসিক রোগ। এ সমস্যায় আক্রান্ত মানুষ যুক্তিহীন অবসেশন (অনর্থক চিন্তার পুনরাবৃত্তি) এবং কম্পালসিভ বিহেভিয়ারের (সেই চিন্তা অনুযায়ী কাজ করার অদম্য ইচ্ছা) একটি চক্রের মধ্যে আটকে পড়েন৷
ওসিডি নারী, পুরুষ বা শিশু যে কারোরই হতে পারে৷ ৬ বছর বয়স থেকে একজন মানুষের মধ্যে ওসিডির লক্ষণ দেখা দিতে পারে৷ তবে এটি প্রায়ই বয়ঃসন্ধিকালে ও প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে দেখা যায়।
ওসিডির লক্ষণ: ওসিডি আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে যে লক্ষণ বা অবসেশনগুলো সাধারণত দেখা যায় সেগুলো হলো:
নিজের বা অন্যের ক্ষতি হতে পারে এমন অহেতুক ভীতিকর চিন্তা।
শরীর, কাপড় বা আসবাবপত্রে জীবাণু বা ময়লা লেগে আছে এমন অহেতুক চিন্তা বারবার আসা৷
যৌনতা বিষয়ক অবসেশন। যেমন- নিষিদ্ধ ও বিকৃত যৌনচিন্তা, দৃশ্য কল্পনা বা আবেগ।
বারবার একই কাজ করা। যেমন -গ্যাস বন্ধ আছে কি না বা দরজায় তালা লাগানো হলো কি না এ ধরনের চিন্তার বারবার করা। জীবাণু ও দূষণের ভয়ে বারবার হাত ধোয়া বা পরিষ্কার করা৷
ওসিডির কারণ: ওসিডি কী কারণে হয় তা এখনো স্পষ্ট নয়৷ বিভিন্ন কারণে এটি হতে পারে। যেমন – পরিবারের কেউ ওসিডিতে আক্রান্ত থাকলে সেক্ষেত্রে পরবর্তী প্রজন্মের ওসিডি হওয়ার আশঙ্কা থাকতে পারে৷ বংশগত কারণেও অনেক সময় ওসিডি রোগ দেখা দিতে পারে।
ওসিডি আক্রান্ত কিছু মানুষের মস্তিষ্কে অস্বাভাবিকভাবে উচ্চ ক্রিয়াকলাপ বা সেরোটোনিন নামক রাসায়নিক মাত্রা কম থাকে৷ সেরোটোনিন বা ডোপামিনের তারতম্যের কারণেও ওসিডি দেখা দিতে পারে। অতিরিক্ত মাদক বা কোনো উত্তেজক পদার্থ গ্রহণ করলে সেটিও ওসিডির সেকেন্ডারি কারণ হিসেবে কাজ করে থাকে।
কিছু কিছু মানসিক রোগের প্রাককালীন লক্ষণ হিসেবেও ওসিডি হতে পারে৷ যেমন- সিজোফ্রেনিয়া রোগের প্রারম্ভিককালেও ওসিডি হতে পারে। অনেক সময় গর্ভাবস্থায় ওসিডি রোগের লক্ষণ দেখা দেয়। আবার কারো ক্ষেত্রে জীবনের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার পর থেকেও ওসিডি হতে পারে। যেমন: সন্তান জন্মদান বা সন্তানের মৃত্যু।
ওসিডির প্রতিকার বা চিকিৎসা
অন্যান্য শারীরিক রোগ যেমন- ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ চিকিৎসার মাধ্যমে যেভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, ঠিক তেমনি এই ওসিডি রোগটিও চিকিৎসার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
এর চিকিৎসা সাধারণত ২ প্রকার। ২ ধরনের চিকিৎসা একসঙ্গে প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
১. সাইকোলজিক্যাল: সাইকোলজিক্যাল চিকিৎসার মধ্যে ‘কগনেটিভ বিহেইভিয়ার থেরাপি’ খুব উপকারি। এখানে রোগীর ভুল চিন্তাগুলোর ওপর কাজ করা হয়। বিশেষ করে নেতিবাচক চিন্তা, দৃঢ় বিশ্বাস ইত্যাদি পুনর্গঠন করার চেষ্টা করা হয়।
২. ফার্মাকোলজিক্যাল: এক্ষেত্রে ফারমাকো থেরাপি বা মেডিসিন দিয়ে চিকিৎসা করা হয় রোগীর। প্রবাদ আছে, ‘কথায় চিড়া ভেজে না’। তাই রোগীরা কিছু মেডিসিন প্রত্যাশা করেন। বাস্তবিকভাবেই কিছু অ্যান্টি-ডিপ্রেসেন্ট শুচিবাই রোগীদের খুব কাজে আসে।
ওসিডি রোগীদের একইসঙ্গে অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার এবং ডিপ্রেসিভ ডিজঅর্ডার থাকতে পারে। তাই কাউন্সেলিংয়ের পাশাপাশি ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে কিছু মেডিসিন গ্রহণ করলে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে।
ওসিডি রোগীদের জন্যে কিছু পরামর্শ: নিয়মিত রিলাক্সেশন টেকনিক অভ্যাস করুন। যোগাসন, প্রাণায়াম, মেডিটেশন, ডিপ-ব্রিদিং এই রোগীদের দুশ্চিন্তা ও মানসিক চাপ কমানোর জন্যে কার্যকরী। পর্যাপ্ত ঘুম ও ব্যায়াম চর্চা করতে হবে। অবশ্যই বর্জন করতে হবে অ্যালকোহল আর নিকোটিন। যদি কমপক্ষে ৬ মাস সঠিক নিয়মে চিকিৎসা করা যায়, তবে অনেকে একেবারেই ভালো হয়ে যায়। কারো কারো বহুদিন পর রোগটি ফিরে আসতে পারে। কেউ কেউ বারবার আক্রান্ত হয় এবং তাদের চিকিৎসা নিয়েই স্বাভাবিক থাকতে হবে।
পূর্বকোণ/সাফা/পারভেজ