চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

মেহরারাও কানে শুনবে

ইমাম হোসাইন রাজু

২৪ মার্চ, ২০২১ | ১:৩২ অপরাহ্ণ

তিন বছরের শিশু জাহান মেহরা। ছোটবেলা থেকেই কানের সমস্যায় ভুগছিল মিরসরাই উপজেলার এ শিশুটি। শ্রাবণ শক্তি ফিরে পেতে ঘুরতে হয়েছে হাসপাতাল ও চিকিৎসক চেম্বারেও। সবশেষ চট্টগ্রাম সিএমএইচ হাসপাতালে সদ্য স্থাপিত কক্লিয়ার সেন্টারে চিকিৎসকের পরামর্শে কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট সার্জারি করার সিদ্ধান্ত নেন পরিবার। গেল ১৮ জানুয়ারিতে ছোট্ট এ শিশুর কানে  অস্ত্রোপচার হয় । বসানো হয় কক্লিয়ার ডিভাইস। আশার খবর হচ্ছে, জাহান মেহরা বর্তমানে সুস্থ। ফিরে পেয়েছেন শ্রাবণ শক্তিও। যাতে খুশি তার পরিবার।

শুধু জাহান মেহরাই নয়। ১৮ জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত শ্রাবণ শক্তি নেই এমন ২৭ জনের কানে সফল অস্ত্রোপচার হয় চট্টগ্রাম সিএমএইচ’র কক্লিয়ার সেন্টারে। ইতোমধ্যে ১৩ জনই তাদের শ্রাবণ শক্তি ফিরে পেয়েছেন। আছেন স্বাভাবিকও। সফল কক্লিয়ার সার্জারির বাকি ১৪ জনেরও আগামী সপ্তাহে ডিভাইস সচল করা হবে। অর্থাৎ তারাও তাদের শ্রাবণ শক্তি ফিরে পাবেন। এছাড়া আরও ৭৮ জন শিশুও কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট সার্জারির অপেক্ষায় রয়েছে। তাদের ইতোমধ্যে সকল ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজও শেষ হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক।

সুখবর হচ্ছে, কক্লিয়ার ডিভাইস বসাতে যেখানে প¦ার্শবর্তী ভারতে ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা খরচ হয়। কিংবা সিঙ্গাপুরে ৭০ থেকে ৮০ লাখ টাকা অথবা ইউরোপ-আমেরিকায় ১ কোটি ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ হচ্ছে। সেখানে প্রায় ৭ লাখ টাকা মূল্যের এ ডিভাইসটি বিনামূল্যে বসানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছে সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। এমন কার্যক্রম চালু হয়েছে চট্টগ্রাম সিএমএইচ’র কক্লিয়ার সেন্টারে।

সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ) ক্লাসিফাইড ইএনটি বিশেষজ্ঞ, হেড-নেক ও কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট সার্জন ডা. লেঃ কর্নেল মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘সমাজকল্যান মন্ত্রণালয়ের ২০২০-২০২১ অর্থ বছর হতে প্রাপ্ত বরাদ্দ থেকে কক্লিয়ার ডিভাইসটি বিনামূল্যে সরবরাহ করছে। ফলে শ্রাবণ প্রতিবন্ধি রোগীরা বিনামূল্যেই এ সেবা নিতে পারবেন।’

তিনি আরও বলেন, শ্রাবণ প্রতিবন্ধি বা বধির বলতে কিছুই নেই। মূলত মানুষের কানের তিনটি অংশের একটি অন্তঃকর্ণের ভেতর শামুকের মতো দেখতে যে নালিটি থাকে, সেখানে বালুকণার চেয়ে ছোট কিছু কোষ থাকে। আর এই কোষগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলে মানুষ আর শুনতে পায় না। কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট নামের এই যন্ত্রটি প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে মানুষ তার শ্রাবন ক্ষমতা ফিরে পেতে পারে।

কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট কী?

কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট বা বায়োনিক ইয়ার হলো শ্রবণ সহায়ক অত্যাধুনিক এমন একটি ইলেকট্রনিক ডিভাইস। যা মারাত্মক বা সম্পূর্ণ বধির ব্যক্তিকে শব্দ শুনতে সহায়তা করে।  ইমপ্লান্ট চালুর পর বধির ব্যক্তির কাছে তখন পৃথিবীটা শব্দময় হয়ে ওঠে। কক্লিয়ার ইমপ্লান্টের দুটি অংশ- একটি অংশ কানের বাইরে থাকে, যে অংশে থাকে মাইক্রোফোন, স্পিচ প্রসেসর ও ট্রান্সমিটার এবং আরেকটি অংশ কানের ভেতরে থাকে, যে অংশে রিসিভারস্টিমুলেটর এবং ইলেকট্রোড থাকে। সাধারনত ৮ বছরের নিচে সকল জন্মগত বধির বা শ্রবণ প্রতিবন্ধি এবং প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ১০ বছরের মধ্যে শ্রবনশক্তি হারানো ব্যক্তিরা ককলিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জারির মাধ্যমে শ্রবনশক্তি ফিরে পেতে পারে।

যাদের এ যন্ত্র বসালে ফল আসবে :

ডা. দেলোয়ার হোসেন বলেন, শ্রবন প্রতিবন্ধীদের মধ্যে দুই ধরনের রোগী আছে। এরমধ্যে জন্মগতভাবে বধির বা বোবা। অর্থাৎ শিশুদের। যাদের বয়স সর্বোচ্চ আট বছর। তবে এসব শিশুদের ক্ষেত্রে ৫ বছর বয়সের মধ্যেই যদি সার্জারি করে ডিভাইসটি স্থাপন করা যায়, তাহলে তাদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ফল বেশি পাওয়া যায়।

অন্যদিকে, প্রাপ্ত বয়স্কদের যারা কোন না কোনভাবে তাদের শ্রবন শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। যেমন ইনফেকশন, ট্রমা, ভাইরাল ইনফেকশন, সাউন্ড, বোম ব্লাস্ট, কেমো থেরাপি, রেডিও থেরাপি, বিভিন্ন ড্রাগ ব্যবহার, নিউমোনিয়ার কারণে। তারা শ্রবন শক্তি হারানোর ১০ বছরের মধ্যে সার্জারি করে ডিভাইসটি বসালে ফল পাওয়া যাবে।

কোথায় পাওয়া যাবে এমন সেবা :

চট্টগ্রাম সিএমএইচ-এ কক্লিয়ার সেন্টারের আওতায় এমন সেবা দিয়ে যাচ্ছেন চিকিৎসকরা। কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট সার্জন ডা. লে. কর্নেল মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বলেন, এমন সার্জারি করতে অত্যাধুনিক সব যন্ত্রপাতি যুক্ত আছে। আলাদা কক্লিয়ারি অপারেশন থিয়েটার, থেরাপি ইউনিট, ইএনটির বিভিন্ন ধরণের পরীক্ষা নিরীক্ষাসহ যাবতীয় সব সেবা রয়েছে। এরবাইরে ঢাকার সিএমএইচ-এ বহু আগেই এমন সেবা কার্যক্রম চলমান। বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের শ্রবন প্রতিবন্ধিরা সেবাটি চট্টগ্রাম সিএমএইচ-এ গ্রহণ করতে পারবেন। প্রয়োজন হলে সরাসরি সকাল আটটা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত কক্লিয়ার সেন্টারে এসে অথবা ০১৭৬৯-২৪৩০০৪ এ নম্বরে যোগাযোগ করে সেবাটি গ্রহণ করতে পারবে।

সার্জারির পর কী যা করতে হবে :

কক্লিয়ার সার্জন ডা. দেলোয়ার বলেন, সফল অস্ত্রোপচারের পর রোগীকে তিন থেকে চার দিনের মধ্যেই ছাড়পত্র দেয়া হয়ে থাকে। যারা সাধারণত তিন সপ্তাহ পর ফলোআপে আসবে। এরপরই কক্লিয়ার ডিভাইসটি চালু করা হয়ে থাকে। ডিভাইসটি চালুর পর শিশুরা শুনতে পারলেও তাদের একবছরের ফলোআপে থাকতে হবে। যেখানে কক্লিয়ার সেন্টারে বিশেষ কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে ভাষাসহ স্বাভাবিক জীবনে আসা পর্যন্ত এক ঘণ্টা করে সপ্তাহে দুই বা তিনদিন প্রশিক্ষন দেয়া হবে। প্রশিক্ষণ দিবেন বিদেশ থেকে প্রশিক্ষন প্রাপ্তরা। এক বছরের মধ্যেই তারা স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে ও শুনতে পারবে। এবংকি অন্যদের মতো স্বাভাভিক স্কুলেও পড়াশোনা করতে সক্ষম হবে তারা।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট