চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

ফিরে দেখা ২০২০: করোনার আয়নায় স্বাস্থ্যের আসল রূপ

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা অফিস

২৪ ডিসেম্বর, ২০২০ | ৩:৩৫ অপরাহ্ণ

করোনা বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের আসল চেহারা খুলে দিয়েছে। দেখিয়ে দিয়েছে, এই খাতটি কতটা দুর্বল। কতটা লুটপাট চলছে বছরের পর বছর। তবে এটাও সত্য, লুটপাটের লাগাম টেনে ধরতে এবারই প্রথম জরুরি এই খাতের দুর্নীতিবাজদের চেহারা জাতির সামনে হাজির করার পাশাপাশি বিচারের পদক্ষেপও নিয়েছে সরকার। ইতিমধ্যে কয়েকজনের সাজা হয়েছে। বিচার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে ধৃতদের বিরুদ্ধে। সরকারের ত্বরিত পদক্ষেপে রিজেন্ট হাসপাতাল ও রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান সাহেদ করিম ওরফে মোহাম্মদ শাহেদ, জেকেজি হেলথ কেয়ারের সিইও আরিফুল হক চৌধুরী ও চেয়ারম্যান সাবরিনা আরিফ চৌধুরী, স্বাস্থ্যখাতের আলোচিত ঠিকাদার মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী আবজাল দম্পতি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাড়িচালক আবদুল মালেকদের নাম বেরিয়ে এসেছে।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের এই দুর্বলতার কারণ কী? সাধারণ চোখে মনে হবে বাংলাদেশে স্বাস্থ্যখাতে কম বাজেটই এর কারণ। আর প্রশ্ন করলে এই খাত নিয়ে যারা ভাবেন তারা আরো অনেক কারণ দেখান। কিন্তু সবার কাছ থেকেই একটি কথা ‘কমন’ শোনা যায়, আর তা হলো দুর্নীতি। চলতি বছরের বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে বেশি বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। তারপরেও জনমনে ইতিবাচক আশা জাগাতে পারছে না সরকার। কারণ এই খাতে দেওয়া বরাদ্দ যদি দুর্নীতির পেটে চলে যায় তাহলে বাজেট বাড়িয়ে কী লাভ? বিশ্লেষকরা মনে করেন- স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়ন বরাদ্দের শতকরা ৮০ ভাগই দুর্নীতির পেটে চলে যায়। তাদের আরও অভিযোগ- সাহেদ করিম ওরফে মোহাম্মদ শাহেদ, আরিফুল হক চৌধুরী, সাবরিনা আরিফ চৌধুরী, গাড়িচালক আবদুল মালেকের নাম বরিয়ে এলেও, তাদের সরকারি রক্ষকেরা রয়ে গেছেন আড়ালেই।

বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন (বিএমএ) মনে করে, ‘‘বাজেট কম হওয়ায় বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের এই চিত্র যেমন সত্য, তেমনি বাজেটের অধিকাংশ বরাদ্দ দুর্নীতির কারণে স্বাস্থ্যখাতের কোনও কাজে আসেনি। স্বাস্থ্যখাতের কোথায়, কী প্রয়োজন, তার সঠিক পরিকল্পনা হয়নি। একজন ডাক্তারের বিপরীতে নার্স থাকতে হয় তিনজন। কিন্তু এ দেশে আছে মাত্র আধা জন।’’ অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, কোভিড-১৯ মোকাবিলায় স্বাস্থ্যবিভাগ আরও সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বিশেষ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। বিএমএ মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরীর মতে, ‘‘স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বেড়েছে ভাল কথা। কিন্তু এটা পরিকল্পনাহীন। থোক বরাদ্দ কোনও সুনির্দিষ্ট বিষয় নয়। এর ফলে যা হয়, এই বরাদ্দের ৮০ ভাগ চলে যায় ব্যক্তিগত তহবিলে। দুর্নীতি খেয়ে ফেলে। তাহলে আর বরাদ্দ বাড়িয়ে লাভ কী?’’ তাছাড়া, দুর্নীতি প্রতিরোধে বাজেটে কোনও পরিকল্পনার কথা বলা হয়নি। বিশেষ করে স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতি নিয়ে অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় কিছু বলেননি।

স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতি : এবার আসা যাক স্বাস্থ্যখাতের দূর্নীতির প্রসঙ্গে। গত বছর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতির ১১টি খাত চিহ্নিত করে। তার মধ্যে বেশি দুর্নীতি হয়- কেনাকাটা, নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, পদায়ন, চিকিৎসাসেবা, চিকিৎসাসেবায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ব্যবহার, ওষুধ সরবরাহ খাতে। সাদা চোখে দেখা এ সব দুর্নীতির বাইরে আরও একটি অভিনব দুর্নীতির কথাও তুলে এনেছে দুদক। তা হলো, কেবলমাত্র দুর্নীতি করার জন্যেই অনেক অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনা। এমন যন্ত্রপাতি কেনা হয় যা পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষিত লোকবলও নেই সরকারী দপ্তরে। ওইসব যন্ত্রপাতি কখনোই ব্যবহার করা হয়না। দুদক এই দুর্নীতি প্রতিরোধে ২৫ দফা সুপারিশ করে বলে, দুর্নীতির কারণেই স্বাস্থ্যখাতের করুন অবস্থা। তারা তাদের এই তদন্তপত্র স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের হাতে তুলে দিয়েছিলেন ব্যবস্থা নেয়ার জন্য। কিন্তু কয়েকজন ব্যবসায়ী ও ঠিকাদার চিহ্নিত করা ছাড়া আজ পর্যন্ত সরকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারী পর্যায়ে দৃশ্যমান বড় ধরনের পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।

বলা বাহুল্য, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে কমপক্ষে এক হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে স্বাস্থ্যখাতের যন্ত্রপাতি কেনায়। ২৭টি সরকারি হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কেনাকাটার তথ্য নিয়ে সংবাদমাধ্যম দুর্নীতির এই চিত্র প্রকাশ করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জন্য যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় প্রকৃত মূল্যের চেয়ে ১৮৬ গুণ বেশি দাম দেখানো হয়েছে। এক সেট পর্দার দাম দেখানো হয়েছে ৩৭ লাখ টাকা। ১৭৫ কোটি টাকার নি¤œমানের যন্ত্রপাতি কেনা হয় গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের জন্য। রংপুর মেডিকেল কলেজে প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও চার কোটি টাকার সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতি কেনা হয়, যা কখনোই ব্যবহার করা হয়নি। ২০১৭ সালে টিআইবির খানা জরিপে স্বাস্থ্যখাতকে দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। জরিপে অংশ নেয়া ৪২.৫ ভাগ মানুষ স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়ে ঘুষ দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। সর্বশেষ এই করোনার মধ্যে চিকিৎসকদের জন্য পিপিই এবং এন-৯৫ মাস্ক কেলেঙ্কারির কথা সবার জানা।

মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু : স্বাস্থ্যখাতের প্রভাবশালী ঠিকাদার মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু। দেশের স্বাস্থ্য খাতে মাফিয়া ডন হিসেবে নাম উঠে এসেছে এই মিঠুর। মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে রয়েছেন। কিন্তু সেখানে বসেই তিনি সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন।

গাড়িচালক আব্দুল মালেক : স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিবহন পুলের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী গাড়িচালক আব্দুল মালেককে গত ১৯ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তারের পর র‍্যাপিড একশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন- অবৈধ অস্ত্র, জাল নোটের ব্যবসা, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকা-ের অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই কর্মচারীর বিপুল সম্পদের খোঁজ পেয়েছেন বলেও জানান তারা। মালেককে গ্রেপ্তারের পর র‌্যাব জানায়, তার দুটি সাততলা ভবন, নির্মাণাধীন একটি ১০ তলা ভবন, জমি, গরুর খামার ও বিভিন্ন ব্যাংকে নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ গচ্ছিত অর্থের সন্ধান পাওয়া গেছে। তার সম্পদের অর্থমূল্য শত কোটি টাকারও ওপরে।

একজন আদর্শ প্রতারক সাহেদ করিম : রিজেন্ট হাসপাতাল ও রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহেদ ওরফে সাহেদ করিমকে আদর্শ প্রতারক হিসেবে অভিহিত করেছে র‍্যাব। সাহেদ করিমকে গ্রেফতারের পর তার বিরুদ্ধে ‘হটলাইন’ ও ই-মেইলে প্রতারণার ১৪০ অভিযোগ জমা হয় বলে জানিয়েছিল র‍্যাব। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ জানিয়েছিলেন, সাহেদ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন প্রায় ১০ কোটি টাকা।

চিকিৎসক হয়েও প্রতারণায় নাম লেখান সাবরিনা : ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক। সাবরিনার কারণেই করোনার নমুনা সংগ্রহের কাজ পায় জেকেজি হেলথকেয়ার নামের এক অখ্যাত প্রতিষ্ঠান। প্রথমে ঢাকার তিতুমীর কলেজ মাঠে স্যাম্পল কালেকশন বুথ স্থাপনের অনুমতি মিললেও প্রভাব খাটিয়ে ঢাকা, নায়ায়ণগঞ্জ, নরসিংদী ও গাজীপুরসহ বিভিন্ন স্থানে ৪৪টি বুথ স্থাপন করেছিল সাবরিনার প্রতিষ্ঠান জেকেজি। নমুনা সংগ্রহের জন্য মাঠকর্মী নিয়োগ দেন তারা। তাদের হটলাইন নম্বরে রোগীরা ফোন দিলে মাঠকর্মীরা বাড়ি গিয়ে এবং বুথ থেকেও নমুনা সংগ্রহ করতেন। এভাবে নমুনা সংগ্রহ করে তারা ২৭ হাজার রোগীকে করোনা টেস্টের রিপোর্ট দেন। এর মধ্যে ১১ হাজার ৫৪০ জনের করোনার নমুনা আইইডিসিআরের মাধ্যমে সঠিক পরীক্ষা করানো হয়েছিল। বাকি ১৫ হাজার ৪৬০ জনের রিপোর্ট প্রতিষ্ঠানটি জালিয়াতির মধ্যেমে তৈরি করে।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট