চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

করোনার টিকা নিয়ে যত কথা

অধ্যাপক প্রদীপ কুমার দত্ত

২ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ | ১২:২৮ অপরাহ্ণ

ভ্যাক্সিন নিয়ে বিশ্বব্যাপী এক মহাযজ্ঞ শুরু হয়েছে। এ নিয়ে কিছু কথা।

কোভিডের টিকা (ভ্যাক্সিন) কারা দিবেন?
ফাইজার ভ্যাক্সিন ১৬ বছরের ঊর্ধ্বে, মডার্না ও অক্সফোর্ড ভ্যাক্সিন ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে নিতে পারবে। যেহেতু কোভিড একবার হলেও আবার হতে পারে, তাই সবাইকে ভ্যাক্সিন নিতে হবে। একিউট উপসর্গের সময় সিম্পটম শেষে নির্দিষ্ট আইসোলেশন সময় পার হলে ভ্যাক্সিন নেওয়া যাবে। ভ্যাক্সিনের আগে কোভিড টেস্ট বা এন্টিবডি টেস্ট করতে হয় না। যদি কেউ কোভিডের সময় কনভালেসেন্ট প্লাজমা বা মনোক্লোনেল এন্টিবডি নিয়ে থাকেন তবে ৯০ দিন পরে টিকা নিতে হবে।

টিকা নেয়ার পরও মানতে হবে স্বাস্থ্য সুরক্ষা
কোভিড ভ্যাক্সিন নেওয়ার পরেও যদি শরীরে ইনফেকশন থাকে, কোভিড ভ্যাক্সিন নেওয়া যে কেউ কোভিড ছড়াতে পারে, তাই ভ্যাক্সিন নেওয়ার পরেও সামাজিক দূরত্ব এবং মাস্ক পরতে হবে।

ভ্যাক্সিন এলার্জি
মডার্না এবং ফাইজার ভ্যাক্সিনে ডিম, অন্যান্য সংরক্ষণকর বস্তু ও ল্যাটেক্স নেই, তাই ওসবে যাদের এলার্জি আছে তাঁরাও নিতে পারবেন। পলিসরবেট এলার্জি (যা আইসক্রিম, হিমায়িত কাস্টার্ড এবং ডেজার্ট খেলে হয়) থাকলে নেওয়া যাবে না। অক্সফোর্ড ভ্যাক্সিনে পলিসর্বেট, ইথানল ও সুক্রোস আছে, তাই এসবে যাদের এলার্জি আছে তাঁরা নেবেন না।

কতজন মানুষকে ভ্যাক্সিন দিলে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হবে?
ইনফ্লুয়েঞ্জা ৯৫% এবং পোলিও ৮০%। কিন্তু কোভিডের জন্য তা এখনও অজ্ঞাত। তাই সবাই ভ্যাক্সিন না পেলে কেউ নিরাপদ না।

কোভিড টিকা ও মহিলা স্বাস্থ্য
গর্ভবতী মহিলাদের মডার্না ও ফাইজারের ভ্যাক্সিন না নেওয়া উচিৎ (ইউনাইটেড কিংডম হেলথ রেগুলটরি বডি)। কোন সেফটি ডাটা নেই। ‘সিডিসি’ আবার গর্ভবতী স্বাস্থ্য সেবাদানকারীদের নিতে বলেছে। আবার আমেরিকার ‘মেও’ ক্লিনিক এ ব্যাপারে কনফার্মেটরি কিছু বলেনি। ‘এনএইচএস’ এর মতে যারা এমন জায়গায় কাজ করেন যেখানে কোভিড হওয়ার সম্ভাবনা বেশী তারা গর্ভাবস্থায় নিতে পারবেন। যে সব মা বাচ্চাকে বুকের দুধ দেন তারাও ভ্যাক্সিন নিতে পারবেন। ভ্যাক্সিন ভবিষ্যত বংশবৃদ্ধি ক্ষমতাকে কোন ক্ষতি করে না বা ভ্যাক্সিন নেয়ার পর গর্ভধারণ করলে কোন ক্ষতি নেই।

পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
ভ্যাক্সিন নেওয়ার স্থানের আশেপাশে সামান্য লাল হওয়া, ফুলে যাওয়া ও ব্যথা হতে পারে। এছাড়া সামান্য জ্বর, মাথাব্যথা, পা কামড়ানো হতে পারে, কিন্তু তা বেশী হলে ৩ দিন থাকে। বেশী ব্যথা বা জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল এবং আইবিপ্রফেন নিলে হবে। টিকা দেয়ার স্থানে লাল ভাব বা ব্যথা ২৪ ঘণ্টার বেশি থাকলে ডাক্তারের সহায়তা নিতে হবে। টিকা দেয়ার জায়গায় ভেজা কাপড় দিয়ে রাখলেই যথেষ্ট। টিকা দেয়ার পর পর্যাপ্ত পানি ও ফলমূল খেতে হবে। ভ্যাক্সিন নেওয়ার পরে ৩০ মিনিট কেন্দ্রে থাকুন (হঠাৎ এলার্জি দেখা দিলে সাথে সাথে ব্যবস্থার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নিন)

টিকার ডোজ
দুটো ডোজ নিতে হবে। এক ডোজে কতদূর ও কতদিন সুরক্ষা হয় তার কোন পরিসংখ্যান নেই। ভ্যাক্সিন নেওয়ার পরে কোভিড টেস্ট পজিটিভ হয় না (সিডিসি)। ফাইজারের ও মডার্না টিকার মাঝখানে ব্যবধান ৬ সপ্তাহের বেশি যাতে না হয়। অক্সফোর্ড টিকার ২ ডোজের ব্যবধান ১২ সপ্তাহ পর্যন্ত হলেও অসুবিধা নেই। টিকা নেওয়ার মাঝখানে কোভিড হলে স্বীকৃত চিকিৎসা চলবে। বুস্টার ডোজ লাগবে কিনা এখনও অজানা।

আবার কোভিড হওয়ার সম্ভাবনা
যেহেতু এন্টিবডি তৈরি হতে সময় লাগে, তাই ভ্যাক্সিন নেওয়ার পরপর আপনার আবার কোভিড হতে পারে। তাই ভ্যাক্সিন নেওয়ার পরে ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা কয়েক সপ্তাহ বা আরও বেশি চালিয়ে যেতে হবে। এমনকি দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার পরেও অন্তত ২ সপ্তাহ সুরক্ষা ব্যবস্থা নিতে হবে (ডেনিয়েল সি ডিসেমন)।

সাবধানতা
ভ্যাক্সিন নেওয়ার আগেরদিন ও পরের দিন মদ্যপান নিষিদ্ধ (ইউকে)। ভ্যাক্সিন নেওয়ার পরে যারা নিজের আত্মীয়-স্বজনদের (যেমন বয়স্ক আত্মীয়স্বজন যারা এখনও ভ্যাক্সিন নেননি) সাথে দেখা করবেন তাদের অবশ্য মাস্ক পড়তে হবে ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে হবে।
টিকা ও প্রতিরোধ ক্ষমতা
যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম বা যারা এইডস রোগী বা অটোইমিউন রোগ (যেমন এসএলই) বা ক্যান্সার আক্রান্ত তাদেরকে ভ্যাক্সিন ট্রায়ালগুলিতে অন্তর্ভুক্ত না করাতে এসব রোগীদের পর্যাপ্ত ডাটা নেই। তারপরেও যেহেতু ওইসব রোগীর কোভিড হওয়ার রিস্ক ও রোগের তীব্রতা অন্যদের তুলনায় বেশী হয় তাদের ‘ঝুঁকির তুলনায় সুবিধা’ চিন্তা করলে এদেরও টিকা নেওয়া উচিৎ (যদিও তাদের টিকার কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ আছে)। কারণ এ টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রয়া নেই বললে চলে।

টিকা ও অন্যান্য ঔষধ
যারা রক্ত পাতলা করার ঔষধ (যেমন ওয়ারফেরিন) নেন, তাদের ল্যাব প্যারামিটার ঠিক থাকলে টিকা নেওয়া যাবে। যারা এন্টিপ্লেটলেট (যেমন এস্পিরিন) নেন তারাও টিকা নিতে পারবেন (যদিও কালশিটে দাগ একটু বেশী হতে পারে)। হার্ট, ব্লাডপ্রেসার, ডায়াবেটিস বা অন্যান্য ক্রনিক রোগের ঔষধ চলতে পারবে, টিকাও নেওয়া যাবে।

অগ্রাধিকার
যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুব কম যেমন ট্রান্সপ্ল্যান্ট রোগী, তীব্র নেফ্রোটিক সিন্ড্রোম, যারা ইমিউনোসাপ্রেসিভ ড্রাগ নেন তাদের অগ্রাধিকারভিত্তিতে আগে টিকা দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। টিকা দেওয়ার আগে ও পরে তাদের জন্য আলাদা ধরনের আইসোলেশন (যেমন শিল্ড আইসোলেশন অর্থাৎ বাসায় মাস্ক পরতে হবে, বাসায়ও মুখোমুখি কথা বলা যাবে না) চালিয়ে যেতে হবে।

টিকার মিশ্রণ
যদি প্রথম ডোজ এক ধরনের টিকা দেওয়ার পরে ওটা আর পাওয়া না যায় তাহলে অন্য টিকা দেওয়া যাবে। কিন্তু একই ডোজে মেশানো যাবে না। প্রথম বার সাধারণ এলার্জি হলেও দ্বিতীয় ডোজ নিতে হবে।

কোভিড ও অন্যান্য টিকা
যেহেতু অনেক কিছু জানা যায়নি তাই কোভিড টিকা নেওয়ার ২ সপ্তাহের মধ্যে অন্য কোন টিকা (যেমন ফ্লু) না নেওয়া ভাল (সিডিসি)।

পরিবর্তনশীল ভাইরাস এবং টিকার কার্যকারিতা
ভাইরাস তার গঠনগত পরিবর্তন করলেও যে টিকা কাজ করবে না তা ঠিক না। সব টিকা স্পাইক প্রোটেইনের বিরুদ্ধে তৈরি করা। এ প্রোটিনে ১২৭০টা এমিনো এসিড আছে। আমাদের শরীরের ইমিউন সিস্টেম এ স্পাইকের বিভিন্ন অংশের বিরুদ্ধে এন্টিবডি তৈরি করতে পারে। আমরা জানি, ভাইরাস খুব দ্রুত নিজেকে পরিবর্তন করলে অনেক সময় টিকা বের করা যায় না, তাই এখনও এইডস এর টিকা নেই। কিন্তু ফ্লু ভ্যাক্সিন প্রতি বছর বের হচ্ছে। আশার কথা কোভিডের পরিবর্তনের গতি ফ্লু’র চাইতে ধীরগতির। তাই দরকার হলে নতুন টিকা বের করা যাবে। বিশেষ করে মডার্না ও ফাইজারের ক্ষেত্রে এটা সহজ হবে।

কোভিড টিকা ও ব্যাথানাশক ঔষধ
যেহেতু ব্যাথানাশক ঔষধেও এলার্জি হয় তাই অনেকেই টিকা নেওয়ার পূর্বে ও ২ ঘণ্টা পরে এসব মেডিসিন না নেওয়ার জন্য উপদেশ দেওয়া হয়। কিন্তু যারা এন্টিহিস্টমিন নিচ্ছেন তারা তা চালিয়ে যেতে পারবেন।
কোভিড সম্পর্কে যেমন আমরা এখনও অনেক কিছু জানি না, তেমনি কোভিড টিকারও অনেক কিছু জানি না, যা হয়ত ফেজ ফোর ট্রায়ালে (ঔষধ জেনারেল পপুলেশনে দেওয়ার পর) বেরিয়ে আসবে। কোনো টিকা ১০০% কার্যকরী নয়। তাই টিকা দিলেও স্বাস্থ্য সুরক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে। এ টিকা ‘সাইটোক্রম এনজাইম’কে কি বাধা দেয়, না প্ররোচিত করে- তাও এখনও জানা যায়নি। এ এনজাইম দ্বারা বিভিন্ন ঔষধের মধ্যে মিশক্রিয়া নির্ধারণ করে তাই সব ড্রাগের ইন্টারেকশন এখনও অজানা। কোভিড কিন্তু এ এনজাইমকে নিষ্ক্রিয় করে রাখে। শেষ কথা, টিকা নেওয়ার আগে টিকা সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য, ডাক্তারের মতামত ও জাতীয় গাইডলাইন জেনে নিতে হবে।

তথ্যসূত্র: www.cdc.gov>vaccines>faq,

www.reuters.com>article,

www.healthline.com,

www.bhf.org.uk,

https://www.webmd.com/ vaccine

লেখক : প্রাক্তন উপাধ্যক্ষ ও বিভাগীয় প্রধান, নেফ্রোলজি বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ

পূর্বকোণ/পি-আরপি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট