চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

মন্তব্য প্রতিবেদন

করোনার ওষুধ অনুসন্ধান ও আশাজাগানিয়া ভ্যাকসিন

রুশো মাহমুদ

২৬ এপ্রিল, ২০২০ | ৭:৩৪ অপরাহ্ণ

একটি জার্ম
অতি ছোট যে কোনো জীবন্ত কিছু থেকে বড় আকারের কোন জীব সৃষ্টি হলে ল্যাটিন ভাষায় তাকে বলা হয় জার্মেন (এবৎসবহ)। ইংরেজি ভাষায় শব্দটিকে একটু ছেটে বলা হয় জার্ম (এবৎস) বা জীবাণু।
জীবাণুরা আছে বলেই আমরা বেঁচে আছি, আবার আমাদের অস্তিত্ব প্রায়ই বিপদের মধ্যে ফেলে এই জীবাণুরাই। আমরা সবাই মাঝেমাধ্যে সর্দি-কাশি বা ঠা-ার সমস্যায় ভুগে থাকি। এসব সমস্যার জন্য দায়ী অতি ক্ষুদ্র একটি পরজীবী জীবাণু। একে বলে ভাইরাস। এটি এতই ছোট যে খালি চোখে দেখা সম্ভব নয়। অধিকাংশ ভাইরাসই স্পর্শ, খাদ্য, পানীয়, বাতাস ইত্যাদির মাধ্যমে ছড়ায়। ভাইরাস নিজে নিজে বেঁচে থাকতে পারে না। এটি অন্যের দেহে বেঁচে থাকে।
অতি ক্ষুদ্র, কিন্তু কী ভয়ংকর এক জীবাণু! শুধু সর্দি-কাশি নয়, ভাইরাসের কারণে বসন্ত, হাম, জলাতঙ্ক এমনকি এইডস ও হেপাটাইটিস বি’র মতো মরণব্যাধিও হয়ে থাকে। এই রকম একটি প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস, যা মহামারীকে ছাড়িয়ে অতিমারীতে রূপান্তরিত হয়েছে। গোটা বিশ্বকে ফেলে দিয়েছে গভীর সংকটে। এখন একটি ত্রাসের নাম ‘করোনা’। সারা দুনিয়ার জনস্বাস্থ্য, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভারসাম্য আজ হুমকির মুখে।

কার্যকর ওষুধের সন্ধানে
উদ্বেগ তৈরি করা করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ রোগের কার্যকর ওষুধের খোঁজে সারাবিশ্ব। প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ, বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। কিন্তু এখনও পর্যন্ত এই রোগের চিকিৎসায় কার্যকরী কোন ওষুধ পাওয়া যায়নি। একটি জীবন রক্ষাকারী ওষুধ পেতে কী চেষ্টাই না চলছে। দেড়শোর বেশি ওষুধ নিয়ে গবেষণা চলছে। এর মধ্যে বেশিরভাগই হচ্ছে বর্তমানে চালু আছে এমন ওষুধ। আক্রান্ত রোগীদের ওপর এগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করে কিনা সেটা দেখতে।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ‘সলিডারিটি ট্রায়াল’ নামে একটি পরীক্ষা চালু করেছে এবং এর মাধ্যমে দেখতে চাইছে কোন ওষুধগুলো সবচেয়ে সম্ভাবনাময়। যুক্তরাজ্যেও চালু হয়েছে ‘রিকভারি ট্রায়াল’। দুটি ক্ষেত্রেই ম্যালেরিয়ার ওষুধ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা হু’র ব্যর্থতার ধোঁয়া তুলে আমেরিকা-যুক্তরাষ্ট্র বৈশ্বিক উদ্যোগে না থেকে একা একাই কাজ করছে। যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা এখন চলছে আগামী কয়েক মাসে হয়তো সেগুলোর ফল আমরা জানতে পারবো।

সম্ভাব্য সমাধান ভ্যাকসিনে
চিকিৎসকেরা কিছু ওষুধের সাহায্যে ভাইরাসবাহিত রোগের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন মাত্র, কারণ ওষুধ ভাইরাসকে ধ্বংস করতে পারে না। ভাইরাসজনিত রোগ থেকে মানুষকে রক্ষা করতে বিজ্ঞানীরা প্রতিষেধক হিসাবে টিকা আবিষ্কার করেছেন। করোনা ভাইরাসেরও সম্ভাব্য সমাধান ভাবা হচ্ছে এই রোগের ভ্যাকসিনের আবিষ্কার।
বিশ্বের দেশে দেশে করোনাভাইরাসের টিকা উদ্ভাবনে প্রক্রিয়া বর্তমানে নানা পর্যায়ে আছে। এখন পর্যন্ত এরকম প্রায় ৮০টি উদ্যোগের কথা জানা যায়। অনেক সময় টিকা তৈরির বিভিন্ন পর্যায় শেষ হয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে যেতে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়। বিজ্ঞানীদের মতে কার্যকর একটি ভ্যাকসিন তৈরির গবেষণায় সাধারণত ১৮ মাস সময় লেগে যায়। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনে মানবদেহে পরীক্ষামূলক ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়েছে। সর্বশেষ ২৩ এপ্রিল তৃতীয় পরীক্ষাটি করা হয়েছে অক্সফোর্ডে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, ব্রিটিশ সরকার ও ব্রিটেনের কয়েকটি এনজিও’র অর্থায়নে ২০০৫ সালে গড়ে তোলা হয় জেনার ইনস্টিটিউট। উদ্দেশ্য সংক্রমণজনিত রোগ নিয়ে গবেষণা ও টিকা তৈরি। যার নামে এই ইনস্টিটিউটের নামকরণ তিনি হচ্ছেন ভ্যাকসিনের জনক এডওয়ার্ড জেনার। প্রায় ২০০ বছর আগে গুটি বসন্তের টিকার অন্যতম আবিষ্কারক ছিলেন তিনি ।
অক্সফোর্ড যে ভ্যাকসিনটি তৈরি করতে চলেছে সেটির নাম দেওয়া হয়েছে চ্যাডক্স ১ (ঈযধফড়ী১) । এই যুগান্তকারী ভ্যাকসিন আবিষ্কার ও গবেষণার নেতৃত্বে রয়েছেন বিজ্ঞানী প্রফেসর সারা গিলবার্ট। যিনি ইবোলা মহামারী প্রতিরোধকারী ভ্যাকসিন তৈরির পথ দেখিয়েছেন।
অক্সফোর্ডের বিজ্ঞানীরা এই প্রতিষেধকটি নিয়ে খুব আত্মবিশ্বাসী। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের সূত্রে জানা যায়, বিশ্বের সাতটি জায়গায় এই প্রতিষেধক তৈরির কাজ চলছে। প্রস্তুতকারী অংশীদার হিসেবে রয়েছে ব্রিটেনের তিনটি সংস্থা, ইউরোপের দুইটা, চীনের একটা এবং ভারতের একটা। এই প্রতিষেধকের সাফল্য নিয়ে ৮০ ভাগ নিশ্চিত এর সাথে যুক্ত বিজ্ঞানীরা।
অক্সফোর্ড বিজ্ঞানীদের মধ্যে গবেষণার নেতৃত্বে থাকা ভ্যাকসিনোলোজির অধ্যাপক সারা গিলবার্ট বলেছেন, এই ভ্যাকসিন একবার দিলে দীর্ঘ মেয়াদে করোনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব। করোনা তার রূপ পরিবর্তন করলেও ভ্যাকসিনটি কাজ করবে। সবচেয়ে আশার কথা, কার্যকরী হলে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় সারা পৃথিবীর মানুষের জন্য এই ভ্যাকসিন উন্মুক্ত করবে দ্রুততম সময়ে।
অধ্যাপক সারা গিলবার্ট আরেকটি আশা জাগানিয়া কথা বলেছেন, কার্যকর একটি ভ্যাকসিন তৈরির গবেষণায় সাধারণত ১৮ মাস লেগে যায়, তারপরও তার টিম এখন যে টিকা তৈরি করছে সেটি সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকেই ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে।
ধন্যবাদ জানাই প্রফেসর সারা গিলবার্ট আর তাঁর টিমকে। পাশাপাশি ধন্যবাদ জানাই ৩২ বছর বয়সী আরেক নারী বিজ্ঞানী এলিসা গ্রানাতোকে যিনি চ্যাডক্স ১ ভ্যাকসিনটি প্রথম নিজের শরীরে গ্রহণ করেছেন।
ভ্যাকসিনের সাফল্যের দিকে তাকিয়ে আছি আমরা। তাকিয়ে আছে সারা বিশ্ব। মানুষতো আশায় বাঁচে। বাঁচার লড়াইয়ে আমাদের জিততেই হবে।

লেখক : সম্পাদক, সুপ্রভাত বাংলাদেশ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট