চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

রকমারী ভ্যারিয়েন্টে করোনা: স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণে গুরুত্ব দিতে হবে

অধ্যক্ষ এম ইব্রাহীম আখতারী

১৪ জুন, ২০২১ | ৬:১৭ অপরাহ্ণ

বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাসের প্রথম দফার ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞের নির্মম ক্ষতচিহ্ন এখনও শুকায়নি। পরিপূর্ণ অবসান হয়নি বিশ্বব্যাপী সৃষ্ট অচলাবস্থার। এখনও গতি ফিরে আসেনি বিধ্বস্ত বিশ্ব অর্থনীতিতে। অদ্যাবধি ইন্দ্রীয় চৈতন্য ফিরে পায়নি স্বজনহারা অসংখ্য বনি আদম। এরই মধ্যে অভিশপ্ত এ অদৃশ্য ভাইরাসের ২য় ঢেউয়ের কবলে পতিত হয়েছে তাবৎ দুনিয়া। দীর্ঘ টানা ১৮ মাস বিশ্বব্যাপী তাণ্ডব চালানোর পরও করোনাভাইরাস এর চোখ রাঙানি মোটেও থামেনি। বরং ক্রমাগত ধরণ পাল্টিয়ে পূর্বাপেক্ষা অধিক শক্তিসমেত বিভিন্ন ভ্যারিয়েন্টে হানা দিচ্ছে বিশ্বের দেশে দেশে। অদম্য গতিতে অব্যাহত রেখেছে ভয়াল তাণ্ডবলীলা। যার অশুভ পরিণতির শিকার হয়ে পুনরায় পর্যুদস্ত বিশ্ব। আবারও অবাঞ্ছিত আতংক, শংকা ও হতাশার আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়েছে বিশ্ববাসী।

সম্প্রতি বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে করোনা সংক্রমণের বিস্ফোরণ ঘটে। ভারতে এ পর্যন্ত প্রায় আড়াই কোটির অধিক মানুষের সংক্রমণ ধরা পড়েছে এবং মারা গেছে প্রায় ৩ লাখ এর কাছাকাছি মানুষ। দৈনিক করোনা শনাক্ত রোগীর সংখ্যায় ভারত বিশ্বরেকর্ড করে। গত ১৫ এপ্রিল থেকে প্রতিদিন নতুন কোভিড রোগী শনাক্তের সংখ্যা দুই লাখের অধিক। অথচ গত বছর প্রথম দফা সংক্রমণের সময় দৈনিক সংক্রমণের সর্বোচ্চ সংখ্যা ছিল ৯৩ হাজার। কোভিড-১৯ এর দ্বিতীয় ঢেউয়ের তীব্রতায় প্রায় বিপর্যস্ত ভারত। গত বছরের অক্টোবর মাসে ভারতে প্রথম শনাক্ত হয় বি.১.৬১৭ নামক করোনা ভ্যারিয়েন্ট। আলোচনার সুবিধার্থে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটিকে ডেল্টা নামে অভিহিত করেছে।

পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য মহারাষ্ট্রে গত জানুয়ারী থেকে মার্চ পর্যন্ত ৩৬১টি নমুনা পরীক্ষায় ২২০টির মধ্যে নতুন ধরনের এই ভাইরাসটি শনাক্ত হয়। ভারতের এহেন রেকর্ড সংক্রমণের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এ নতুন ধরনকেই। অতঃপর অনেকটা এরকমেরই এক ভ্যারিয়েন্ট দৃশ্যমান হয় যুক্তরাজ্যে। বিগত ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে ১০৩ জন কোভিড রোগীর দেহে এই ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। যুক্তরাজ্যে শনাক্ত হওয়া করোনার নতুন ধরনটি ‘বি.১.১.৭’ নামে পরিচিত। যৎকারণে ভারত থেকে যুক্তরাজ্য ভ্রমণ প্রায় নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্যবিভাগ এটিকে ‘ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন’ বা উদ্বেগজনক ধরন হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। যুক্তরাজ্য থেকে সাংহাইয়ের একটি বিমানবন্দরে অবতরণকৃত একটি ফ্লাইটআরোহী নারীর দেহে সর্বপ্রথম করোনার এ নতুন ভ্যারিয়েন্টের অস্থিত্ব পাওয়া যায়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ঐ নারীর ফ্লাইট চীনে অবতরণের দু’দিন পূর্বেই তিনি করোনা পজিটিভ হয়েছিলেন। যাতে দেখা যায় ইতোপূর্বে সাংহাইয়ে সংক্রমতি হওয়া করোনা ও উহানের ধরনের চেয়ে এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। যুক্তরাজ্যে করোনার নতুন এ ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার কারণে গত ২৪ ডিসেম্বর ’২০ থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য দেশটির সঙ্গে সরাসরি ফ্লাইট স্থগিত করে চীন। এছাড়াও বিশ্বের অনেক দেশ যুক্তরাজ্যে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দেয়। উল্লেখ্য, গত অক্টোবর ’২০ থেকেই দেশটিতে করোনার নতুন ধরনের সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। পরবর্তীতে যুক্তরাজ্য ছাড়াও বিশ্বের আরও অনেক দেশে করোনার এই নতুন ধরন শনাক্ত হয়।

আন্তর্জাতিক সংস্থা জিআইএসএইড-এর ডাটাবেজ অনুসারে, এরই মধ্যে কমপক্ষে ২১টি দেশে করোনাভাইরাসের ভারতীয় ভ্যারিয়েট শনাক্ত হয়েছে। এছাড়া করোনা ভাইরাসের একটি নতুন ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত করেছে ভিয়েতনাম। বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেন এটি করোনার ভারত ও যুক্তরাজ্যে পাওয়া ভ্যারিয়েন্টের সংমিশ্রণ। করোনার ‘হাইব্রিড’ এ ভ্যারিয়েন্ট বাতাসের মাধ্যমে দ্রুত ছড়াতে পারে বলেও তাঁরা মত প্রকাশ করেন। এছাড়াও যুক্তরাজ্যের চেয়ে করোনার ভারতীয় ধরনটি অপেক্ষাকৃত অধিক সংক্রামক বলেও উল্লেখ করেন।

এদিকে এ ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে পার্শবর্তী রাষ্ট্র বাংলাদেশেও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। কারণ ইতোমধ্যে ভারত থেকে আসা ৩ জন বাংলাদেশীর দেহে করোনা ভাইরাসের এ ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে মর্মে গত ৮ মে ২১ইং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক তথ্যে জানা যায়। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আইদেশি এর সমন্বয়ে গত মে এর মাঝামাঝি থেকে যেসব করোনাভাইরাসের জেনোম সিকোয়েন্স করেছে, তন্মধ্যে ৮০ শতাংশই ভারত ভ্যারিয়েন্টের অনুরূপ বলে উল্লেখ করা হয়।

আইইডিসিআর সূত্রে জানা যায় যে, তারা ৫০টি নমুনার জেনোম সিকোয়েন্স করেছে, তন্মধ্যে ৪০টিই হচ্ছে ভারত ভ্যারিয়েন্ট ‘ডেল্টা’। এছাড়া ৮টি বেটা ভ্যারিয়েন্ট সাউথ আফ্রিকায় পাওয়া ধরন বি. ১.৩৫১ এর ন্যায়। ১টি হচ্ছে সার্কুলেটিং স্ট্রেইন এবং আরেকটি হচ্ছে আনআইডেন্টিফাইড বি.১.১.৩১৮। এ পর্যন্ত যতগুলো নমুনায় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট এর অস্থিত্ব পাওয়া গিয়েছে এসবের ৩৫ শতাংশই বাংলাদেশের বাইরে ভ্রমণ কিংবা বিদেশ থেকে আসা কারও সংস্পর্শে যাওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। যৎকারণে বাংলাদেশে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়েছে বলে ধারণা করছে আইইডিসিআর। অনস্বীকার্য বাস্তবতা হলো-করোনাভাইরাস প্রতিনিয়ত  পরিবর্তিত হয়ে নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্ট তৈরি করতে পারঙ্গম।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন-২০২০ সালের জানুয়ারিতে করোনা শনাক্ত হওয়ার পর থেকে এযাবত এ অদৃশ্য ভাইরাসের অসংখ্য মিউটেশন চিহ্নিত করা হয়েছে। ভারতের এ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট মানুষের দেহের এন্টিবডিকে পাশ কাটিয়ে যেতে ভাইরাসকে সাহায্য করতে সক্ষম। যাইহোক, ইতোমধ্যে বাংলাদেশের খুলনা ও রাজশাহী জেলার সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে বেশ কিছুদিন যাবত করোনা সংক্রমন উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ভারতের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ এক্ষেত্রে কোনভাবেই ঝুঁকিমুক্ত নয়। করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ঠেকাতে বাংলাদেশ ইতোপূর্বে দুই সপ্তাহের জন্য সীমান্তে পণ্যবাহী যান ছাড়া সব ধরনের যাতায়াত বন্ধের সিদ্ধান্ত নিলেও এর মধ্যে অনুমতি নিয়ে অনেকেই দেশে ফিরেছেন। যা মোটেও ইতিবাচক নয়। মূলতঃ এ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিস্তৃতি রোধে বিশেষতঃ সীমান্ত এলাকায় নজরদারি বৃদ্ধি সহ কঠোর সাবধানতা অবলম্বন করা বাঞ্ছনীয় বলে মনে করি। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা করোনাভাইরাস এর সুনির্দিষ্ট মেয়াদকাল সম্পর্কে সন্দিহান। সুতরাং এ অদৃশ্য ভাইরাসকে সঙ্গী করেই বসবাস করতে হবে। প্রত্যেকেই ভ্যাকসিনেসনের আওতায় আসলেই সংক্রমণমুক্ত এমনটি নয়। ভ্যাকসিন গ্রহণের পরও সকলেরই পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্যবিধির অনুসরণ বাঞ্ছনীয় বলে মত ব্যক্ত করেন চিকিৎসকরা। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশে পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্যবিধির অনুসরণে পরিলক্ষিত হয় অধিকাংশেরই অবহেলা ও উদাসীনতা। যেমন- মাস্ক ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রায় ৫০ শতাংশেরও অধিক মানুষের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান হয় অনীহা। আবার যারা ব্যবহার করেন তাদের মধ্যে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটে অনেকেরই। সংগতকারণে একটি কথা না বললেই নয় যে, ইদানিংকালে বাংলাদেশের অনেকেরই মধ্যে কেমন যেন করোনা ভীতি অনেকটা লোপ পেয়েছে। ইচ্ছেকৃতভাবেই মানছে না স্বাস্থ্যবিধি। এমনকি কেউ কাউকে মাস্ক ব্যবহারের পরামর্শ দিলেও অনেককে ক্ষেপে যেতেও দেখা গেছে।

অনেকেই বিভিন্ন খোঁড়া যুক্তি দিয়ে অযাচিত বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে। আবার অনেকেই এমনটিও বলে থাকেন মৃত্যু যেহেতু অবধারিত, সেহেতু এসবের প্রয়োজন নেই। দু’দিন আগে অথবা পরে মৃত্যুর স্বাদ তো গ্রহণ করতেই হবে। অন্যদিকে কেউ কেউ এমন ফতোয়াবাজিও করে থাকে যে, ইসলামে ভাইরাস অর্থাৎ ছোঁয়াছে বলতে কোন কিছুই নেই। যাইহোক, এদিকে করোনা সংক্রমণ রোধে চলমান লকডাউন এর সময়সীমা আগামী ১৬ জুন পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিয়ে লকডাউনের ঘোষণা দেয়া হলেও এক্ষেত্রেও তা লঙ্ঘিত হয়ে থাকে নির্দ্বিধায়। ফলশ্রুতিতে এধরণের নেতিবাচক ও বেপরোয়া মনেবৃত্তি নিশ্চিতভাবে সামাজিক অবস্থাকে সংকটাপন্ন করে তুলতে পারে।

উল্লেখ্য যে, ভারতে এখন যে উঁচু মাত্রার সংক্রমণ অব্যাহত রয়েছে, তার নেপথ্যে সামাজিক দূরত্ব না মানা এবং মাস্ক ব্যবহারে শৈথিল্যতা প্রদর্শনের মত আচরণকে অনেকটা দুষছেন বিশেষজ্ঞরা। এ অভিশপ্ত ভাইরাসের প্রতিষেধক না থাকায় এর প্রতিরোধে সর্বোচ্চ সতর্কতা ও সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে। মাস্ক এর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরী। কারণ মাস্ক ব্যবহারকেই করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধের অন্যতম কার্যকর উপায় বলে একমত হয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ উন্নত দেশগুলোর স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্থাগুলো। অতএব, জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থে শতভাগ মাস্ক ব্যবহার, অকারণে ঘরের বাইরে যাওয়া, জনসমাগম এড়িয়ে চলাসহ গণপরিবহন তথা সর্বত্র সামাজিক দূরত্ব মানার বিষয়সমূহ কঠোরভাবে প্রশাসনিক নজরদারির আওতায় আনা অত্যাবশ্যক।

পূর্বকোণ/মামুন

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট