চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিতে যা করতে হবে

২৮ মে, ২০২২ | ৪:১৩ অপরাহ্ণ

গর্ভকালীন, প্রসবকালীন ও প্রসব-পরবর্তী সময়ে সকল নারীর জন্য নিরাপদ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণই হলো নিরাপদ মাতৃত্ব। ১৯৯৭ সাল থেকে নিরাপদ মাতৃস্বাস্থ্য, মাতৃমুত্যু কমানো ও নবজাতকের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মে মাসের ২৮ তারিখকে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস হিসাবে ঘোষণা করা হয়, যার মূল উদ্দেশ্য নিরাপদ মাতৃত্বকে নারীর অধিকার হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা। এবারের দিবসের প্রতিপাদ্য হলো- ‘মা ও শিশুর জীবন বাঁচাতে, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে হবে যেতে।’

বাংলাদেশ জাতীয় মাতৃস্বাস্থ্য কৌশলের অন্যতম লক্ষ্য হল ২০৩০ সালের মধ্যে মাতৃমৃত্যুুর হার ১৬৫ থেকে ৭০ জনে (একলাখ জীবিত জন্মে) কমিয়ে আনা। প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব বর্তমানের ৪৭ থেকে ৮৫ শতাংশে ও দক্ষধাত্রীর মাধ্যমে প্রসবের হার ৫০ থেকে ৯০ শতাংশে উন্নীত করা। নিরাপদ প্রসব, মায়ের পুষ্টি ও স্বাস্থ্যসেবার গুনগত মান বৃদ্ধি সম্পর্কে গর্ভবতী মা, পরিবার ও সমাজের সকল স্তরে সচেতনতা বৃদ্ধি ও সুস্বাস্থ্যের প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করাই এই দিবসের উদ্দেশ্য। মা ও শিশু মৃত্যুরোধ এবং তাদের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী অসুস্থতার বিষয়ে সবাইকে সচেতন করার পাশাপাশি এসব সমস্যা প্রতিরোধ করার প্রত্যয় নিয়ে সরকারের সাথে অবস্টেট্রিক্যাল ও গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি) নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করতে হলে আমাদের জোর দিতে হবে নারীশিক্ষা ও নারীর অধিকারের উপর ভিত্তি করে দাঁড়ানো নিরাপদ মাতৃত্বের ছয়টি মূল স্তম্ভের উপর। ১.পরিবার পরিকল্পনা সেবা, ২. গর্ভকালীন সেবা, ৩. প্রসবকালীন সেবা, ৪. প্রসব-পরবর্তী সেবা, ৫. এবর্শন পরবর্তী সেবা, ৬. যৌনরোগ ও এইচআইভি বা এইডস দমন করা।

পরিবার পরকল্পনা : মাতৃত্বকে নিরাপদ রাখতে পরিবার পরিকল্পনা সেবা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রতিটি দম্পতি কয়টি সন্তান নেবেন, কতদিন পরপর সন্তান নেবেন সে ব্যাপারে সিদ্বান্ত গ্রহণ করা তাদের অধিকার। প্রতিকুল অবস্থায় চাইলে পরিবার-পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণ করে সন্তান ধারণ করা থেকে বিরত থাকা এবং উপযুক্ত সময়ে সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করে গর্ভধারণ করে মাতৃত্ব নিরাপদ করা যায়।

গর্ভধারন পূর্ববর্তী সেবা : গর্ভধারণের পূর্বেই যদি চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া হয় তাহলে অনেক জটিল রোগ বা শারীরিক অবস্থা আগেই নির্ণয় হয়ে যায়, যেমন ডায়াবেটিস, রক্তস্বল্পতা, উচ্চরক্তচাপ, জন্মগত হৃদরোগ ইত্যাদি। প্রয়োজনীয় চিকিৎসার পর স্থিতিশীল শারীরিক অবস্থায় গর্ভধারণ মা ও শিশুর জীবন বিপন্ন হওয়া থেকে রক্ষা করে। এছাড়া প্রয়োজনীয় পরামর্শ এই সময়ে ভবিষ্যৎ মা’কে মানসিক প্রস্তুতি নিতে সাহায্য করে।

গর্ভকালীন সেবা : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি গর্ভবতী মহিলার গর্ভাবস্থায় অন্তত চারবার গর্ভকালীন সেবা নিতে হবে। এই সেবার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, প্রসূতির শারীরিক পরীক্ষা, প্যাথলজিকাল পরীক্ষা, প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান ও চিকিৎসা সেবা প্রদান। গর্ভকালীন অবস্থায় সব মায়েদের বিশেষ যত্ন ও পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন। এ সময়ে ওজন ও রক্তচাপ মাপা, টি টি টিকা দেয়া, রক্তস্বল্পতা পূরণ করা, পুষ্টি সমন্বয় করা প্রয়োজন। এছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ মায়েদের চিহ্নিত করা ও সেবা প্রদান, প্রসূতি ও প্রসূতির পরিবারের সদস্যদের প্রসবের প্রকৃতি, সময় ও স্থান নির্ধারণে প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করা এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

গর্ভকালীন সময়ে শতকরা ১৫ জন নারীই নানা রকম ঝুঁকিপূর্ণ জটিলতায় ভূগেন যার উপযুক্ত চিকিৎসা না হলে মাতৃমৃত্যু ঘটতে পারে। যেমন রক্তক্ষরণ, খিঁচুনী বা এক্লেম্পশিয়া মাতৃমৃত্যুুর অন্যতম প্রধান কারণ। অথচ সতর্কতা ও সঠিক চিকিৎসায় এসব মৃত্যু রোধ করা সম্ভব।

প্রসবকালীন সেবা : যদি প্রসূতি মায়েরা সন্তান জন্মদানের জন্য নির্ধারিত প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবা গ্রহণ করে, প্রসবকালীন সেবা তখনই নিশ্চিত করা যাবে। বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ ২০১৭-১৮ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী বছরে জন্ম নেয় ৩৭ লাখের বেশি শিশু। এরমধ্যে ৫০ শতাংশের বাড়িতে প্রসব হয়। প্রসবকালীন বিভিন্ন জটিলতা যেমন বিলম্বিত প্রসব, বাঁধাগ্রস্ত প্রসব যা কিনা জরায়ু ফেটে যাওয়ার অন্যতম কারণ, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ইত্যাদি জটিলতা বাড়িতে সন্তান প্রসবের কারণে হয়ে থাকে।

ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, অধিকাংশ মায়ের মৃত্যু ঘটে কোনো চিকিৎসক বা দক্ষ ধাত্রী ছাড়া বাড়িতে প্রসবের কারণে। সরকার নিয়ন্ত্রিত কমিউনিটি ক্লিনিক, মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্র, উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে জরুরি প্রসূতি সেবার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে যথাযথ কার্য্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। মাতৃমৃত্যু ও নবজাতকের মৃত্যু কমাতে হলে গর্ভবতী মায়েদের এইসব সেবা গ্রহণের জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

প্রসব-পরবর্তী সেবা : প্রসব-পরবর্তী সময়ে মায়ের নানাধরনের শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে প্রসব পরবর্তী ৬ সপ্তাহ সময়কালে যে সমস্যাগুলো মাকে মৃত্যু ঝুঁকিতে ঠেলে দেয় তা হলো অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, জরায়ুতে সংক্রমণ, এছাড়া মূত্রাশয়, শ্বাসনালীর সংক্রমণ, রক্তনালীতে রক্ত জমাট বাঁধা, মানসিক বিষন্নতা ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিতে পারে। এছাড়া এই সামগ্রিক সময়কালে প্রয়োজন নবজাতকের পরিচর্য্যা, মাতৃদুগ্ধ পান করানোর ব্যাপারে সহায়তা ও মায়ের সুস্থতার জন্য পুষ্টিকর খাবার, পর্যাপ্ত বিশ্রাম, পরিমিত ঘুম ও মানসিক সাহচর্য।

এবর্শন-পরবর্তী সেবা : এবর্শন-পরবর্তী জটিলতা প্রতিরোধ করা অতীব জরুরি। কারণ সেপ্টিক এবর্শন ও মাতৃমৃত্যুর একটি প্রধান কারণ। কাজেই জরুরি ভিত্তিতে ইনকমপ্লিট এবর্শনের চিকিৎসা করা ও ইনফেকশন প্রতিরোধ করা এবং অনাকাক্সিক্ষত গর্ভধারণ রোধে যথাযথ পরিবার-পরিকল্পনা পদ্ধতির জন্য উদ্বুদ্ধ করা গেলে মাতৃমৃত্যু অনেকাংশেরোধ করা সম্ভব। যৌনরোগসমূহ এবং এইচআইভি স্ক্রিনিং করা হলে এবং রোগ নির্ণয়ের পর যথাযথ চিকিৎসা করা হলে নবজাতকের সংক্রমণ রোধ করা সম্ভব। মা’দেরও বিভিন্ন গুরুতর অসুস্থতা থেকে মুক্ত রাখা যায়।

পরিশেষে দেশের স্বার্থে, আমাদের অনাগত সন্তানের সুস্বাস্থ্যের জন্য, উন্নয়নের মাইলফলকে নিজেদের দৃঢ় অবস্থানের জন্য আমাদের নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করতেই হবে। মাতৃত্ব নিরাপদ করা ও সুস্থ শিশুর জন্মগ্রহণ ও সুস্থভাবে বেড়ে ওঠা উন্নত জাতি গঠনের প্রধান সহায়ক। বাংলাদেশের শতভাগ নারীর মাতৃত্বকে নিরাপদ রাখতে আমরা স্বাস্থ্যকর্মীরা নিরলস ও আন্তরিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাব, আজকের দিনে এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

 

লেখক : প্রেসিডেন্ট, অবস্টেট্রিক্যাল ও গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি) চট্টগ্রাম শাখা ও অধ্যাপক, মেরিন সিটি মেডিকেল কলেজ।

পূর্বকোণ/এস

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট