চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

যে ক্যান্সার চাইলেই প্রতিরোধ করা যায়

২২ জানুয়ারি, ২০২২ | ৩:৪৩ অপরাহ্ণ

১৯-২৫ জানুয়ারি জরায়ু মুখ ক্যান্সার প্রতিরোধ সপ্তাহ পালিত হচ্ছে সারাদেশে। পুরো জানুয়ারি মাসই হচ্ছে ক্যান্সার সচেতনতা মাস। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় গতবারের মতই ‘বাল্য বিবাহে জোর না’।
আমাদের দেশের নারীরা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হন স্তন ক্যান্সারে- তার পরবর্তী স্থানে রয়েছে জরায়ু মুখের ক্যান্সার। আমাদের দেশে পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রায় ১৯.৩% প্রতিবছর ৮০৬৮ জন নারী নতুন করে জরায়ু মুখের ক্যান্সারে আক্রান্ত হন এবং প্রায় ৫২১৪ জন নারী মৃত্যুবরণ করেন ।

জরায়ু নারী শরীরের প্রজনন অঙ্গসমূহের মধ্যে একটি অঙ্গ যার কাজ প্রতিমাসে ওভারি বা ডিম্বাশয় হতে নিঃসরিত হরমোনের প্রভাবে ১২-৫০ বছর বয়স পর্যন্ত মাসিক রক্তক্ষরণ ও গর্ভধারণ করা।

সোজা কথায় মানবশিশুর জন্য ভ্রুণ থেকে ৪০ সপ্তাহ পর্যন্ত কন্টেইনার বা পাত্র হিসেবে কাজ করা যেই কন্টেইনার স্বয়ংক্রিয়ভাবে জীবন ধারনের যা প্রয়োজন যোগান দিয়ে যায়।
কন্টেইনারের মত জরায়ুর ও একটি মুখ আছে যেটি যোনী পথের ওপরের দিকে অবস্থান করে থাকে এবং এর মাধ্যমে জরায়ু থেকে নিঃসৃত রক্ত প্রতি মাসে বা গর্ভের শিশু জরায়ুর মুখ খোলা ও যোনী পথ দিয়ে প্রসব বা জন্মগ্রহণ করে।

জরায়ু মুখ যেহেতু ভেতরের কোন অঙ্গ নয় কাজেই এটি যোনী পথে খালি চোখে দেখা বা পরীক্ষা করা যায়- কিংবা যে কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যথাহীনভাবে করা যায়।
জরায়ু মুখ ক্যান্সার কোন সংক্রামক ব্যাধি নয়:
ইিউম্যান প্যাপিলোমা নামক একটি ভাইরাস (HPV) পরিবারের কিছু দুষ্ট সদস্য (HPV-16,18) এর প্রধান কারণ। প্রায় নারীরা জীবনে একাধিকবার এইভাইরাস দ্বারা যৌন সংসর্গের মাধ্যমে আক্রান্ত হন। তবে বেশির ভাগই সহজাত প্রতিরোধ ক্ষমতার মাধ্যমে সংক্রমণ মুক্ত হয়ে যান- যারা ঝূুকিপূর্ণ অবস্থানে আছেন তাদের মধ্যে এই ভাইরাস ক্যান্সারের পূর্বাবস্থার (CIN) সৃষ্টি করে দীর্ঘ মেয়াদে অবস্থান করে এবং প্রায় ১০-১৫ বৎসর পর পূর্ণ ক্যান্সারে রুপান্তরিত হয়।

কারা ঝুঁকিতে রয়েছেন-
১. অল্প বয়সে বিয়ে ও শারীরিক সম্পর্ক (১৮ বছরের আগে)।
২. অল্প বয়সে গর্ভধারণ (২০ বছরের আগে) ও সন্তান প্রসব।
৩ .ঘনঘন ও অধিক সন্তান প্রসব।
৪. একাধিক পুরুষের সাথে যৌনসংসর্গ।
৫. স্বামীর একাধিক মহিলার সাথে যৌনসংসর্গ।
৬. অপুষ্টি ও অপরিচ্ছন্ন ও অস্বাস্হ্যকর জীবন যাপন, ধুমপান করেন।
৭.যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম।
৮. যারা ক্যান্সারের পূর্বাবস্থা নির্ণয়ের পরীক্ষাসমূহ করান না।

নিচের পরীক্ষা সমূহের মাধ্যমে ক্যান্সারের পূর্বাবস্হা নির্ণয় করা যায়
১. (VIA -Visual inspection with acitic acid) ভায়া পরীক্ষা- যেকোন প্রশিক্ষিত স্বাস্হ্যকর্মী কয়েক মিনিটে এটি করতে পারেন। অথবা পেপ টেস্ট (PAPs smear test) যেটির জন্য ল্যাব দরকার হয়।
২.কল্পোস্কোপি: পূর্বোক্ত পরীক্ষায় সন্দেহজনক কিছু পাওয়া গেলে কল্পোস্কোপির মাধ্যমে বায়োপসি নিয়ে ক্যান্সারের  ‍পূর্বাবস্থা নির্ণয় করা যায় ও সাথে সাথে চিকিৎসাও করা যায়। দেশের বড় হাসপাতালগুলোতে বিনামূল্যে করার ব্যবস্থা রয়েছে।
৩. HPV DNA পরীক্ষা- যেটির জন্য ল্যাব দরকার হয়। তুলনামূলকভাবে ব্যয়বহুল।
উপরোক্ত পরীক্ষাসমূহের মাধ্যমে সমন্বিতভাবে ক্যান্সারের পূর্বাবস্থা নির্ণয় করা হয় এবং
প্রয়োজনীয় চিকিৎসার মাধ্যমে রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যায়।

পরীক্ষার নিয়মাবলী:
-যাদের বয়স ৩০ বৎসর বা তৎউর্ধ /বিবাহিত জীবন ১০ বৎসরের বেশি
-যারা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে আছেন
-মাসিকের দশম থেকে ২০তম দিনের মধ্যে (মাসিক ঋতুস্রাব চলাকালীন করা উচিত নয়)
-পরীক্ষার আগে স্বামী সহবাস কিংবা যোনী পথে কোনো ওষুধ ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে
-ভায়া পরীক্ষা নিকটবর্তী স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই বিনামূল্যে করা যাবে।
-এই পরীক্ষা নিরাপদ ও ব্যথামুক্ত, এতে শরীরের কোনো ক্ষতি হয় না।
-পরীক্ষার ফলাফল নেগেটিভ হলে ও প্রতি ৩-৫ বৎসর অন্তর VIA করতে হবে।

প্রতিরোধ কিভাবে করা যায়
-সর্বোত্তম পদ্ধতি হলো কিশোরী মেয়েদের ১৫ বৎসরের মধ্যে (যৌন সংসর্গের পূর্বেই ২ মাস অন্তর) এইচপিভি ভাইরাসের বিরুদ্ধে দুই ডোজ টিকা নেওয়া (দুই রকম টিকা-Cervarix, Gardacil) আমাদের দেশে বেসরকারি টিকা কেন্দ্রে পাওয়া যায়। অচিরেই সরকারি টিকাদান কর্মসূচিতে এইটি অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
-যুবতী নারীদের ২৬ বৎসর বয়সের মধ্যে ( ৩ ডোজ) টিকা নেওয়া।
-বাল্য বিবাহ/অল্প বয়সে শারীরিক সম্পর্ক পরিহার।
-বিশ্বস্ত জীবনসঙ্গী ও নিরাপদ যৌন জীবন।
-অধিক সন্তান না নেওয়া।
-স্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন।
-নিয়ম মাফিক জরায়ু মুখ ক্যান্সারের পরীক্ষা (স্ক্রিনিং টেস্টসমূহ)।
-নির্ধারিত চিকিৎসাগ্রহণ।

ক্যান্সারের লক্ষণসমূহ:
-স্বামী সহবাসের পরে যোনী পথে রক্তপাত অন্যতম প্রধান লক্ষণ
-যোনী পথে রক্ত মিশ্রিত সাদা স্রাব
-অতিরিক্ত সাদা স্রাব/ ও গন্ধযুক্ত স্রাব যাওয়া
-মেনোপজ বা মাসিক স্থায়ীভাবে বন্ধের পরবর্তী রক্তক্ষরণ
-দ্রুত ওজন কমা/অতিরক্ত কোমর ব্যথা/পায়ে পানি জমে ফুলে যাওয়া।
-যোনী পথে মল-মূত্র বের হওয়া
উপরোক্ত সমস্যা দেখা দিলে স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে যিনি বায়োপসি ও অন্যান্য পরীক্ষার মাধ্যমে ক্যান্সার স্টেজ নির্ধারণ করে অপারেশন কিংবা কেমো রেডিয়েশনের পরামর্শ দেবেন।

পরিশেষে জরায়ু মুখের ক্যান্সারে টিকা দিয়ে বেশিরভাগ প্রতিরোধ করা যায় এবং পূর্বাবস্থা নির্ণয় করা যায় ভায়া নামক অতি সহজ একটি পরীক্ষার মাধ্যমে। পূর্বাবস্থা থেকে পূর্ণাঙ্গ ক্যান্সারে রূপান্তরিত হতে কমপক্ষে ১০ বছর লাগে- এই সময়ের মধ্যে সচেতন হয়ে এই রোগ নির্মূল করা যায়। কাজেই সর্বস্তরের সচেতনতাই পারে আমাদের দেশের নারীদের এই ক্যান্সারমুক্ত রাখতে। 

উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারীদের উৎসাহিত করে টিকা গ্রহণ ও স্ক্রিনিং টেস্টের আওতায় আনতে পারলে এই ক্যান্সার সচেতনতা মাস তথা প্রতিরোধ সপ্তাহ পালন সফল হবে।

তথ্যসূত্র: টেক্সটবুক অব গাইনোকোলজ (ডিসিদত্ত) / ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর ক্যান্সার রিসার্চ/বিএসএমএমইউর প্রতিবেদন

লেখক: প্রাক্তন অধ্যাপক, প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট, অবস ও গাইনী সোসাইটি, চট্টগ্রাম

পূর্বকোণ/এএইচ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট