চট্টগ্রাম বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত ‘বাংলা বন্ড’

অনলাইন ডেস্ক

১৪ নভেম্বর, ২০১৯ | ১১:১৫ অপরাহ্ণ

প্রাণ গ্রুপে অর্থায়নের জন্য সরকারের অনুমোদন নিয়ে গত ১২ নভেম্বর লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হয়েছে বাংলাদেশি মুদ্রায় ‘বাংলা বন্ড’। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংক অব আমেরিকা ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের কাছে আগেই এই বন্ড বিক্রি করে প্রাণ গ্রুপকে ৮০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে বিশ্বব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি)। এই বন্ডের দুই ক্রেতা ব্যাংক যাতে তাদের প্রয়োজনে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে মেয়াদ পূর্তির আগেই বিক্রি করতে পারে, সেজন্যই লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জে বন্ডটি তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। প্রাণ গ্রুপকে ঋণ দিতে আরও ৮০ কোটি টাকার বন্ড ছাড়ার পরিকল্পনা ছিল আইএফসির। এক্ষেত্রে ১১ শতাংশ হারে সুদ চায় সংস্থাটি। সুদহার ১০ শতাংশের কম না হওয়ায় এখনো তাতে সরকারের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন মেলেনি। সরকারের ঘোষিত নীতি অনুযায়ী, ঋণের সুদের হার হতে হবে ১০ শতাংশের নিচে বা সিঙ্গেল ডিজিটে। আইএফসি তাতে রাজি না হওয়ায় পরবর্তী ৮০ কোটি টাকা সংগ্রহে বন্ড ছাড়ার উদ্যোগ আটকে গেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জে যে বন্ড ইস্যু করা হয়েছে, তার নাম ‘বাংলা বন্ড’। এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এই বন্ডের সুদাসলের হিসাব হবে বাংলাদেশি মুদ্রা টাকায়, পরিশোধও করা হবে টাকায়। ফলে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ পুঁজিবাজার লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জসহ বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত অন্যান্য মুদ্রার তালিকায় বাংলাদেশি টাকার পরিচিতি বাড়বে।

বাংলা বন্ড ছাড়ার প্রক্রিয়া ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নয়নে ঋণ দেয় আইএফসি। এরই অংশ হিসেবে প্রাণ গ্রুপ তাদের প্রাণ এগ্রো লিমিটেডে বিনিয়োগ বাড়াতে আইএফসির কাছ থেকে ৮০ কোটি টাকা ও নাটোর এগ্রো লিমিটেডের ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য ৮০ কোটি টাকা করে মোট ১৬০ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার চুক্তি করে। ২০১৫ সালের দিকে আইএফসির সঙ্গে প্রাণ গ্রুপের দুটি ঋণ চুক্তি হয়েছিল। ওই সময় প্রতি ডলার ৮০ টাকা হিসাবে ১৬০ কোটি টাকা বা ২ কোটি ডলার ঋণ দেয়ার কথা চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়।

ব্যাংক সাধারণত আমানত সংগ্রহ করে। সেই অর্থ ঋণ হিসেবে বিতরণ করে। কিন্তু আইএফসি সাধারণের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করে না। সংস্থাটি নিজস্ব তহবিল থেকে ও বন্ড ছেড়ে তহবিল সংগ্রহ করে সেই অর্থ ঋণ হিসেবে বিতরণ করে।

ঋণ দেয়ার বিষয়ে প্রাণ গ্রুপের সঙ্গে আইএফসি আলাদা দুটি চুক্তি করে। এর একটিতে বলা হয়, প্রাণ এগ্রোতে ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ সুদ হারে ৮০ কোটি টাকা বা ৯৫ লাখ ডলার ঋণ দেবে আইএফসি। ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ সুদ হারের মধ্যে ৯ শতাংশ মূল সুদ ও দশমিক ৭৫ শতাংশ অন্যান্য ব্যয়। এ চুক্তিপত্র অনুমোদন করে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)। চুক্তি অনুযায়ী প্রাণ গ্রুপকে ৮০ কোটি টাকা ঋণ দেয়ার তহবিল জোগাড় করতে ‘বাংলা বন্ড’ নামে তিন বছরমেয়াদি একটি বন্ড ছাড়ে আইএফসি।

আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা ও অর্থ ফেরত দেয়ার নিশ্চয়তা থাকায় আইএফসির ছাড়া ৮০ কোটি টাকার বাংলা বন্ড কিনে নেয় ব্যাংক অব আমেরিকা ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক। এ দুই ব্যাংকের কাছে আইএফসি বন্ড বিক্রি করে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ সুদে। তিন বছরমেয়াদি এই বন্ডের সুদাসল পরিশোধ করা হবে মেয়াদ শেষে। অর্থাৎ আইএফসি বন্ড ছেড়ে সংগ্রহ করা ৮০ কোটি টাকা প্রাণ গ্রুপকে ঋণ দিয়ে সুদ পাবে ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ হারে এবং বন্ডের ক্রেতাদের পরিশোধ করবে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ সুদ হারে। এ দুই সুদ হারের পার্থক্যের বাকি টাকা আইএফসি নিজের মুনাফা ও পরিচালন ব্যয় হিসেবে নেবে। তথ্যসূত্র : দেশ রূপান্তর।

লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জে বাংলা বন্ড তালিকাভুক্তির কারণ সম্পর্কে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, বন্ডের মেয়াদ তিন বছর হওয়ায় মেয়াদ পূর্তির আগে অর্থের প্রয়োজন হলেও ব্যাংক অব আমেরিকা ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডকে সুদাসল পরিশোধ করবে না আইএফসি। তাই দুই ক্রেতা ব্যাংক তাদের প্রয়োজনে যেন তিন বছরের মধ্যে যেকোনো সময় এই বন্ড অন্য বিনিয়োগকারীদের কাছে বিক্রি করতে পারে, সেজন্যই তা লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে যেমন বন্ডে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করতে পারেন, লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জেও সেভাবেই লেনদেন হবে, যদি ব্যাংক অব আমেরিকা ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক তা বিক্রি করতে আগ্রহী হয়। বাংলা বন্ডের আগে আইএফসি ভারতীয় রুপিসহ ৫০টিরও বেশি মুদ্রাতে বন্ড ছেড়ে তহবিল সংগ্রহ করে বিভিন্ন দেশের প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়েছে।

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল জানান, আইএফসি প্রাণ গ্রুপকে টাকায় ঋণ দেবে এমন চুক্তি রয়েছে। ইতিমধ্যে তিন বছরের জন্য ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ সুদে ৮০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে আইএফসি, যা প্রাণ এগ্রো লিমিটেডে কাজে লাগানো হয়েছে। আইএফসি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ওই ফান্ড সংগ্রহ করে ঋণ দিয়েছে। বাকি ৮০ কোটি টাকা ঋণের বিষয়ে এখনো সুরাহা হয়নি। এক্ষেত্রে আইএফসি একটু বেশি সুদ চাচ্ছে। বিডা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনসাপেক্ষে ওই ঋণ পাওয়া যাবে। তিনি বলেন, এই বন্ড লন্ডনের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জন্য নতুন দ্বার উন্মোচিত হলো। বিদেশি উৎস থেকে বাংলাদেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর নেয়া ঋণ পরিশোধের সক্ষমতার বিষয়টি বিশ্বজুড়ে প্রতিষ্ঠা পাবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা সাংবাদিকদের জানান, লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত এই টাকা বন্ড বাংলাদেশের সুনাম বাড়াবে। বিশেষ করে টাকার পরিচিতি বাড়বে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদেশি উৎস থেকে ঋণ গ্রহণ ও পরিশোধ সক্ষমতা প্রকাশ পাবে। এতে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন রেটিংয়ে বাংলাদেশের মান বাড়বে। এছাড়া এটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের প্রথম তালিকাভুক্ত বন্ড। সেটিও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অবশ্য বাংলাদেশের বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড লন্ডন স্টক এক্সেচঞ্জের ‘স্মল ক্যাপিটাল বোর্ডে’ আগে থেকেই তালিকাভুক্ত রয়েছে।

বাংলাদেশের পুঁজিবাজারেও টাকায় বন্ড তালিকাভুক্ত করে তহবিল সংগ্রহ করতে পারে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। এসিআই লিমিটেড দেশের পুঁজিবাজারে বন্ড ছেড়ে তহবিল সংগ্রহ করে। বর্তমানে ইসলামী ব্যাংকের মুদারাবা পারপিচ্যুয়াল বন্ড তালিকাভুক্ত রয়েছে। আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি পুঁজিবাজারে বন্ড তালিকাভুক্ত করে ১০০ কোটি টাকা সংগ্রহের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। বাংলাদেশে বন্ড মার্কেট শক্তিশালী করতে সরকারের নানা উদ্যোগ নেয়ার কথা বিভিন্ন সময় জানিয়ে আসছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ বিষয়ে একটি নীতিমালা প্রণয়নের কাজ চলছে বলে জানা গেছে।

পূর্বকোণ-রাশেদ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট