চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

যে কারণে সকলের টিকা নেয়া জরুরি

শিহাবুল ইসলাম

৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ | ৯:২৫ অপরাহ্ণ

করোনাভাইরাস মহামারীতে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয় পুরো বিশ্ব। ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে প্রায় প্রত্যেক দেশের মানুষই বাড়িতে বন্দি থাকার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। আমরাও কোয়ারেন্টিন, আইসোলেশন, সামাজিক দূরত্ব পালন ও মাস্ক ব্যবহারের মতো নতুন নতুন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এ পরিস্থিতিতে মহামারী থেকে সম্ভাব্য একমাত্র মুক্তির উপায় হিসেবে আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল করোনার টিকা। কিন্তু টিকা আসার পর নতুন এক সংকট তৈরি হয়েছে। টিকা গ্রহণ নিয়ে মানুষ শঙ্কা ও দ্বিধায় পড়ে গেছেন। 

বাংলাদেশে করোনার টিকা আসার খবরে বন্ধু-বান্ধব ও সহকর্মীদের মধ্যে দেখলাম কে টিকা নিতে আগ্রহী আর কে আগ্রহী নয়- তা নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে। ২৭ জানুয়ারি দেশে করোনার টিকা প্রয়োগ শুরুর পর পরিচিতজনদের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া কারোর মধ্যেই টিকা নেয়ার কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। টিকা নিতে সবার মধ্যেই কেমন একটি আতঙ্ক, শঙ্কা ও দ্বিধা কাজ করছে। যদিও এটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তীত হতে পারে। কারণ তারা একটি কথা বলছেন, প্রথম পর্যায়ে টিকা নেয়া মানুষদের অভিজ্ঞতা দেখে তারা টিকা গ্রহণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। যদিও দেশে এখনো সবার জন্য টিকাদান কার্যক্রম শুরু হয়নি। 

গত রোববার প্রকাশিত বণিক বার্তার একটি প্রতিবেদনেও টিক গ্রহণে ধীরগতির বিষয়টি উঠে এসেছে। ২৭ জানুয়ারি টিকা প্রয়োগ কার্যক্রমের উদ্ভোধনের দিন ২৬ জন এবং পরদিন আরো ৫৪১ জনকে টিকা দেয়া হয়। উদ্বোধনের দিন বিকাল থেকেই টিকা গ্রহণে নিবন্ধনের জন্য সুরক্ষা ওয়েবসাইট উন্মুক্ত করা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে জানা গেছে, গতকাল বুধবার পর্যন্ত ৮৬ হাজারের বেশি মানুষ সুরক্ষা ওয়েবপোর্টালে টিকা নেওয়ার জন্য নিবন্ধন করেছেন। স্বাস্থ্যকর্মী, সাংবাদিক, সরকারি কর্মকর্তা, পুলিশসহ অন্যান্য সম্মুখসারির করোনা যোদ্ধারা ছাড়া প্রথম পর্যায়ে ৫৫ বছর বয়স-ঊর্ধ্ব ব্যক্তিরা নিবন্ধনের সুযোগ পাচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে দেশে টিকাদান কার্যক্রম দ্রুত এগিয়ে যাওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। নিবন্ধনের গতি এমন শঙ্কায় উস্কে দিচ্ছে। 

সম্প্রতি একটি জরিপেও এমন চিত্র উঠে এসেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের একটি জরিপে উঠে এসেছে, দেশের ৩২ শতাংশ মানুষ টিকা কার্যক্রম শুরুর সঙ্গে সঙ্গে টিকা নিতে আগ্রহী। আগ্রহী আরো ৫২ শতাংশ মানুষ আছেন, তবে তারা ঠিক এ মুহূর্তে টিকা নিতে রাজি নন। বরং তারা কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে তবেই টিকা নিতে আগ্রহী। দেশের বিভিন্ন জায়গার প্রায় ৩ হাজার ৫০০ লোকের ওপর জরিপ চালিয়ে এ ফলাফল পাওয়া গেছে। 

এর আগে বেসরকারি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় উঠে এসেছিল, দেশের অন্তত ৭৫ শতাংশ মানুষ টিকাগ্রহণে আগ্রহী। 

কিন্তু করোনার টিকাগুলোই যেখানে শতভাগ কার্যকরী নয়, সেখানে জনসংখ্যার এমন খণ্ডিত অংশের টিকা নেয়া স্বাভাবিকভাবেই সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে যথেষ্ট হবে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সংক্রমণ ছড়ানোকে বাধাগ্রস্ত করতে হলে একটি দেশের সাধারণত ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ মানুষকে টিকা নিতে হবে। কিন্তু শিশু, গর্ভবতী মা ও অন্যান্য স্বাস্থ্য জটিলতায় থাকা লোকেরা এমনিতেই টিকাদান কার্যক্রম থেকে বাদ পড়বেন। তারউপর সুস্থ মানুষদের একটি অংশ যদি টিকা নেয়া থেকে বিরত থাকেন, তবে দেশজুড়ে সুরক্ষাবলয় তৈরি হওয়া সম্ভব নয়। ফলে টিকাদান কার্যক্রমের পরও করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে পারে। 

এখন পর্যন্ত বিশ্বের কোনো দেশে টিকা নেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে বলে খবর পাওয়া যায়নি। জটিল স্বাস্থ্য সমস্যা ছাড়া সবাইকে এ টিকা নিতে উত্সাহিত করা হচ্ছে। মহামারী থেকে উত্তরণে এ টিকাকে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে উল্লেখ করেছে মার্কিন রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি)। স্বাস্থ্য সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, এ টিকা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া থেকে রক্ষা করে। পাশাপাশি অন্যকেও সুরক্ষিত রাখতে সহায়তা করে। সুতরাং টিকা নেয়ার অর্থ হলো, নিজের পাশাপাশি পরিবার ও আশেপাশের মানুষকেও আপনি সুরক্ষিত করছেন। অন্যদিকে টিকা না নেয়ার সিদ্ধান্তটি আপনার পাশাপাশি অন্যদের জন্যও ঝুঁকি তৈরি করছে। কারণ ২০১৯ সালে শেষদিকে চীনের উহানে মাত্র কয়েক জনের থেকেই ভাইরাসটি পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। অর্থাৎ আপনার টিকা নেয়ার বিষয়টি ব্যক্তিগত, পরিবার, সম্প্রদায়, দেশ এমনকি বিশ্বের সঙ্গে জড়িত। 

অনেক মানুষ অবশ্য দ্রুততার সঙ্গে করোনার টিকা উদ্ভাবন নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। যদিও এটা সত্য যে একটি টিকা তৈরিতে কয়েক বছর থেকে দশক পর্যন্ত সময় লাগে। তবে করোনার ক্ষেত্রে বৈশ্বিক স্বার্থে কাজ করার কারণে টিকা আবিষ্কার দ্রুততর হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিজ্ঞানী গোষ্ঠী ও স্বাস্থ্য সংস্থাগুলো কাজে সমন্বয়ের মাধ্যমে এটি করা সম্ভব হয়েছে। 

এখন টিকাদান কর্মসূচি কোটি কোটি মানুষের মধ্যে করোনার সংক্রমণ ঠেকিয়ে দেবে এবং হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের পথ তৈরি করবে। এখানে আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে, যত দ্রুত আমরা এটি অর্জন করতে পারবো, ঠিক তত দ্রুতই আমরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবো। 

গত ১০০ বছরে রোগ প্রতিষেধক টিকার কারণে কোটি কোটি মানুষের জীবনরক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও টিকা নেয়া না নেয়ার প্রশ্নে এক ধরনের সংশয় বা অস্থার অভাব দেখা যাচ্ছে। আর এ সংশয় আরো বাড়িয়ে দিয়েছে সাম্প্রতিক এক খবর। ইউরোপের দেশ নরওয়েতে ফাইজারের টিকা নেয়ার পর অন্তত ২৩ জনের মৃত্যু হয়। এ খবরটি নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে আলোচনা করলেও এখানে অনেকেই এড়িয়ে গেছেন যে, যারা মারা গেছেন, তাদের সবার বয়সই ৮০ বছরের ওপরে। দেশটির কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে ব্লুমবার্গের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ ঘটনার পর দেশটিতে অতিবৃদ্ধ ও দীর্ঘমেয়াদে অসুস্থ মানুষদের ক্ষেত্রে ফাইজারের টিকা ‘মারাত্মক ঝুঁকি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যদিও বিজ্ঞানীরা আগে থেকেই বলছেন, করোনার এ টিকা দীর্ঘমেয়াদে অসুস্থদের জন্য বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। 

জানুয়ারিতে টিকাদান কার্যক্রম শুরু করা আমাদের প্রতিবেশী ভারতেও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার খবর পাওয়া গেছে। এসব প্রতিক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে- জ্বর, মাথাব্যথা ও বমিভাব। এগুলোকে অ্যাডভার্স ইভেন্ট ফলোইং ইমিউনাইজেশন (এইএফআই) বলে বর্ণনা করা হচ্ছে, যার সঙ্গে টিকার সরাসরি সম্পর্ক নাও থাকতে পারে। এছাড়া উত্তরপ্রদেশের একটি সরকারি হাসপাতালের ৪৬ বছর বয়স্ক একজন কর্মী টিকা নেয়ার ২৪ ঘণ্টা পর মারা যান। তবে জেলার প্রধান মেডিকেল অফিসার বলেছেন, টিকা নেয়ার সঙ্গে এ মৃত্যুর কোনো সম্পর্ক নেই। 

একটা বিষয় সকলের মনে রাখা প্রয়োজন যে, সব ওষুধের কিছু না কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে। তাই বলে তো আমরা ওষুধ খাওয়া ছেড়ে দিতে পারি না বা ছেড়ে দিইনি। টিকার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়। যদিও টিকার ক্ষেত্রে ব্যাপক পরীক্ষা চালানো হয়, যাতে এটিকে নিরাপদ ও কার্যকর করা যায়। ইন্টারনেটের এ যুগে টিকার ব্যাপারে মানুষের উদ্বেগ ও অবিশ্বাস মুহূর্তের মধ্যেই অনেকের সঙ্গে শেয়ার করা যায়। ফলে টিকা সম্পর্কে এমন সব কথা ছড়িয়ে পড়ে, যা মোটেও তথ্যনির্ভর নয়। 

এদিকে টিকা নিবন্ধনের জন্য তৈরি করা সুরক্ষা অ্যাপ ও ওয়েবসাইটের ক্ষেত্রেও জটিলতা রয়েছে। এক্ষেত্রে অনেক মানুষের জন্যই অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করা বাড়তি ঝামেলার। কারণ আমাদের দেশের বৃহত্তর একটি গোষ্ঠী এখনো ইন্টারনেট ব্যবহারের বাইরে রয়ে গেছেন। আবার অনেকেই রেজিস্ট্রেশন করতে গিয়ে নানা সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। এজন্য শুধুমাত্র জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়েই টিকাদান কর্মসূচি করা হলে সবার জন্যই সহজ হতো। 

সর্বোপরি টিকাদানে বিস্তৃত মানুষকে যুক্ত করতে এখন ব্যাপকভাবে প্রচারের প্রয়োজন। টিকা সম্পর্কে মানুষের ভ্রান্ত ধারণার পরিবর্তে সঠিক বিষয়গুলো জানানো হলে তাদের শঙ্কা দূর হবে। এক্ষেত্রে সরকারকে মূল ভূমিকায় নামতে হবে। পাশাপাশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবেও মানুষকে টিকাদানে উদ্ভূদ্ধ করতে হবে। এজন্য টিকাদান নিয়ে যেটাই ঘটুক না কেন, সরকারকে স্বচ্ছ থাকতে হবে। কারণ তথ্যের ঘাটতি সৃষ্টি হলেই সেখানে নানারকম গুজবের সৃষ্টি হতে পারে। ফলে মাঝপথে টিকাদান কর্মসূচি ব্যাহত হতে পারে। সূত্র: বণিকবার্তা

লেখক: সংবাদকর্মী

পূর্বকোণ/পি-আরপি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট